২৪ জুন ২০১৭, শনিবার, ১১:৫১

মধ্যবিত্তের পকেট কাটার বাজেট

|| হারুন-আর-রশিদ ||

৮ জুন এক কাজে বাংলাদেশ ব্যাংকে গিয়েছিলাম। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রথম বিল্ডিংয়ের প্রথম তলা তখন লোকে লোকারণ্য। এত মানুষ কেন? ব্যাংকের সিকিউরিটি ফোর্সও ভিড় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। সকাল ১০টায় এত মানুষ কখনো কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আর দেখা যায়নি। রমজান মাস কষ্ট সহ্য করে কেন এত মানুষের সমাগম। এখানে এ ব্যাংকে কোনো বিল দিতে হয় না। তবে কেন এত বড় ভিড় জমেছে? নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, শিশুসহ সবাই বাংলাদেশ ব্যাংকে কী কারণে এলো?
ঘটনাটি বুঝতে সময় লাগল না। কারণ অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের একটি ঘোষণা গোটা জাতিকে হতভম্ব করে দিয়েছে। পয়লা জুলাই থেকে সঞ্চয়পত্রের সব ক্যাটাগরির সুদের হার কমে যাবে। এ কথা শুনেই যার যা আছেÑ সরকারি ব্যাংক, প্রাইভেট ব্যাংক এবং জমা করা আমানত সবই তুলে এনে নির্ভরযোগ্য সরকারি প্রতিষ্ঠান জাতীয় সঞ্চয় ব্যুরো যেখানে এখন পর্যন্ত ভালো সুদ দিয়ে থাকে, সেখানে ৩০ জুনের মধ্যে টাকা জমা রাখলে পেটটা বাঁচবে বলে ভাবছে অনেকে। ভাবছে, সংসারটা ধুঁকে ধুঁকে হলেও চলবে। মানুষ অনেকটা দিশাহারা হয়ে সোনালী ব্যাংক এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকে এসেছে। ৩০ জুন পর্যন্ত এই ভিড় থাকবে। সাংবাদিক ভাইয়েরাও এ ব্যাপারে রিপোর্ট করতে ব্যাংকপাড়ায় এসেছেন। একজন রসিক মানুষ বলেই ফেললেনÑ অর্থমন্ত্রী অতি চতুর মানুষ। মানুষের কাছে কত টাকা আছে তা চলতি বাজেটের শেষ মাসেই তিনি টের পাবেন। ভোটার আইডি কার্ডে চাপ দিলেই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিটি মানুষের জমা টাকা-বাসার ঠিকানা মোবাইল নম্বরসহ এক সাথে স্ক্রিনে ভেসে উঠবে কম্পিউটারে। এর পর প্রয়োজনবোধে এর একটি লিস্ট দুদকেও প্রেরণ করা যাবে। অধস্তনদের রাগান্বিত সুরে বলবে, বলেছিলাম না, মানুষের হাতে অনেক টাকা। দু-এক লাখ নয়, এরও কয়েক গুণ বেশি। মানুষের টাকা কিভাবে আনতে হয় সেটা ভালো করেই জানি।’ সেই ক্যারিশমাই দেখা গেল পয়লা জুন বাজেট ঘোষণা দিয়ে।
বাস্তবে আমরা তার ভিত্তিকে আরো মজবুত করে দিলাম। হাতের আঙুল দিয়ে মাথার চুল আলতোভাবে টেনে ভাবলামÑ বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি চমক আছে। যখন যেটার প্রয়োজন সেই চমকটা ক্ষমতাসীন দল দেখায়। পাবলিক বোকার মতো চেয়ে থাকে। মনে মনে বলে, কী আর করা! বিষয়টি তো সরকারের সম্পূর্ণ একক ক্ষমতার এখতিয়ার। পয়লা জুলাই থেকে সব বিলের সাথে ১৫ শতাংশ ভ্যাট যোগ করে ব্যাংকে জমা দিতে হবে। গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি, টেলিফোনÑ এসবের দাম ইতোমধ্যেই কয়েক দফা বিগত এক বছরে বেড়ে গেছে। এর সাথে যোগ হবে ১৫ শতাংশ ভ্যাটের অঙ্ক। উচ্চ আদালতের রায়ও সরকারের পক্ষে, বিশেষ করে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির ব্যাপারে। অর্থমন্ত্রীকে সরকারি দলও বলেছেÑ ভ্যাট নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করা ঠিক হয়নি। অঙ্কটি যৌক্তিক সীমায় নিয়ে আসুন। শুধু জনগণ নয়, ব্যবসায়ী মহলও আপনার প্রতি অখুশি।’ অর্থমন্ত্রী কাউকেই পরোয়া করেন না। ওরা ‘রাবিশ, রাবিশ’Ñ এই শব্দটা সংবাদ সম্মেলনে শুনলাম। বডি ল্যাংগুয়েজেই বলে দেয়, তিনি একরোখা মানুষ। নিজে যা বুঝবেন তাই করবেন।’ মাঝে মধ্যে এ কথাও বলেনÑ ‘আমার মতো মানুষকে অর্থমন্ত্রী হিসেবে পেয়েছ বিধায় এত বড় অঙ্কের বাজেট তোমরা চোখে দেখলে। অন্যরা সাহসই করত না এত বড় বাজেট দিতে।’
২০১৭-১৮ অর্থবছরের জন্য চার লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বাজেটÑ এ টাকা তো জনগণের। জনগণের টাকা নিয়ে জনগণকে কতটুকু সেবা দেয়া হচ্ছে সেটাই ভাবনার বিষয়। বাস্তবে বাজেট অর্থ, ‘শুধু দিয়ে যাবেন, পাবেন না কিছুই’। মুড়ির টিনে গাদাগাদি করে বসে মতিঝিল ও গুলশানের অফিসপাড়ায় আসতে যে কত কষ্ট, তা ভাবনারও অতীত। গত ৪৬ বছরে যোগাযোগব্যবস্থাটাকে ষাট-সত্তর দশকের চেয়েও খারাপ অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তখন ‘গ্রিন অ্যারো’ ট্রেনে চড়ে যখন আমি চট্টগ্রাম যেতামÑ মাত্র ৬ ঘণ্টা লাগত, এত কষ্ট মানুষের ভিড় তখন দেখতে পাইনি। আজ ট্রেন, বাস, স্টিমার, লঞ্চ ভাড়া বহু গুণ বেড়েছে। সেবার মান শতাংশ হিসেবে বেড়েছে না কমেছেÑ সুপ্রিয় পাঠক সমাজ তার জবাব দেবেন। যে যায় ক্ষমতায়, তার মুখ থেকেই শুধু শুনি উন্নয়নের ফিরিস্তির দীর্ঘ বয়ান, যা টেলিভিশনের সব ক’টি চ্যানেলে দীর্ঘ সময় ধরে দেখানো হয়। কিন্তু বাস্তবে এর তেমন হদিস খুঁজে পাওয়া যায় না। নগরীতে কয়েকটি ফাইওভার নিয়ে যত হইচই আর বাগাড়ম্বর, যানজট কমেনি বরং আগের চেয়ে তা তীব্র হচ্ছে। গাড়ির ভাড়া কয়েক গুণ বেড়েছে কিন্তু সেবা কমেছে অনেক। একটি রাষ্ট্রের রাজধানী শহরে ইন্টার সার্ভিসে জনগণের জন্য এসি গাড়ি নেই। ফ্যানও নেই। তীব্র তাপদাহে মানুষ অতিষ্ঠ। যানজটে তা আরো বাড়ে।
পত্রিকায় দেখলাম যুক্তরাষ্ট্রের মাথাপিছু গড় আয় ৪৬ হাজার ৫০০ ডলার। অথচ ভ্যাট কাটে মাত্র ৯ শতাংশ। ১৫ শতাংশ ভ্যাট কাটে বাংলাদেশে যার মাত্র গড় আয় এক হাজার ১০০ ডলার। তবুও আমরা প্রতিবাদ করতে ভয় পাই। অনেকে বলেন, এসব কথা বললে গুম হয়ে যাবেন। খরচের খাতায় আপনার নামও যোগ হবে। ঝামেলায় গিয়ে লাভ নেই। সংসার আঁতুড় ঘরে পরিণত হবে। সব কিছু আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিন। তিনিই মজলুমের একমাত্র ভরসা; জনগণের মুখ থেকে এসব কথা চলতে ফিরতে শোনা যায়। বাজেটে ধনী মানুষের ক্ষতি হয়েছে এমনটি ৪৬ বছরে শোনা যায়নি।
একজন কৃষকের কথা বলব। কৃষক বলেছেন, মেয়ের বিয়ের জন্য অতি কষ্ট করে প্রতি মাসে এক হাজার করে ব্যাংকে রাখতাম, যা এখন এক লাখ টাকা হয়েছে। পয়লা জুলাই থেকে আবগারি শুল্ক কাটবে আট শত টাকা। লভ্যাংশের ওপর ১৫ শতাংশ টাকা কেটে নেবে। ব্যাংক সার্ভিস চার্জ কেটে নেবে নানা কায়দায়। তিনি বলছেন, ব্যাংকে টাকা রেখে এখন ক্ষতির আশঙ্কাই বাড়ছে। এক লাখ থেকে দুই হাজার পাঁচ শত টাকা ডিলিট হয়ে যাবে। সুদের হার তো ব্যাংকে কমতে কমতে তলানিতে এসে ঠেকেছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সুদের এর চেয়ে কম হার আর দেখিনি। মেয়াদি হিসাবেও সুদের হার কমেছে। বিনিয়োগবান্ধব সরকার বিনিয়োগ চায় না, আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অর্থ বাড়–ক এটা ডিজিটাল সরকার চায় না। দেশের মানুষ আমানত না রাখলে কর্মচারীর বেতন বন্ধ হয়ে যাবে। অনেক জায়গায় ছাঁটাইর কথা শুনছি। চাকরি চলে যাবে যেকোনো সময়। এই কথাটি হরহামেশা শুনছি। মিডিয়ায় বেতন ছাড়াও চাকরি আছে। চাকরি থাকলে সাত-আট মাস বেতন বাকি। দেশের কয়েকটি পত্রিকা ছাড়া সব পত্রিকার একই অবস্থা। এদিকে সরকার পরোক্ষ কর বা ভ্যাট যেটা পণ্যের ওপর বাড়াবে, সেটা পণ্যের মালিক ভোক্তাদের কাছ থেকে কেটে নেবে। পণ্যের দামের সাথেই এসব ট্যাক্স ভ্যাট মালিকেরা যোগ করে মূল্য নির্ধারণ করেন। দেশের মানুষের এমন দুরবস্থা আর কখনো দেখা যায়নি। এদিকে মিনিকেট ও নাজিরশাইল চাল ৬৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। স্বর্ণা ও লতা চাল ৫০ টাকা কেজি। মোটা চাল ৪৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। অন্যান্য পণ্যের মূল বাজেট ঘোষণার আগেই বেড়ে গেছে। গরুর গোশত ৫০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। মওসুমি ফল আম জাম লিচুর দামও অনেক বেড়ে গেছে। রমজান মাসে গরিবের ফল খাওয়াও দুষ্কর। এসব এখন বিলাসিতা। শেয়ারবাজার এক নামে পরিচিত দীর্ঘ ১০ বছর ধরে, সেটা হলো মন্দার বাজার। ক্যাপিটাল মার্কেট থেকে জুয়াড়িরা এক লাখ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে বিগত এক দশকে। সব টাকাই ুদ্র বিনিয়োগকারীদের। দেশের মানুষ কর ভ্যাট দিয়ে একটু সুস্থভাবে বেঁচে থাকবে, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। জননিরাপত্তা শূন্যের কোঠায়।
বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ একটি রাষ্ট্র আয়তন অনুযায়ী। এ কারণে এ দেশে জমির দাম খুব বেশি। সবাই ফ্যাট ও প্লট কিনতে চায়। দেশের কালো টাকার মালিকেরা জমি ও ফ্যাটে বিনিয়োগ করছে। তাদের ব্যাংকে টাকা গচ্ছিত রাখার প্রয়োজন পড়ে না। বেশি টাকার মালিকেরা বিদেশে অ্যাপার্টমেন্ট কিনে রেখেছে। বিদেশী ব্যাংকেও টাকা পাচার করছে। একেকজনের চার-পাঁচটি প্রাইভেট কার। মহাসুখে আছে কিছু মানুষ। এদের ধরার ব্যাপারে সরকারের কার্পণ্য দেখলে হতবাক হতে হয়। যত দোষ নন্দ ঘোষ। অর্থাৎ ‘সব দোষ গরিব ও মধ্যবিত্ত মানুষের। ওদের ধরো।’ এ রকম দৃশ্য পার্শ্ববর্তী ভারতেও নেই। বাজেটের নামে সাধারণ মানুষের রুজি রোজগারে হাত দেয়া রাষ্ট্রের জন্য লজ্জাকর ব্যাপার। রাষ্ট্রযন্ত্র বিষয়টি বুঝতে চাচ্ছে না কেন? ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে সাধারণ মানুষদের তো তাদের প্রয়োজন আছে। নিরপেক্ষ নির্বাচনে তাদের ভোটের মূল্য অনেক। তবে গায়ের জোর বা প্রশাসনের জোরে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চাইলে জনগণের প্রয়োজন হয় না। সরকার কোনটি চায়, জনগণ না ক্যাডার বাহিনী? এবারের বাজেটে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ কম রাখা হয়েছে। কৃষি ও শিল্প খাতে বরাদ্দ আগের চেয়েও কম। ঘুষ ও দুর্নীতির কারণে তথা সুশাসনের অভাবে বিদেশী বিনিয়োগও বাড়বে না। রাজনৈতিক অস্থিরতায় বাজেট বাস্তবায়নে যথেষ্ট বেগ পেতে হবে বলে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদেরা বলেছেন।
লেখক : গ্রন্থকার, গবেষক ও কলামিস্ট
harunrahidar@gmail.com

 

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/230891