২৪ জুন ২০১৭, শনিবার, ১১:৫৩

আমাদের গণতন্ত্রে সঙ্কট

আত্মপক্ষ

|| এবনে গোলাম সামাদ ||

আমরা গণতন্ত্রের ধারণা পেয়েছি গ্রেট ব্রিটেনের কাছ থেকে। বিলাতে গণতন্ত্র চলেছে প্রধানত দুটি বড় দলকে নির্ভর করে। অর্থাৎ, বিলাতের গণতন্ত্র হলো দ্বিদলীয়। কিন্তু আমাদের গণতন্ত্র দ্বিদলীয় নয়। আমাদের দেশের গণতন্ত্র চলেছে দুটি জোটনির্ভরভাবে। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি উভয়ই গঠন করেছে জোট। আমাদের দেশে নির্বাচন হচ্ছে জোট গঠন করে। এতে থাকছে দুটি দলের প্রাধান্য। সুইডেন একটি খুবই উন্নত গণতান্ত্রিক দেশ। সুইডেন চলেছে জোটনির্ভর গণতন্ত্র অনুসারে। তবে সেখানে দলগুলো নির্বাচনে দাঁড়ায় পৃথক পৃথকভাবে। দলগুলো জোট বাঁধে নির্বাচনের পরে। বামপন্থী দলগুলো গঠন করে একটি জোট। অন্য দিকে দক্ষিণপন্থী দলগুলো গঠন করে আর একটি জোট। দুটি জোট আচরণ করে দু’টি দলের মতো। সুইডেনেও তাই গণতন্ত্র কার্যত হয়ে ওঠে দ্বিদলীয়, যদিও রাজনীতিতে আছে একাধিক দল। কিন্তু আমাদের দেশে জোট গঠিত হচ্ছে নির্বাচনের আগে। অনেক অদ্ভুত কাণ্ড ঘটছে দেশে যা অন্য দেশের গণতন্ত্রে দেখা যায় না। সাধারণত যারা ক্ষমতায় থাকেন তারা একমত হয়ে আইনসভার বাজেট উত্থাপন করেন। বাজেটের সমালোচনা করে বিরোধী দল। কিন্তু আমাদের দেশে দেখা যাচ্ছে মন্ত্রিসভায় প্রকাশ্যে অর্থমন্ত্রীর সমালোচনা। এর নজির অন্য কোনো গণতান্ত্রিক দেশে আছে বলে মনে হয় না। যেসব গণতান্ত্রিক দেশকে আমরা শ্রদ্ধা করি, আদর্শ বলে মনে করি, তাদের ইতিহাসে এমন নজির নেই। কোনো মন্ত্রী যদি অর্থমন্ত্রীর সাথে একমত না হন, তবে তিনি মন্ত্রিপরিষদ থেকে ইস্তফা দিয়ে করেন অর্থমন্ত্রীর সমালোচনা। কিন্তু আমাদের দেশে জোট সরকারের মন্ত্রীরা পৃথকভাবে সমালোচনা করছেন অর্থমন্ত্রীর। প্রত্যেকে আচরণ করছেন তাদের দলীয় নীতির অনুসরণে। পৌঁছতে পারছেন না কোনো সাধারণ সিদ্ধান্তে। যেকোনো দেশে বাজেট পাস না হলে ঘটে সরকারের পতন। আমরা দেশে কী ধরনের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছি, তা নিয়েই উঠছে মৌলিক প্রশ্ন। আমাদের অর্থমন্ত্রী কার্যত বলছেন, অন্য মন্ত্রীরা কিছু বোঝেন না। অন্য মন্ত্রীরা যা বলছেন, তা হলো অর্থমন্ত্রী একজন উন্মাদ ব্যক্তি। তিনি অর্থনীতির কিছুই বোঝেন না। এ ধরনের আলোচনা অনেক দেশেই হয়, তবে সেটা হয় গোপনে; প্রকাশ্যে নয়। আমাদের গণতন্ত্র এসে পড়েছে একটা গভীর সঙ্কটে।
অর্থনীতিবিদ আর্ভিং ফিসারের মতে,
P×T = M×V
ওপরের সূত্রে P বলতে বোঝাচ্ছে দ্রব্যমূল্য। T বলতে বোঝাচ্ছে উৎপাদিত দ্রব্যের পরিমাণ। M বলতে বোঝাচ্ছে দেশে মুদ্রার পরিমাণ। এবং V বলতে বোঝাচ্ছে মুদ্রার গতিবেগ। অর্থাৎ মুদ্রা এক ব্যক্তির হাত থেকে আর এক ব্যক্তির হাতে যেতে কত সময় লাগছে, তার পরিমাণ। দেশে যদি দ্রব্য উৎপাদনের তুলনায় মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে যেতে থাকে, তবে মুদ্রার ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। আর এক কথায়, বাড়ে দ্রব্যমূল্য। প্রথমত, একটা দেশে সবার হাতে একই পরিমাণ মুদ্রা থাকে না। দ্বিতীয়ত, বাজারে ব্যাংক নতুন মুদ্রা সরবরাহ করলে ওই মুদ্রা যাদের হাতে প্রথম গিয়ে পৌঁছে, তারা দ্রব্য কিনতে পারে অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি। তারা হয় বিশেষভাবে লাভবান। পক্ষান্তরে, যাদের হাতে বাড়তি মুদ্রার সরবরাহ সবশেষে গিয়ে পৌঁছে, তারা হয় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। কেননা, তাদের হাতে যখন টাকা থাকে না, তখন অন্যদের হাতে থাকে। অন্যরা তাই বাজার থেকে অধিক দ্রব্য খরিদ করতে পারে। গণতান্ত্রিক সরকারের একটা লক্ষ্য হয় বাজারে নোট ছাপিয়ে মুদ্রা সরবরাহ না বাড়ানো। কেননা, এতে সৃষ্টি হয় মুদ্রাস্ফীতির সমস্যা। আর এক কথায়, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সমস্যা। কিন্তু আমাদের দেশে বিশেষভাবে করা হচ্ছে ঘাটতি ব্যয় (Deficit financing)। অর্থাৎ ব্যাংক নোট ছাপিয়ে দেশের উন্নয়ন খরচ মেটায়। ফলে বাজারে বাড়ে মুদ্রার পরিমাণ। এর ফলে দ্রব্যমূল্য বাড়ে আর বেড়ে যায় অভাবী মানুষের অভাব। কেননা দ্রব্য কেনার মতো টাকা তার হাতে থাকে না। আমাদের অর্থমন্ত্রী হয়তো চাচ্ছেন ঘাটতি ব্যয় কমাতে। কিন্তু তিনি দেশ চালানোর জন্য আরোপ করছেন অনেক কিছুর ওপর এমন অনেক কর, যা তাকে করে তুলেছে সমালোচিত। ঘাটতি ব্যয় করব, না দেশবাসীর ওপর নতুন কর আরোপ করব, এটা হলো আমাদের বাজেট তৈরির ক্ষেত্রে একটা বিশেষ সমস্যা। আমাদের অর্থমন্ত্রী পড়েছেন এ সমস্যাতে। আমাদের দেশে যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে, তা এখন হতে পারছে প্রধানত ব্যক্তি উদ্যোগে। ব্যক্তি বেশি কর দিতে হলে উন্নয়ন বন্ধ হয়ে যাবে। কেননা ব্যক্তির হাতে উন্নয়নের জন্য অভাব পড়বে মুদ্রার। ব্যক্তিবিশেষ অথবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে মুদ্রাকে ধরতে হয় পুঁজি হিসেবে। কারণ, মুদ্রা না থাকলে কোনো কিছু কেনা সম্ভব হয় না। ব্যাংক নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। মানুষ ব্যাংকে টাকা রাখে। একে আমরা বলি ‘সঞ্চয়’। কিন্তু সঞ্চয় আর এক দিক থেকে দেখলে বলতে হয় খরচ। তবে এ খরচ ব্যাংকে যিনি টাকা রাখেন, তিনি করেন না। ব্যাংক থেকে টাকা ধার নিয়ে যিনি ব্যবসা করেন, তিনি করেন এ টাকা খরচ। ব্যাংকের টাকা যদি কেউ ধার নিয়ে খরচ না করে, তবে সেই টাকা কখনো প্রকৃত পুঁজিতে পরিণত হতে পারে না। তা ব্যাংকে থেকে যায় অলস মুদ্রা হিসেবে। ব্যাংককে টানতে হয় এ জন্য সুদ। সুদ দিতে হয় ব্যাংকে টাকা আমানতকারীদেরকে। ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে অনেকে ঋণ শোধ দিতে পারেন না। এরা হলেনÑ ঋণখেলাপি। অনেকে ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে বিদেশে করছে টাকা পাচার। সব মিলিয়ে আমাদের মুদ্রাবাজার হয়ে উঠতে চাচ্ছে বিশেষভাবে বিশৃঙ্খল। মুদ্রাবাজারে শৃঙ্খলা আনতে হলে বাজার থেকে মুদ্রা সরবরাহ কিছু কমাতে হবে। কিন্তু কাজটা সহজ নয়। যুদ্ধের সময় যুদ্ধের খরচ চালানোর জন্য অনেক দেশকেই করতে হয় ঘাটতি ব্যয়। প্রথম মহাযুদ্ধের সময় জার্মানি বিপুল ঘাটতি ব্যয় করেছিল, যার কারণে জার্মানিতে সৃষ্টি হতে পেরেছিল মুদ্রাস্ফীতির ভয়াবহ সমস্যা। এই মুদ্রাস্ফীতি কমানোর জন্য জার্মান সরকারকে ১০০০০০০০০০০০০ মার্কের ( জার্মান মুদ্রাকে বলে মার্ক) জন্য বাজারে প্রবর্তন করতে হয় এক স্বর্ণ মার্ক। জার্মানি এভাবে সরিয়ে নিতে পেরেছিল তার বাজার থেকে বাড়তি মুদ্রার সরবরাহ যদিও কাজটা সহজ ছিল না। ফ্রান্সে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সৃষ্টি হতে পেরেছিল মুদ্রাস্ফীতির সমস্যা। এই সমস্যা কমানোর জন্য ফরাসি সরকার বাধ্য হয় প্রতি পুরনো ১০০ ফ্রঁ’র জায়গায় একটি করে নতুন ফ্রঁ চালু করতে ( ফরাসি মুদ্রাকে বলে ফ্রঁ)। এভাবেই অনেক দেশ বাড়তি মুদ্রা সরিয়ে নিয়ে দেশের মানুষের আয় এবং দ্রব্যমূল্যের মধ্যে আনতে চায় সঙ্গতি। কিন্তু আমাদের দেশে কোনো সরকার এরকম কোনো উদ্যোগ নিতে আগ্রহী হচ্ছে না। আমাদের দেশে মুদ্রাস্ফীতি হতে পেরেছে যেসব কারণে, তার মধ্যে একটা হলো ১৯৭১-এর যুদ্ধ। ১৯৭১-এর যুদ্ধে ভারত সরকার ৭০০ কোটি ভারতীয় টাকা খরচ করেছিল ব্যাংকনোট ছাপিয়ে। ভারত সরকার এই ঘাটতি ব্যয়ের বোঝা পরে বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দেয়। বাংলাদেশের নোট প্রথমে ছাপা হয়েছিল ভারতে। ভারত বাংলাদেশের নোট ছাপিয়েছিল তার ইচ্ছেমতো সংখ্যায়। বাংলাদেশে এ টাকা দিয়ে ভারত কিনেছিল নানা দ্রব্য। এর মধ্যে খাদ্যশস্যও ছিল। যতগুলো কারণে ১৯৭৪ সালে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ঘটেছিল তার মধ্যে একটি কারণ হলো, ১৯৭১ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। এর ব্যয়ভার শেষ পর্যন্ত বহন করতে হয়েছিল রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে। আমরা অনেকে এ ইতিহাস অবগত নই। তাই এখানে এ প্রসঙ্গ উল্লেখ করা প্রয়োজন অনুভব করছি। সরাসরি করারোপ করে একটা দেশের মানুষের কাছ থেকে অর্থ লাভ করা অনেক ক্ষেত্রেই কঠিন। কিন্তু ঘাটতি ব্যয় করে অর্থ লাভ করা হয় সহজ। ঘাটতি ব্যয়কে অর্থনীতির পরিভাষায় বলতে হয় এক ধরনের পরোক্ষ কর, যা শেষ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছায় যাদের কর দেয়ার ক্ষমতা সব চেয়ে কম, তাদেরই ওপর। তারা মারা যায় ক্রয়ক্ষমতার অভাবে। অনেক ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। আমাদের দেশে ১৯৭৪ সালে এরকম দুর্ভিক্ষ হয়েছিল।
একটি দেশের গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য ভোটারদের থাকতে হয় আর্থিক সচ্ছলতা। না হলে নির্বাচনের সময় ভোট বিক্রি হয়। দরিদ্ররা ভোট বিক্রি করে, ফলে গণতন্ত্র হতে পারে না প্রকৃত জনমতভিত্তিক। অনেক দেশেই গণতন্ত্র গড়ে উঠেছে অনেক বিপত্তির মধ্য দিয়ে। আমি মনে করি, আমাদের দেশেও গণতন্ত্র গড়ে উঠবে। আমি এ বিষয়ে আশাবাদী।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/230892