২৪ জুন ২০১৭, শনিবার, ১২:০৯

৫ বছরে আগুনে ক্ষতি ২ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা

আধুনিক জীবনে দিন দিন বাড়ছে আগুনের ব্যবহার। সেই সঙ্গে বাড়ছে অনিয়ন্ত্রিত অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাও। নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া ভয়াল আগুনে প্রতিদিনই বাড়ছে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ। দীর্ঘতর হচ্ছে হতাহতের পরিসংখ্যান। অগ্নিনির্বাপণের দায়িত্বে নিয়োজিত রাষ্ট্রীয় সংস্থা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের পরিসংখ্যানেই গত পাঁচ বছরে সারা দেশে ৮৭ হাজার ৫৯৩টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৮৫৮ কোটি টাকা। কিন্তু ক্ষতির প্রকৃত পরিমাণ এর বেশি বলে দাবি একাধিক মহলের। তবে অসচেতনতাসহ নানা কারণে অগ্নিকাণ্ড ও ক্ষয়ক্ষতি বাড়লেও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিলে তা

কমানো সম্ভব বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপপরিচালক (অপারেশনস) দেবাশীষ বর্ধন মানবজমিনকে বলেন, সারা দেশে আমাদের ৩২৩টি ফায়ার স্টেশনের আওতাভুক্ত এলাকায় সংবাদ পাওয়া অগ্নিকাণ্ডের হিসাবে এ পরিসংখ্যান তৈরি হয়েছে। এর বাইরে যেখানে ফায়ার স্টেশন নেই এবং অগ্নিকাণ্ডের সংবাদ পাওয়া যায়নি সেসবের হিসাব তো এর মধ্যে আসেনি। সচেতনতা ও অগ্নিকাণ্ডের কারণগুলো চিহ্নিত করে অগ্নি প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং প্রশিক্ষণসহ নির্বাপণের সরঞ্জাম রাখলে আগুনে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমবে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সূত্রে জানা যায়, প্রতিদিন নানা কারণে দেশের কোথাও না কোথাও আগুনের দুর্ঘটনা ঘটছে। রাজধানী ও বিভাগীয় শহর থেকে শুরু করে গ্রামগঞ্জে আগুনে পুড়ছে ঘরবাড়ি, দোকানপাট, অফিস-আদালত। দগ্ধ হয়ে হতাহত হচ্ছে মানুষ ও জীবজন্তু। দেশে ৮০-এর দশকের পর থেকে ক্রমেই বাড়ছে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। ৯০-এর দশক পরবর্তী সময়ে তা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। আগুন মুহূর্তেই কেড়ে নিচ্ছে মানুষের প্রাণসহ সর্বস্ব। সহায় সম্বল হারিয়ে পথে বসছে মানুষ। সাধারণত অসাবধানতা, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট, চুলা বা রান্নাবান্নার যন্ত্র, আগুনের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার, রাসায়নিক দ্রব্য, বিস্ফোরণ, আতশবাজি, বিভিন্ন বৈদ্যুতিক ও স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি, কলকারখানা বা পোশাক কারখানার যন্ত্রপাতি, আগুন নিয়ে খেলা, মশার কয়েল, সিগারেট, গোয়ালঘরের ধোঁয়ার কুণ্ডলী, যান্ত্রিক গোলযোগ, দুর্ঘটনা, নাশকতা ইত্যাদি থেকে আগুন লাগছে। সেই আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। গ্রাস করছে বাড়িঘর ও দোকানপাট। বাড়ছে ক্ষয়ক্ষতি। এছাড়া আগুনে ক্ষয়ক্ষতির আরো বেশ কিছু কারণ রয়েছে।
এর মধ্যে বড় বড় অগ্নিকাণ্ডের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সবাইকে নাড়া দেয়। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি দেশের অর্থনীতিকেও ঠেলে দেয় হুমকির মুখে। জাতিকে হতবাক করে দিচ্ছে ব্যাপক প্রাণহানির ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডগুলো। এই তো ২০১৭ সালই শুরু হয়েছে বড় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা দিয়ে। এ বছরের ২রা জানুয়ারি গুলশান-১-এ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন মার্কেটে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এতে কাঁচা মার্কেট অংশের ৩৭১টি দোকান পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। পাকা মার্কেট অংশের ২৩৪টি দোকানও ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়। ফায়ার সার্ভিসের ২২টি ইউনিট ১৬ ঘণ্টা চেষ্টার পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আনলেও এতে শত কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি ব্যবসায়ীদের। এক মাস আগেই গত ২৬শে মে আগুনে ক্ষতির মুখে পড়ে নীলক্ষেতের বই মার্কেট। গত ২৩শে মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৪ তলায় আগুন লেগে মাত্র ১ ঘণ্টায় পুড়ে গেছে ৮০ লাখ টাকার মালামাল। এর আগে ১৫ই মার্চ কাড়াইল বস্তি পুড়ে নিঃস্ব হয়েছে প্রায় অর্ধেক বস্তিবাসী। এছাড়া ২০১০ সালের ৩রা জুন পুরান ঢাকার নিমতলী বস্তিতে আগুনে ১১৯ ও ২০১২ সালের ২৪শে নভেম্বর আশুলিয়ার তাজরিন গার্মেন্টে জীবন্তদগ্ধ হয়ে ১১৫ জনের প্রাণহানিসহ বেশ কয়েকটি ঘটনা এখনো দগদগে ট্র্যাজেডি। ১৯৯৫ সালে বঙ্গবাজার পুড়ে ব্যবসায়ীদের ক্ষতি গুনতে হয়েছে প্রায় ৫৩ কোটি টাকা। এভাবে আগুনে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কেবলই বাড়ছে।
ফায়ার সার্ভিসের হিসাবে, ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৫ বছরে দেশে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ৮৭ হাজার ৫৯৩টি। এতে সম্পদহানিতে আনুমানিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৮৫৮ কোটি ৮১ লাখ ৮২ হাজার ৫২৯ টাকা। সে হিসাবে প্রতিবছর দেশে গড়ে ১৭ হাজার ৫১৮টি ছোট-বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটছে। আর দিনে ঘটছে ৪৮টি মতো অগ্নিকাণ্ড। এর মধ্যে ২০১২ সালে ১৭ হাজার ৫০৪টি আগুনে ৪৮২ কোটি, ২০১৩ সালে ১৭ হাজার ৯১২টি দুর্ঘটনায় ৭৭৯ কোটি, ২০১৪ সালে ১৭ হাজার ৮৩০ অগ্নিকাণ্ডে ৩৫৯ কোটি এবং ২০১৫ সালে ১৭ হাজার ৪৪৮ অগ্নিকাণ্ডে ৮৫৬ কোটি টাকার সম্পদহানি ঘটে। সর্বশেষ গত বছর ১৬ হাজার ৭৯৮টি অগ্নিকাণ্ডের খবর পাওয়া গেছে। এতে ক্ষতি হয়েছে ৩৮৪ কোটি টাকা। আর উদ্ধার হয়েছে ১ হাজার ৪৬৬ কোটি টাকার সম্পদ। ওই বছর ৪৪৫ জনের প্রাণহানি ঘটে। আহত হন ৩ হাজার ৩১৪ জন। তবে ওই পাঁচ বছরে উদ্ধারের পরিমাণ এর সোয়া তিনগুণ। ৯ হাজার ৪০৪ কোটি টাকার বেশি। একই সময়ে আগুনে নির্মম মৃত্যুর শিকার হয়েছেন ১ হাজার ৩৮৫ জন। আহত হন ৪ হাজার ৪২৮ জন মানুষ।
একাধিক দমকল কর্মীসহ সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আগুনে ক্ষয়ক্ষতি বাড়ার বেশ কিছু কারণ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, আগুন দেখার পর ভয় পেয়ে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়া, সাধারণ মানুষের প্রয়োজনীয় সচেতনতার অভাব, দক্ষতা ও প্রশিক্ষণ না থাকা, বাসা ও দোকানে নির্বাপণ সরঞ্জাম না রাখা, রাজধানীসহ বিভাগীয়, জেলা ও পৌর শহরসহ ঘটনাস্থলের পাশে জলাধার না থাকা, দেশে পর্যাপ্ত ফায়ার সার্ভিস স্টেশন, গাড়ি ও যন্ত্রপাতি না থাকা, বায়ুপ্রবাহ, অগ্নিকাণ্ড নির্বাপণে নানা অসুবিধা, বিল্ডিং কোড না মেনে বাড়ি নির্মাণ, যানজটের কারণে ঘটনাস্থলে পৌঁছতে বিলম্ব ইত্যাদি কারণে আগুন দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয় না। বিলম্ব হয় নির্বাপণ কাজ শুরুতেও। অনেক ক্ষেত্রে আগুন ছোট পরিসরে থাকতে নেভানোর কাজও শুরু করা যায়না। স্থানীয়দের অদক্ষতাও এক্ষেত্রে দায়ী। ফলে আগুন যেমন আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে, তেমনি সবকিছু পুড়ে ছাই করে দেয়। এতে ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয় ভুক্তভোগীরা।
ফায়ার সার্ভিসের অপারেশন বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, আগুন নির্বাপণে সাধারণ মানুষের প্রয়োজনীয় সচেতনতা ও দক্ষতা তৈরি করা গেলে আগুনে ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি কমানো সম্ভব। দেশে ফায়ার সার্ভিস স্টেশন, দমকলকর্মীর স্বল্পতা এবং সরঞ্জামের অভাবও ক্ষয়ক্ষতি বাড়ার অন্যতম কারণ। তবে প্রশিক্ষণসহ ঘরে ঘরে ও দোকানে দোকানে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা রাখলে ক্ষতি কমবে। তবে প্রতিরোধের চেয়ে প্রতিকারই উত্তম বলে মত দেন তিনি।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=71415&cat=3/