২৫ জুন ২০১৭, রবিবার, ১২:৩৬

উচ্চমূল্যের ফাঁদে আটকে গেছে নিম্ম আয়ের মানুষের ঈদ আনন্দ

ঈদের বাকি আর মাত্র এক দুই দিন। শেষ সময়ের কেনাকাটায় ব্যস্ত নগরবাসি। ইতোমধ্যে স্বজনদের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করতে নাড়ির টানে ঢাকা ছাড়তে শুরু করেছেন নগরবাসী। তারপরও রাজধানীতে ঈদের কেনাকাটা কমেনি। শপিং মলগুলোতে ভিড় খুব বেশি না থাকলেও বিভিন্ন ছোটখাট মার্কেট ও ফুটপাতের দোকানে বিক্রেতারা দম ফেলারও সময় পাচ্ছেন না। তবে উচ্চমূল্যের ফাঁদে আটকে গেছে নিম্ন আয়ের মানুষের ঈদ আনন্দ।
জানা গেছে, ঈদকে কেন্দ্র করে বেড়েছে আরেক দফায় প্রায় সব পণ্যের দাম। তার সাথে যুক্ত হয়েছে ঈদের পোশাক ক্রয়। অভিযোগ রয়েছে ভারতীয় তৈরি পোশাকের চাহিদা বেশি হওয়ার কারণেই দোকানিরা নতুন করে মূল্য ট্যাগ জুড়ে দিয়েছেন। গত সপ্তাহেও যে পোশাকের দাম ছিল ২ হাজার টাকা এখন সে পোশাকে দাম করা হয়েছে। শুধুমাত্র একটি মূল্য ট্যাগ যুক্ত করেছে তারা।
গত দুই মাস ধরে বন্যার কারণে হাওরাঞ্চলের লোকেরা রয়েছে অতি কষ্টে। তারা দু’বেলা খেতেই পাচ্ছে না। তার সাথে এখন এসেছে ঈদ। ঈদে কেনাকাটা করার মত কোন সামর্থ নেই তাদের। তার সাথে নতুন করে বেড়েছে সেমাই, চিনিসহ সব ধরনের মসলার দাম। বেড়েছে আরেক দফায় পোলাও চালের দাম। সব মিলিয়ে নিম্ম আয়ের মানুষদের জন্য ঈদ কেনাকাটা একটি গলার ফাঁস।
শনিবার সরেজমিনে রাজধানীর নিউমার্কেট, এলিফ্যান্ট রোড, গাউছিয়া, রাপা প্লাজা, ফার্মগেট, গুলিস্তানসহ বেশ কিছু এলাকা ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
নিউমার্কেটে বাজার করতে আসা বেসরকারি চাকরিজীবী বোরহান উদ্দিন জানান, চার ভাই-বোনের মধ্যে তিনি বড়। তাই সবার চেয়ে তার দায়িত্বটাও বেশি। প্রথম রোজা থেকেই সবার জন্য নতুন পোশাক কেনা শুরু করেছেন। তারপরও যেন কেনাকাটা শেষ হতেই চায় না। আজ সর্বশেষ দুই বছরের ভাগ্নির জন্য পোশাক কিনতে এসেছেন। দাম বেশি দেখে এক মার্কেট থেকে অন্য মাকেটি ঘুরছি। কিন্তু কোন লাভ নেই। সব মার্কেটেই দাম বাড়তি। গত সপ্তাহে যে পোশাকে দাম ছিল ২ হাজার টাকা এখন সে পোশাকে দাম ৩ হাজার টাকা। এক সপ্তাহে শুধু মূল্য ট্যাগ পরিবর্তন করা হয়েছে। অথচ এগুলো দেখার কেউ নেই।
নিউমার্কেটের নিউ এরা দোকানের ম্যানেজার সেলিম আহমেদ জানান, সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত দোকানে প্রচুর ক্রেতা। তবে সন্ধ্যার পর ফের ক্রেতা বাড়ার আশা প্রকাশ করেন তিনি। এসময় নতুন করে পোশাকে দাম বৃদ্ধির কথা অস্বীকার করেন তিনি।
কিন্তু ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে ক্যাটস আইয়ের একটি শো-রুমে। সেখানে তেমন ক্রেতার ভিড় চোখে পড়েনি। এ বিষয়ে ক্যাটস আইয়ের ম্যানেজার আমিনুল ইসলাম বলেন, প্রথম রোজা থেকেই বেশ ভালো বেচাকেনা হয়েছে তবে আজকে ক্রেতার সংখ্যা কম।
একই অবস্থা দেখা গেছে ধানমন্ডি ২৭ নম্বরের রাপা প্লাজা ও জেনেটিক প্লাজায়। এ মার্কেটগুলোতে ক্রেতার সংখ্যা তুলনামূলক কম। রাপা প্লাজার ৪র্থ তলায় নারী পোশাকের শো-রুম জয়িতার বিক্রয় প্রতিনিধি সালমা আক্তার বলেন, এবার ঈদ উপলক্ষে বেচা-বিক্রি তেমন হয়নি। আজ সকাল থেকেও তেমন বেচাকেনা নেই।
ঈদের সপ্তাহখানেক আগে ক্রেতাদের উপস্থিতিতে সরগরম রাজধানীর মার্কেটগুলো, তবে চড়ার বাজারে পছন্দে লাগাম টানার কথা বলেছেন অনেকে। তারা বলছেন, নিত্যপণ্যের ক্রমবর্ধমান বাজারমূল্যের সাথে আয় না বাড়ায় সংসার চালাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। এরইমধ্যে পোশাক, জুতাসহ অন্যান্য বিলাসী সামগ্রীর দাম বাড়ায় ঈদ কেনা-কাটার চাহিদায় কাটছাট করতে হচ্ছে।
আবার অনেকের অভিযোগ, সকালে কেনা-কাটা করতে বেরুলে বিকালে তীব্র যানজট পেরিয়ে ফিরতে হয় গন্তব্যে। আর সন্ধ্যার পর বের হওয়ার মতো সময়ও থাকে না অনেকের, অন্যদিকে বাইরে ইফতার করতে গেলে গলাকাটা দামের ভয়ে অধিকাংশ ক্রেতাই সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরতে চান। সময়ের এই হিসেব আবার গুলিয়ে যাচ্ছে বৈরী আবহাওয়ায়।
এর বাইরে বিভিন্ন মার্কেটে ইফতারের অতিরিক্ত দাম, যানজট এবং যখন-তখন বৃষ্টিতে এবার পছন্দমতো ঈদের কেনাকাটায় বিঘ্ন ঘটার কথা বলেছেন অনেকে।
বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্স, ধানমন্ডির মেট্রো শপিং মল, রাইফেলস স্কয়ার, রাপা প্লাজা, সানরাইজ প্লাজা, অর্কিড প্লাজা, প্লাজা এ. আর, মিরপুর ১ নম্বরের শাহ আলী প্লাজা, স্বাধীন বাংলা সুপার মার্কেট, মুক্তিযোদ্ধা সুপার মার্কেট এবং মিরপুর-২ নম্বরের মিরপুর শপিং সেন্টার ও বিভিন্ন পোশাকের দোকান ঘুরে দেখা যায়, শেষদিকে এসে ‘রেডিমেড’ কাপড় আর জুতা-কসমেটিকস-জুয়েলারির দোকানগুলোতে উপচেপড়া ভিড়।
দুই ছেলেকে নিয়ে মিরপুর শপিং কমপ্লেক্সে কেনাকাটা করতে আসা শামসুন্নাহার বলেন দু-তিন দিন ধরে কেনাকাটা করছি, কিন্তু এখনও শেষ করতে পারিনি। কাল দিনটাই সময় আছে হাতে। দাম বেশি হওয়ার কারণেই পছন্দের কাপড় কেনা যাচ্ছে না।
দয়াগঞ্জ থেকে বসুন্ধরায় কেনাকাটা করতে আসা ফাতেমা জোহরা হক মেয়ের জন্য ড্রেস কিনতে ঢোকেন ‘লি পিংক প্লাস’-এ। দোকানি এর দাম চাইছিলেন সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা। এত দামে কিনতে নারাজ জোহরা। তাই পোশাকটি না কিনেই বেরিয়ে যান তিনি।
১২ বছরের বাচ্চার জন্য সাড়ে ৫ হাজার টাকা দিয়ে জামা কিনব? একজনের জামায় যদি সাড়ে ৫ হাজার টাকা চলে যায়, তাহলে সবার জন্য কাপড় কিনব কী করে? বলেন তিনি।
মেট্রো শপিং মলে ঈদের কেনাকাটা করতে আসা আশিতা ইসলামও বলছেন, গত বছরের চেয়ে এবার পোশাকের দাম বেড়েছে। তিনি বলেন, গতবারের চেয়ে সব কিছুর দামই কিছুটা বেশি। ক্যাটালগের ড্রেসগুলো গতবার যে দামে কিনেছি, এবার তার চেয়ে বেশি দামে কিনতে হয়েছে। অর্নামেন্টস, কসমেটিকস সব কিছুরই দাম বেশি।
চাল-ডালের দাম যেভাবে বাড়ছে, সংসার চালানোই তো দায়। পছন্দ অনুযায়ী এখন চাইলেই হুট করে কিছু কেনা যায় না। ঈদে বাসার নতুন পর্দা কিনলাম, সেগুলোরও দাম বেড়েছে।
স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বসুন্ধরায় আসা শামীম খন্দকার বলেন যানজটে ভোগান্তিদর কথা: দুই ঘণ্টা জ্যাম পেরিয়ে কচুক্ষেত থেকে এসেছি। বৃষ্টির কারণে তো শপিং করতে দেরি হয়ে গেল। আর ইফতারের আগে তো বাসায় পৌঁছানোও যাবে না। এখানে খাবারের যা দাম! খাবারও তো ভালো না। চারজন খেলে দেড়-দুই হাজার টাকা খরচ হয়ে যাবে। আমাদের মতো সীমিত আয়ের মানুষের চলাটা কষ্টকর।
রাজধানীর বাজার জুড়ে ঈদের কোনই সুখবর নেই, বরং উচ্চমূল্যের ফাঁদে আটকে গেছে নিম্ন আয়ের মানুষের আনন্দ। নতুন করে দাম বাড়ার তালিকায় যোগ হয়েছে, বিভিন্ন মসলা, চিনি, সেমাইয়ের মত পন্য। মাছ-মাংসও বেচাকেনা চলছে বাড়তি দামে। কমেনি চালের দামও।
কোনো ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট নেই তারপরও, বাঙ্গালীর ঈদের সাথে সেমাইয়ের সম্পর্ক অঙ্গাঅঙ্গি। সারা বছর এই মিস্টান্নের চাহিদা তেমন একটা না থাকলেও ঈদের আগে সবার কেনাকাটার তালিকায় সেমাই থাকবেই।
এমন বাহারি রংয়ের সেমাই তাই ঈদের আগের বাজারের সবচেয়ে চাহিদার পণ্য। তাই হুট করেই বেড়েছে সেমাইয়ের দাম। সেই সাথে চিনি, গুড়াদুধ, কিসমিসের মত পণ্যের দামও বেশি। দীর্ঘদিন ধরে বাড়তে থাকা মাংশের দামে যেনো আগুন লেগেছে আরেক দফায়। সিটি করপোরেশনের দাম মানার বালাই নেই কারো। এছাড়া, খাশি ও মুরগি মাংস যাই হোকনা কেনো, কিনতে হচ্ছে বাড়তি দামে।
এদিকে, সরকারের ভর্তুকির কোনো প্রভাব নেই চালের বাজারে। বরং ঈদ উপলক্ষে আরেক দফা বেড়েছে পোলও চালের দাম। বিক্রেতাদের আভাস, ঈদের পর কিছুটা কমতে পারে চালের দাম।

http://www.dailysangram.com/post/289480-