২৫ জুন ২০১৭, রবিবার, ১২:৩৮

এবারও দেশের ঈদ বাজার ভারতীয় পোশাকের দখলে

দোরগোড়ায় করা নাড়ছে মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদ-উল ফিতর। বিশ্বের মুসলিমদের মাঝে আয়োজনের শেষ নেই এ উৎসবকে ঘিরে। প্রতিবছরের ন্যায় এবারও বাংলাদেশের ঈদের বাজার দখল করে আছে ভারতীয় পোশাক। গত কয়েক বছর ধরে ঈদকে কেন্দ্র করে ভারতীয় টিভি সিরিয়াল ও সিনেমার নায়িকাদের নামে ড্রেস বের হওয়ার হিড়িক পড়েছে। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের পোশাক বাজার পুরোটাই থাকে ভারতীয় পোশাকের দখলে।

এবার সে ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে এসেছে জনপ্রিয় হিন্দি সিনেমা ‘বাজিরাও মাস্তানি’ নামের ড্রেস। তার সাথে চলছে বাংলা টিভি সিরিয়াল রাখি-বন্ধন নামের ড্রেস। বেশিরভাগ শপিংমলেই শোভা পাচ্ছে লং গাউনের মতো দেখতে ‘বাজিরাও মাস্তানি’। ক্রেতা বিক্রেতাদের ধারণা, এবারের ঈদ বাজারে মেয়েদের পোশাক হিসেবে মার্কেট মাতাতে এসেছে ফ্যাশানেবল এ ড্রেসটি। তরুণীদের পাশাপাশি মধ্যবয়সী নারী ক্রেতাদেরও দৃষ্টি কাড়বে আকর্ষণীয় ড্রেসটি। ইতোমধ্যে এমন সাড়াই পাচ্ছেন বিক্রেতারা। জানা গেছে,এক দিকে চোরাই পথে আসছে নিম্মমানের ভারতীয় পোশাক। অন্যদিকে ঈদ বাজারের নামে ভারতে পাড়ি জমাচ্ছেন অনেকে। এবছর শুধু ঈদ কেনাকাটা করতে ভারতের কলকাতা, দিল্লি এবং বোম্বে গিয়েছেন প্রায় দুই লাখ বাংলাদেশী। বাংলাদেশের ঈদ বাজারের সিংহভাগই ভারতের দখলে। সরকারের পৃষ্টপোষকতা না পাওয়ার কারণেই দেশের পোশাক শিল্পের বাজার সংকুচিত হয়ে আসছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে ইসলামপুর এবং গাউসিয়ার অধিকাংশ পাইকারি ব্যবসায়ীরা ঈদ এলেই ভারত থেকে নিম্মমানের চাকচিক্ক বাহারি রংগের পোশাক আমদানি করে থাকেন। এসব কাপড়ের দাম যেমন বেশি তেমনি টেকসইও কম। তারপরেও প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকার নি¤œমানের পোশাকের মাধ্যমে ভারতে চলে যাচ্ছে। অথচ আমাদের দেশের তাঁত এবং জামদানির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে ভারতে। কিন্তু ভারত সরকার তা রফতানি করতে দিচ্ছে না। এব্যাপারে তাদের সীমান্ত বাহিনী বিএসএফকে বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

এসব পোশাক ছাড়াও রয়েছে পুরুষদের জন্য রেমন্ড, বেলমন্ড, অরবিন্দ, ধুতি প্রভৃতি নামে ভারতীয় কাপড়। অথচ এসব কাপড় চাকচিক্ক আর রং দেখে ক্রেতা আকৃষ্ট হলেও গুণগত মান খুবই নিম্ম। ৩ হাজার-১০ হাজার টাকায় ক্রয় করা এসব কাপড় এক বছরও পরা যাচ্ছে না। তার পরেও এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী দেশের ক্ষতি করে সীমান্ত দিয়ে এসব নিম্মমানের কাপড় আমদানি করছে। অথচ আমাদের দেশে রয়েছে অনেক মানের কাপড়। এসব কাপড়ের ভিড়ে হারিয়ে গেছে বাংলাদেশী এশিয়ান টেক্সটাইল, বেক্সিমকো, পাকিজা, মদিনার গুণগত মানের কাপড়। প্রতি নিয়ম সীমান্ত দিয়ে ভারতীয় কাপড় প্রবেশ করলেও সরকার কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। অথচ প্রতি দিনই সীমান্তে গরুর ব্যবসায়ীদের গুলী করে মারা হচ্ছে। কিন্তু গত ৪৪ বছরেও বিএসএফের গুলীতে একজন কাপড় চোরাই চালানকারি মারা গেছে বলে জানা নেই।

রাজধানী অভিজাত শপিংমল বসুন্ধরা সিটি কমপ্লেক্সের লেবেল-টুতে গিয়ে চোখ আটকে স্বাভাবিকভাবেই। যেদিকেই চোখ যায় শুধু শোভা পাচ্ছে ভারতীয় পোশাকগুলো। এবারের ঈদ উপলক্ষে নতুন ড্রেস কালেকশনে বাজিরাও মাস্তানি’র সাথে আরও রয়েছে, সারাহ, জারা নামে ভারতীয় দু’টি লং ড্রেস। এছাড়া গত ঈদে বের হওয়া বাহুবলী, কিরণমালা, ঈশিতা ও ফ্লোরটাচ গাউন তো আছেই।

দাম সম্পর্কে জানতে চাইলে বিক্রেতারা জানান, বাজিরাও মাস্তানি ড্রেসটি পাওয়া যাচ্ছে সাড়ে ৫ হাজার টাকা থেকে ১৫ হাজার টাকার মধ্যে। এছাড়া জারা, সারাহ নামের ড্রেসগুলো বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত। এর পাশাপাশি স্বল্প দামে ক্রেতা ধরে রাখতে কিছু ভিন্ন পোশাকও রাখা হয়েছে বলে জানান রাজধানীর নিউমার্কের্টের পোশাক ব্যবসায়ী মো. শফিকুল।

শপিং করতে আসা সুইটি বলেন, ঈদে একটু গর্জিয়াস ড্রেসগুলোই সবাই পছন্দ করে। আমি সাধারণত ঈদে জমকালো সাজতে পছন্দ করি। সে ক্ষেত্রে ভারতীয় ড্রেসগুলো বেশ উপযোগী। এবার বাজিরাও মাস্তানি ড্রেসটি বেশ পছন্দ হয়েছে। তবে প্রাইসটি একটু বেশি মনে হচ্ছে।

বড়দের পাশাপাশি ছোটদের জন্যও শুধু ‘মাস্তানি’ নামে বের হয়েছে এটির আরেকটি মডেল। ড্রেসটি শিশুদের জন্য ৫-পিচ হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে। ড্রেসটি আড়াই হাজার টাকা শুরু করে ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে বলে জানালেন বিক্রেতারা।

ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে বাংলাদেশের সীমান্ত দিয়ে বিপুল পরিমাণে ভারতীয় শাড়ি এবং থ্রি পিস আসছে। ভারতের কাপড়ের ব্যাপক চাহিদা থাকায় বিভিন্ন রুটে অবৈধ ভাবে আসছে এসব কাপড়। বৈধ আমদানীর চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ভারতীয় কাপড় অবৈধ পথে ঢুকছে বাংলাদেশের বাজারে। এর সাথে আসছে বিপুল পরিমাণে মাদকদ্রব্যও। সিলেট বিভাগের প্রায় ৭০০ কিলোমিটার সীমান্তের শতাধিক রুট দিয়ে চোরাকারবারীরা ভারতীয় কাপড় নিয়ে আসছে। সীমান্ত অতিক্রম করার পরে চোরাকারবারীরা ট্রাক, মাইক্রোবাস, টেম্পো ও ট্রেনে করে এসব কাপড় সিলেট নগরীসহ বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দিচ্ছে। সীমান্ত পার হওয়ায় পরে এসব কাপড় দোকানদার মহাজনদের কাছে পৌছে দেয়ার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে শিশু ও মহিলাদের। তারা ১০০ থেকে ২০০ টাকার বিনিময়ে এসব কাপড় বহন করে থাকে। ।

সম্প্রতি সিলেট রাজশাহী সীমান্তে বেশ কিছু পরিমাণে অবৈধ চোরাই কাপড়ের চালান আটক করা হলেও মূলহোতারা রয়ে যাচ্ছে ধরাছোয়ার বাইরে। প্রতিবছরই ভারতীয় শাড়ি ত্রি -পিস সিলেট সীমান্ত দিয়ে আসলেও এবার বেশি উদ্বেগের বিষয় হল এসব কাপড় এখন আর শুধু স্থানীয় বাজারে বিক্রি হয় না, সিলেটের নামীদামী বিপনী বিতানগুলোতে পর্যন্ত ছেয়ে গেছে ভারতীয় চোরাই কাপড়ে। এই কাপড় ছড়িয়ে পড়ছে ঢাকানহ সারা দেশ। এবছর ভারতীয় পোষাক সবচেয়ে বেশি বাজার দখল করেছে সিলেট এবং রংপুরের বাজার।

চোরাইপথে আসা ভারতীয় কাপড়ে বাংলাদেশের বাজার যখন সয়লাব তখন এদেশের পোশাক শিল্প মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে অভিযোগ পোষাক শিল্প মালিকদের। সিরাজগঞ্জ, শাহজাদপুর এলাকার তাঁতশিল্পীদের অভিযোগ, ভারতীয় কাপড় কম দামে এদেশের বাজারে আসায় তাদের উতপাদিত পণ্যের কদর কমে যাচ্ছে। ভাল মানের পণ্য হলেও ক্রেতারা কমদামে চকচকে জিনিস কিনছেন বলে অভিযোগ তাদের। ফলে অনেকের বাপ-দাদার পেশা পরিবর্তন করতে হচ্ছে। ছেড়ে দিচ্ছেন তারা তাতেঁর কাজ। একই সাথে বুটিক শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের অভিযোগ ভারতীয় চোরাই কাপড়ে দাপটে তাদের বাজারও সংকুচিত। এ প্রসঙ্গে তৈরী পোষাক শিল্পমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ'র সাবেক সভাপতি আনোয়ারুল পারভেজ চৌধুরী বলেন, সীমান্ত বন্ধ করা না গেলে এ ধরনের পণ্য আসা যাওয়া করবেই। আর সীমান্ত কখনো বন্ধ করে দেয়া যাবে না। কিন্তু যদি এসব পণ্য আসা যাওয়ার ক্ষেত্রে শুল্ক আরোপ করে নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসা যায় তখন এ থেকে সরকার যেমন লাভবান হবেন, ঠিক তেমনি ক্রেতাসাধারণও লাভবান হবেন। কারণ এখন যে শাড়িটি সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে আনতে দুই তিন ধাপে টাকা দিতে হচ্ছে। তখন শুধু একটি ধাপে শুল্ক দিয়ে পণ্যটি আনলে আর ঐ বাড়তি খরচ পোহাতে হবে না। তাই সরকারকে সীমান্তে এধরনের পণ্য আনা নেয়ার বিষয়ে শুল্ক আরোপ করে তা কঠোর মনিটরিং এর আওতায় নিয়ে আসতে হবে বলে মনে করছেন পোশাক শিল্প সংশ্লিষ্টরা।

http://www.dailysangram.com/post/289397-