২৪ জুন ২০১৭, শনিবার, ১১:৫৭

মানবজাতির হেদায়েত ও পথনির্দেশক হিসেবে মহাগ্রন্থ আল কুরআনের তাৎপর্য

|| ড. মো: মোবারক হোসাইন : ॥ ২ ॥

৫. হেদায়েত লাভের জন্য কুরআন শিক্ষা : কুরআনের মাধ্যমেই হেদায়েতের সন্ধান পাওয়া যাবে। সে জন্য কুরআন থেকে হেদায়েত পাবার জন্য কুরআন শিক্ষা করতে হবে। কুরআনে বলা হয়েছে, “নিশ্চয় এ কুরআন এমন পথ-প্রদর্শন করে, যা সর্বাধিক সরল ও সঠিক।” (সূরা বনি ইসরাইল : ৯)
কুরআন শিক্ষা ও তেলাওয়াত বা কুরআন চর্চার গুরুত্ব ও ফজিলত :
কুরআনে কারিম মানবজাতির জন্য আল্লাহ্র এমন এক বড় নিয়ামত। পৃথিবীর অন্য কোনো নিয়ামত, অর্থসম্পদ কোনো বস্তুই এর সমকক্ষ হতে পারে না। কুরআনের তেলাওয়াত, শোনা ও শোনানো, শিখা ও শিখানো, এর ওপর আমল করা, তা প্রচার ও প্রসার করা, এসবই মানুষের দুনিয়া ও আখিরাতের মহাকল্যাণ ও সৌভাগ্য লাভের উপায়। হযরত উক্ববা ইবনে আমির (রা:) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা:) বললেন, যদি প্রতিদিন কোনো বইক্ত মসজিদে গিয়ে যে কোনো দু’টি আয়াত শিখে নেয় বা পড়ে নেয়, তাহলে এটা তার জন্য দু’টি উটনী পাওয়ার চেয়েও উত্তম। তিনটি আয়াত শিখলে তিনটি উটনীর চেয়ে আর চারটি আয়াত শিখলে চারটি উটনী পাওয়ার চেয়ে উত্তম।” (সহীহ্ মুসলিম, হাদিস নং৮০৩ প্রত্যেক মুসলমানের প্রচুর পরিমাণে কুরআন তেলাওয়াতে মনোযোগী হওয়া অতি জরুরি। রমজান মাসে হযরত জিবরাইল (আ:) নবী করীম (সা:) এর সঙ্গে ‘দাওর’ করতেন, পূর্ণ কুরআন একে অপরকে শুনাতেন। হযরত উসমান (রা:) প্রতি রাত্রে কুরআন এক খতম করতেন। ইমাম আবু হানিফা (রহ:) রমজানে ৬১ বার কুরআন খতম করতেন। ইমাম আযম আবু হানিফা (রহ:) রমজানের ত্রিশ দিনে ত্রিশ খতম, ত্রিশ রাত্রে ত্রিশ খতম ও তারাবিতে এক খতম মোট ৬১ খতম করতেন। ইমাম শাফেয়ী (রহ:) নামাজের বাইরে ৬০ বার কুরআন খতম করেছেন।
১. কুরআন তেলাওয়াত আল্লাহর সাথে একটি লাভজনক ব্যবসা: কুরআন তেলাওয়াত আল্লাহর সাথে একটি লাভজনক ব্যবসা। বিভিন্ন ব্যবসায় লাভ এবং ক্ষতি দু’টিরই সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু এখানে লাভ ছাড়া কোন প্রকার ক্ষতির অংশ নেই। এ বিষয়ে আল্লাহ্ তাআলা বলেন, “যারা আল্লাহর কিতাব পাঠ করে, সালাত কায়েম করে, আমার দেয়া রিজিক থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে ব্যয় করে, তারাই আশা করতে পারে এমন ব্যবসার যা কখনো ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। কারণ আল্লাহ্ তাদের কর্মের পূর্ণ প্রতিদান দেবেন এবং নিজ অনুগ্রহে আরো অধিক দান করবেন। তিনি ক্ষমাশীল ও দয়াবান।’’ (সূরা ফাতির ২৯-৩০)
২. কুরআন পাঠকারী প্রত্যেক হরফের জন্য সওয়াব লাভ করে : কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে বিরাট সওয়াব অর্জন করার সুযোগ রয়েছে। এর সাথে অনেক উপকারিতাও রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, “যে ব্যক্তি কুরআনের একটি হরফ পাঠ করে, তাকে একটি নেকি প্রদান করা হয়। প্রতিটি নেকি দশটি নেকির সমান। আমি বলি না যে, আলিফ-লাম-মিম একটি হরফ। বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ, মিম একটি হরফ।” (সুনান আত-তিরমিযি : ২৯১০)
৩. কুরআনের শিক্ষার্থী ও শিক্ষক সর্বোত্তম ব্যক্তি: কুরআন শিক্ষার মাধ্যমে দুনিয়া ও আখেরাতে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করা যায়। উসমান (রা:) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি সেই যে নিজে কুরআন শিক্ষা করে ও অপরকে শিক্ষা দেয়।” (বুখারী : ৫০২৭)
৪. কুরআন তেলাওয়াতকারীর পক্ষে সুপারিশ করবে: কিয়ামতের ভয়াবহ অবস্থায় কুরআন তেলাওয়াতকারীর পক্ষে সুপারিশ করবে। এটা বিরাট সৌভাগ্যের বিষয়। আবু উমামাহ (রা) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা:) বলেছেন, “তোমরা কুরআন তেলাওয়াত কর, কারণ, কুরআন কেয়ামতের দিন তেলাওয়াতকারীর জন্য সুপারিশ করবে।” (মুসলিম : ১৯১০)
৫. কুরআন তেলাওয়াত ঈমান বৃদ্ধি করে: কুরআন তেলাওয়াত বান্দাহর জন্য এমন উপকারী যে, তা তেলাওয়াত করলে ঈমান বৃদ্ধি পায়। এ বিষয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন, “মুমিন তো তারা, যাদের অন্তরসমূহ কেঁপে ওঠে যখন আল্লাহকে স্মরণ করা হয়। আর যখন তাদের ওপর তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করা হয় তখন তা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করে এবং যারা তাদের রবের ওপরই ভরসা করে।” (সূরা আনফাল : ২)
৬. আল-কুরআন মানুষকে শান্তি, স্বস্তি এবং নিরাপত্তা দিতে সক্ষম: যে ভূখণ্ডে আল কুরআন প্রতিষ্ঠিত হবে, এ কুরআন সে ভূখণ্ডের লোকদেরকে পূর্ণ শান্তি, স্বস্তি দিতে সক্ষম। আমরা যদি ইতিহাসের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই, এ কুরআন যখন নাজিল হয়েছিল তখন সমগ্র পৃথিবী বিশেষ করে আরব জাতির অবস্থা ছিল চরম শোচনীয়, ধর্ম এবং নৈতিকতার সীমা ছাড়িয়ে তারা পশুর মত জীবন-যাপন শুরু করেছিল, অর্থনৈতিক দিক দিয়ে তারা হয়ে গিয়েছিল চরম দেউলিয়া, দারিদ্র্য তাদেরকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছিল, তাদের সমাজে কোন মানুষের নিরাপত্তা ছিল না। আল কুরআন তাদের জীবন এবং সমাজের আমূল পরিবর্তন ঘটালো, অবশেষে তারা হয়ে উঠল পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি, তাদের সমাজে মানুষের শান্তি, স্বস্তি এবং নিরাপত্তা ফিরে পেল, নারী তার সতীত্বের নিরাপত্তা পেল, অর্থনৈতিক ভাবে তারা পরিপূর্ণ সচ্ছল হয়ে উঠল এবং অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছাল যে তাদের সমাজে ভিক্ষা নেয়ার মত কোন মানুষ পাওয়া যেত না, কারণ আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, যদি কোন জনপদের লোকেরা ঈমান আনে এবং তাকওয়া অবলম্বন করে, তাহলে আসমান ও জমিনের বরকতের দরজা তাদের জন্য খুলে দেয়া হবে।
কুরআনের গবেষক :
আহনাফ ইবনে কায়েস। আরব মরুর এক জানবাজ মুজাহিদ। শৌর্য আর সাহসে তিনি ছিলেন এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। আরবি সাহিত্যেও তিনি ছিলেন এক উঁচু মাপের সমঝদার ব্যক্তি। আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র চেহারা মোবারক দেখার সৌভাগ্য তাঁর হয়নি। কিন্তু পেয়েছেন নবী (সা:)-এর হাতে গড়া বহু সাহাবীর একান্ত সান্নিধ্য। একদিন তার সামনে এক ব্যক্তি কুরআনের এই আয়াতটি পড়লেন: “আমি তোমাদের কাছে এমন একটি কিতাব নাজিল করেছি, যাতে তোমাদের কথা আছে, অথচ তোমরা চিন্তা গবেষণা করো না।” (সূরা আম্বিয়া : ১০) এই আয়াতটি তাঁকে যেন নতুন দিগন্তের দিকে আহবান জানালো। তিনি বুঝতে চেষ্টা করলেন, ‘যাতে শুধু তোমাদের কথাই আছে’ এই কথার অর্থ কী? তিনি চিন্তা করছিলেন আর অভিভূত হচ্ছিলেন। মনে হচ্ছিল কেউ যেন নতুন কিছু শোনাল। তিনি কুরআন নিয়ে বসে গেলেন। একে একে বিভিন্ন দল, গ্রুপের বর্ণনা তিনি পেতে শুরু করলেন। যেমন একদলে পরিচয় পেলেন, “এরা রাতের বেলায় খুব কম ঘুমায়, শেষ রাতে তারা আল্লাহর কাছে নিজের গুনাহ মাফের জন্য মাগফেরাত কামনা করে।” (সূরা যারিয়াত : ১৭-১৮) আবার একদলের পরিচয় পেলেন এভাবে, “তাদের পিঠ রাতের বেলায় বিছানা থেকে আলাদা থাকে, তারা নিজেদের প্রতিপালককে ডাকে ভয় ও প্রত্যাশা নিয়ে, তারা অকাতরে আমার দেয়া রিজিক থেকে খরচ করে।” (সূরা আস সাজদা : ১৬) কিছু দূর এগিয়ে যেতেই আবার পরিচয় পেলেন আরেক দলের। যাদের সম্পর্কে বলা হচ্ছে, “রাতগুলো তারা নিজেদের মালিকের সিজদা ও দাঁড়িয়ে থাকার মধ্য দিয়ে কাটিয়ে দেয়।” (সূরা আল ফুরকান : ৬৪) “যারা ব্যয় করে স্বচ্ছ এবং অস্বচ্ছল অবস্থায়, যারা রাগ সংবরণকারী এবং মানুষের প্রতি ক্ষমাশীল এবং কোমল, আল্লাহ তো কল্যাণকামীদের ভালবাসেন (সূরা আলে ইমরান ১৩৪)”। এরপর এলো আরেক দলের পরিচয়, “এরা (দুনিয়ার প্রয়োজনের সময়) অন্যদেরকে নিজেদেরই ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়, যদিও তাদের নিজেদের রয়েছে প্রচুর অভাব ও ক্ষুধার তাড়না। যারা নিজেদেরকে কার্পণ্য থেকে দূরে রাখতে পারে, তারা বড়ই সফলকাম।” (সূরা হাশর : ৯) অধ্যয়ন চলছে আর চিন্তার গভীরে ডুবে যাচ্ছেন আহনাফ। এবার পেলেন আরেক দলের পরিচয়, “এর বড় বড় গুনাহ থেকে বেঁচে থাকে, যখন এরা রাগান্বিত হয়, তখন (প্রতিপক্ষকে) মাফ করে দেয়, এরা আল্লাহর হুকুম মেনে চলে, এরা সালাত প্রতিষ্ঠা করে, এরা নিজেদের মধ্যকার কাজকর্মগুলোকে পরামর্শের ভিত্তিতে আঞ্জাম দেয়। আমি তাদের যা দান করেছি, তা থেকে তারা অকাতরে ব্যয় করে।” (সূরা আশ শুরা: ৩৭-৩৮) হযরত আহনাফ ছিলেন একজন আত্মবিশ্বাসী মানুষ। নিজের সম্পর্কে তাঁর ধারণা ছিল স্বচ্ছ। আল কুরআনে পাওয়া মুমিনদের পরিচয়ের সাথে তিনি নিজেকে মেলাতে পারলেন না। বরং বলেই ফেললেন: হায় আল্লাহ! আমি তো এই কুরআনের কোথাও ‘আমাকে’ খুঁজে পেলাম না। আমার কথা কোথায়? আমার চরিত্র তো কোথাও নেই? অথচ এ কুরআনে তো তুমি সবার কথাই বলেছো।
কিন্তু থামলেন না তিনি। বরং এগিয়ে চললেন নতুন উদ্যমে। এবার পেলেন আরও কতক মানুষের পরিচয়, যাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে- যখন তাদের বলা হয়, আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কোন মাবুদ নেই, তখন তারা গর্ব ও অহংকার করে বলে, আমরা কি একটি পাগল ও কবির জন্য আমাদের মাবুদদের পরিত্যাগ করবো?” (সূরা সাফফাত : ৩৫-৩৬) তিনি এগিয়ে চললেন, পেলেন আরেক দলের পরিচয়, “যখন এদের সামনে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা হয়, তখন এদের অন্তর অত্যন্ত নাখোশ হয়ে পড়ে, অথচ যখন এদের সামনে আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্যদের কথা বলা হয়, তখন অন্তর খুশিতে ভরে যায়।” (সূরা যুমার : ৪৫) আরেক দলের পরিচয়ও এলো তাঁর সামনে, “তোমাদের কিসে জাহান্নামের এই আগুনে নিক্ষেপ করলো? তারা বলবে- আমরা সালাত প্রতিষ্ঠা করতাম না, আমরা গরিব মিসকিনদের খাবার দিতাম না, কথা বানানো যাদের কাজ আমরা তাদের সাথে মিশে সে কাজে লেগে যেতাম। আমরা শেষ বিচারের দিনটিকে অস্বীকার করতাম, এভাবে একদিন মৃত্যু আমাদের সামনে এসে গেল। (সূরা মুদ্দাসসির : ৪২-৪৭)

http://www.dailysangram.com/post/289334-