২৯ জুন ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১১:৪৭

গ্রামের মানুষ পরিবর্তন চায়, ভোট চায়

বিবিধ প্রসঙ্গ

মাসুদ মজুমদার :
কোনো প্রকার বড়মাপের সঙ্কট ছাড়াই পবিত্র ঈদুল ফিতর উদযাপিত হলো। ঘরমুখো মানুষের বিড়ম্বনা কেউ বিবেচনায় নেয়নি। ঈদ আনন্দের আতিসহ্যে মানুষের ছোট ছোট কষ্ট কেউ আমলে নেননি।

রাজনীতিবিদেরা অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন জনসংযোগ করে। ঈদের আগেই জাতীয় নির্বাচনের একটা আবহ সৃষ্টির চেষ্টা চলেছে। কেন্দ্রীয় নেতা এবং হাইকমান্ড সবাইকে ভোটারদের কাছে পৌঁছার তাগিদ দিয়েছেন। ক্ষমতাসীন দলের নেতারা আগাম জানিয়ে দিয়েছেন, জনগণের কাছে আস্থাভাজন নন এমন কাউকে দল নমিনেশন দেবে না। এই বক্তব্যের একটা ইতিবাচক দিক রয়েছে। সব প্রার্থী ধরেই নিয়েছেনÑ আগামী নির্বাচন ’১৪ সালের ৫ জানুয়ারির মতো হবে না। বিনা যুদ্ধে কেউ দেবেন না সুচাগ্র মেদিনী। এ ধরনের রাজনৈতিক আবেদন-নিবেদনের মধ্যেও ঈদ অনেক কিছুকে চাপিয়ে গেছে।

ঈদের আগে সড়কে মৃত্যুর মিছিল এবারো ঠেকানো সম্ভব হয়নি। সীমাহীন দুর্ভোগÑ নানা ধরনের ঝুঁকি এবং অনেক ঝক্কি নিয়েও ফেরার মধ্যেই যেন ঈদের সবটুকু আনন্দ মিলেমিশে ছিল। ঈদ জাতীয় উৎসবÑ এর প্রভাব এত বেশি অন্য কোনো অনুষ্ঠান এর সামান্যতমও আড়াল করতে পারে না। সম্ভবত এটাই ঈদের অধ্যাত্মিক গভীরতার একটা রূপ। অন্য রূপটা দৃশ্যমান।
এখন পর্যন্ত নিশ্চিত করে বলা যায় বিএনপি জোট সামনের নির্বাচনে কাউকে ওয়াকওভার দেবে না। বিগত দিনের গ্লানি এবং রাজনৈতিক নিপীড়ন মাথায় রেখেই নির্বাচনে অংশ নেবে। বিএনপি ভোটের রাজনীতিতে অনেক বেশি সতর্ক ও পারঙ্গম দল হিসেবে পরিচিতি পায়নি, বরং আওয়ামী লীগের মারদাঙ্গা নির্বাচনী রাজনীতির কাছে কতকটা অসহায়ও বটে। তারপরও ভোটের রাজনীতির সব ক’টি ইতিবাচক সুফল এবার বিএনপির দিকে ঝুঁকে আছে। গুম, অপহরণ, হামলা-মামলা এবং সরকারি দলের সীমাহীন দলবাজি ঔদ্ধত্য এবং ক্ষেত্রবিশেষে জবরদস্তির সুফলটাও বিএনপির পক্ষে যাবে। বাংলাদেশের মানুষের ভোটার হিসেবে চিরায়ত কতগুলো প্রবণতা রয়েছে। এগুলো এখনো সক্রিয়। প্রথমত, জনগণ নিপীড়িতের পক্ষে থাকার চেষ্টা করে। দ্বিতীয়ত, পাঁচ বছরের বেশি একটি দলকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না। নতুন দলকে ক্ষমতায় এনে আবার ভাগ্যটা পরখ করে দেখতে চায়। তা ছাড়া বিএনপির ব্যর্থতা ও বাড়াবাড়ির জবাবটা আওয়ামী লীগকে দিয়েই দিতে চেষ্টা করে। আবার আওয়ামী লীগের বাড়াবাড়ির একটা মোক্ষম জবাব চাওয়ার ফল পাবে বিএনপি, এটাই এখন পর্যন্ত ভোটের রাজনীতির সাধারণ প্রবণতা।

দ্বিধারাকেন্দ্রিক রাজনীতিতে সহসা পরিবর্তন আসার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এবার প্রচুর মানুষ গ্রামে গেছেন। কেউ কেউ ফিরেও এসেছেন। গ্রামভিত্তিক একটা সাধারণ জরিপে দেখা গেছেÑ আওয়ামী লীগের নানা সুরে আরো বেশি দিন ক্ষমতায় থাকার অভিলাষ গ্রামের মানুষ ভালোভাবে নিচ্ছে না। ক্ষমতার দাপট আরো কিছু দিন চলুক এটা যেন কারো চাওয়ার বিষয় নয়। সবাই এবার ভোট দিতে চায়। পরিবর্তন চায়। তাই আগামী দিনের নির্বাচন হবে পরিবর্তনের এবং তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার।

তৃতীয়ত, ঈদ প্রত্যেকটি মা-বাবা ও স্বজন-প্রিয়জনকে নতুন করে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেÑ তার গুম হওয়া ছেলেটি এখনো ফেরেনি। স্ত্রী স্বামীর অপেক্ষায় এখনো প্রহর গোনে। সন্তান বাবার জন্য, ভাই ভাইয়ের জন্য অধীর আগ্রহে ঈদের দিনও প্রহর গুনেছে। গুম ও অপহরণের তালিকাটি কম দীর্ঘ নয়। এরা ব্যতিক্রম ছাড়া সবাই বিএনপি-জামায়াত জোটের সদস্য। এর বাইরে বিচারবহির্ভূত হত্যার তালিকাটাও ছোট নয়। প্রত্যেকটি হত্যার পর একটা করে গল্প ফাঁদা হয়েছে। ঘুরেফিরে কাহিনী একই ধরনের। বিচারবহির্ভূত হত্যার লক্ষ্যে বন্দুকযুদ্ধ, এনকাউন্টার, ক্রসফায়ার কেউ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এমন গল্পে বিশ্বাস যায়নি। অবিশ্বস্ততার এই ফাটল মেরামত করার কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি, বরং ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর দুঃখবোধ এবং রক্তক্ষরণের দগদগে ক্ষতটার ওপর রাজনীতির বিষাক্ত হুল ফুটানো হয়েছে, যা ছিল আরো অসহনীয় যন্ত্রণার।

বাংলাদেশের মানুষ জঙ্গিবাদ ও চরমপন্থী কোনো ধারণাকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয় না। রাজনৈতিক ইসলামকে গ্রহণ করার সময়ও একটা ধারণাগত স্বচ্ছতার বিষয় সামনে রেখে বাছাই করে। আমাদের জানামতে, শুধু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ এই বিবেচনায় হাজার হাজার মানুষকে ঘর থেকে তুলে আনা হয়েছে। সাদা পোশাকের কালো শাসন ঘরে ঘরে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। ব্যক্তিজীবনের নিরাপত্তা বারবার হুমকিতে পড়েছে। কেউ জানে না কখন কোন বাড়িতে ‘গেস্টাপো’ বাহিনীর মতো হামলা চালানো হবে। কোনো প্রকার কারণ না দেখিয়ে তুলে নেয়া হবে। সরকার ক’দিন জঙ্গি আস্তানা চিহ্নিত করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অভিযান চালিয়েছে। জনগণ বিস্ময়ের দৃষ্টিতে সব তাকিয়ে দেখেছে। কান খাড়া করেছে, কিন্তু আমলে নেয়নি। বিশ্বাসও দুর্বল। তারপর এসব অভিযানে পর্বতের মূসিক প্রসবের মতো বিষয় নিয়ে নানা গল্পের চর্চা হয়েছে। তাতে সরকারের ইমেজ ফুটো হয়েছে মাত্র, বাড়েনি। তাই নানা ধরনের আতঙ্ক ও ভীতসন্ত্রস্ত পরিবেশে ঈদের বাহ্যিক আড়ম্বর ছিল, ভেতরে কষ্টগুলো গুমরে গুমরে কেঁদেছে। একটা স্বাধীন দেশে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে দিনের পর দিন গুম করে রাখা হলো। থানা বলে জানে না। গোয়েন্দারা বলে তাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। অথচ দীর্ঘ দিন পর কাউকে চোখ বাঁধা অবস্থায় কোনো এক নির্জন স্থানে রেখে যাওয়া হচ্ছে। কারো কারো লাশ মিলছে হাওর-বাঁওড়, ঝিল-বিল-খালে কিংবা নর্দমায়। এই চিত্র কিসের!

এক দিকে ঈদের জন্য মধুর প্রতীক্ষা, অন্য দিকে কারাবন্দী কিংবা নিখোঁজ স্বজনদের জন্য অধীর আগ্রহÑ এর মধ্যে কোনো সমীকরণ হয় না। প্রকৃতির নিয়মে মানুষ মৃত্যুবরণ করে। রোগে-শোকে মানুষ কাতর হয়। তারপরও সান্ত্বনা খুঁজে নেয়। ক্ষোভ-দুঃখ, আহাজারি, মাতম এবং অনুযোগ-অভিযোগ করে আরশের প্রভুর কাছে, আবার প্রকৃতির নিয়মে সান্ত্বনাও খুঁজে পায়। এই সান্ত্বনার একটা অর্থ আছে। কিন্তু ইলিয়াস আলীর মায়ের সান্ত্বনা আসবে কোথা থেকে। চৌধুরী আলমের স্বজনেরা কার কাছে সান্ত্বনা চাইবে। সাগর-রুনির সন্তানের সান্ত্বনা কী? অন্য যারা গুম ও অপহৃত হলো তাদের জন্য জবাব কী? রাষ্ট্র এবার অনেক পরিবারকে ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত করেছে। বিরোধীদলীয় কোনো রাজনৈতিক কর্মী ঈদে বাড়ি গিয়ে ঈদ উদযাপনের পরিবেশ এবারো পায়নি। কারণ, সরকারি দলের ক্যাডারদের ঈদ উদযাপনে এবার ভোটের রাজনীতির আলাদা মাত্রা পেয়েছে। নেতানেত্রীরা এবার কর্মী ও ক্যাডারদের নিয়ে এলাকায় যাওয়ার অর্থ, রাজনীতির দৌরাত্ম্য প্রকাশের জন্য বিশেষ বিশেষ মহড়ার ব্যবস্থা করা। বাস্তবে ঈদের সাথে ক্ষমতার এই উৎপাতও ছিল।

হাওরবাসীর ঈদ উদযাপন নিয়ে আমরা অনেকেই ভাবিনি। দিনের পর দিন বিচ্ছিন্ন জনপদ পার্বত্য এলাকায় ধ্বংসের বিভীষিকা মানুষকে তাড়া করেছে। তাদের কষ্টের চেহারায় ঈদের আনন্দ কতটা প্রতিফলিত হবে সে জিজ্ঞাসা কোনো রাজনীতিবিদের মনে জেগেছে কি না, আমরা জানি না।

আলেম-ওলামারা বলেন, একজন মানুষের অনেক দায়িত্ব। প্রথম দায়িত্ব আল্লাহর হক আদায় করা। দ্বিতীয় দায়িত্ব বান্দার ন্যায়সঙ্গত পাওনা আদায় করা। তৃতীয়ত, মা-বাবার হক আদায় করা বা সেবা নিশ্চিতের কাজ অক্ষরে অক্ষরে পালন করা।
বহুজাতিক কোম্পানির ঈদবাণিজ্যের কাছে আধ্যাত্মিক চৈতন্যের ঈদ অনেকটা ম্লান হয়ে যাচ্ছে। তাই এ দেশের হঠাৎ আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া মানুষ ঈদের সওদায় ওপারে যায়। টাকা ওড়ানোর এই বাহাদুরির ভেতর আমাদের নি¤œবিত্ত ও হতদরিদ্রের প্রকৃত ঈদ আর থাকল কই।

কষ্ট করে মানুষ গ্রামে ফিরেছে। স্বজনদের মধুর অপেক্ষার অবসান ঘটেছে। বস্তুবাদের উদরে যতটুকু লিন হয়ে গেছেÑ তা তো গেছে, অবশিষ্টটুকু টিকে আছে স্বজন-প্রিয়জনের ঈদ মিলনের মধুর ও অম্লান হাসির ভেতর। ঈদমাঠে কোলাকুলির মধ্যে। বৃদ্ধ পিতা বৃদ্ধ মায়ের কুঁচকে যাওয়া অমসৃণ হাতের পরশ বুলানোর মাঝে। সব হারানোর ভেতর এইটুকু তো আমাদের অবশিষ্ট আছে। এ টুকু সান্ত্বনাই না হয় এবার ঈদের নগদ পাওয়া।
masud2151@gmail.com

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/231443