২৩ জুন ২০১৭, শুক্রবার, ১১:৩২

কমিশন বাণিজ্য করতেই চাল-গম মজুদে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট

বিদেশ থেকে গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট (জিটুজি)'র মাধ্যমে আমদানির নামে কমিশন বাণিজ্য করতেই সরকারের ঘরে চাল-গম মজুদে কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছে শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট। দীর্ঘদিন আমদানি বন্ধ রেখে অভ্যন্তরীণ বাজার সংকট তৈরি করেই প্রায় হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এই চক্র। চাল গম মিলে ১৫ লাখ মেট্রিক টন সংগ্রহের কথা থাকলেও সংগ্রহ হয়েছে ১ লাখ ২০ হাজার টন। খোদ খাদ্য মন্ত্রণালয়ের প্রভাবশালীরা এই সিন্ডিকেটে জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে মন্ত্রীর আঙ্গুল বিএনপিপন্থী মিলারদের দিকে।

বোরো উঠার পর বছরের এই সময়ে সরকারি চালের মজুদ থাকার কথা ৬ থেকে ৭ লাখ টন। একইভাবে গমের মজুদও রাখার কথা ছিল প্রায় ৮ লাখ মেট্রিক টন। কিন্তু এখন সরকারি গুদামে চাল আছে মোটে ১ লাখ ৭০ হাজার মেট্রিক টন।
এ মজুদ পরিস্থিতি বুঝতে পেরে সরকার ভিজিএফ, ভিজিপি, জিআর, টিআরসহ অন্যান্য সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে চালের পরিবর্তে গম দেয়া শুরু করে। এখন গমেও মজুদ নেই। সরকার বাধ্য হয়ে সারা দেশে ১০ টাকা কেজি দরে চাল এবং ১৫ টাকায় ট্রাক সেলে চাল বিক্রি বন্ধ রেখেছে। এতে করে বাজার আরও উর্ধ্বমুখী হচ্ছে। কিন্তু এতো কিছুর পরেও সরকারের হাতে কোন ক্ষমতা নেই। কারণ সরকারের মজুদে কোন চাল কিংবা গম নেই যা দিয়ে সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
আর এতে করে ৩০ জুনের পর গমের মজুদও ৩ লাখ টন থেকে কমে নেমে আসবে ১ লাখ টনে। চাল-গমের মজুদের এতো করুণ দশায় আগে কখনো পড়তে হয়নি সরকারকে। অতীতে যে কোন সময়ই গম মজুদকৃত গম ব্যবহার না করার কারণেই তা নষ্ট হতো। কিন্তু এ বছর তা নেমে এসেছে শূন্যের কোঠায়।
জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার ভয়ে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বরাবরই দেশে চালের পর্যাপ্ত মজুদ আছে প্রচার করলেও চালের আমদানি শুল্ক কমাতে এনবিআরকে তিনি অনুরোধ জানিয়েছেন ঠিক দুই মাস আগে। দুই মাস কালক্ষেপণ করে অবশেষে আমদানি শুল্ক ২৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ নির্ধারণ করা হলেও ততোদিনে জনগণের পকেট থেকে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। অভিযোগ রয়েছে, সিন্ডিকেটের সাথে যোগসাজশের কারণেই চালের আমদানি শুল্ক কমানোর সিদ্ধান্তটি অনেক বিলম্বে এসেছে। আর সিদ্ধান্তটি যখন এসেছে ততোদিনে আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় শুল্ক কমিয়েও এ থেকে কোনো সুফল পাওয়া যাবে না বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
ভূক্তভোগিরা বলছেন, চাল আমদানি করে কোন লাভ হবে না। কারণ বাংলাদেশে যে পণ্যের দাম একবার বাড়ে তা আর কোন দিন কমে না। ১০ লাখ টন চাল আমদানি করলেও চালের দাম আর ৫০ টাকার নিচে আসবে না।
অনুসন্ধানে জানা যায়, দেশে প্রতি বছর গড়ে চালের চাহিদা প্রায় তিন কোটি ৫০ লাখ মেট্রিক টন। সে হিসেবে প্রতিদিন গড়ে চাল ব্যবহৃত হয় প্রায় ৯৬ হাজার টন। এ চালের এক-তৃতীয়াংশও যদি বাজার থেকে কিনে খাওয়া হয় তাতে দৈনিক চাল বিক্রি হয় ৩২ হাজার টনের মতো। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে প্রতি টন চালে গড়ে ৫০০ টাকা হারে দাম বাড়ালেও দৈনিক লুট হয়েছে প্রায় ১৬ কোটি টাকা। এভাবে গত দুই মাসে চাল সিন্ডিকেট প্রায় হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছে বলে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। মূলত উত্তরবঙ্গের ১৬ জন বৃহৎ চালকল মালিকের সমন্বয়ে এ সিন্ডিকেট গড়ে উঠলেও এর ছিটেফোঁটা পৌঁছেছে অনেক দূর পর্যন্ত। মাঝে লাভবান হয়েছেন পাইকারি ও খুচরা চাল ব্যবসায়ীরাও।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দৈনিক খাদ্যশস্য পরিস্থিতি প্রতিবেদন অনুযায়ী, এপ্রিল মাসের শেষের দিকে কিংবা মে মাসের প্রথম দিকে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে চাল কেনা হলে তার দাম পড়তো বর্তমানের চেয়ে কেজিতে প্রায় ৮ টাকা কম। এতে বলা হয়, ভারত থেকে ৫ শতাংশ ভাঙা সেদ্ধ চাল আমদানি করলে তখন দেশের বাজারে প্রতি কেজির সম্ভাব্য মূল্য দাঁড়াতো ৩২ টাকার কিছু বেশি। পাকিস্তান থেকে আনলে তা প্রতি কেজি প্রায় ৩৫ টাকা পড়তো। অন্যদিকে থাইল্যান্ড থেকে আতপ চাল আমদানি করলে প্রতি কেজি পড়তো ৩২ টাকা ৪৪ পয়সা ও ভিয়েতনাম থেকে আনলে পড়তো ৩৩ টাকা ৬৪ পয়সা। অথচ দেশে তখনো মোটা চাল বিক্রি হচ্ছিল ৪৩ থেকে ৪৫ টাকা কেজি দরে। কিন্তু গত প্রায় দুই মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম অনেক বেড়ে গেছে। ফলে ১৮ শতাংশ শুল্ক কমানোর ফলে কেজিপ্রতি দাম যেখানে ছয় টাকা কমে আসার কথা বলছেন বাণিজ্যমন্ত্রী, সেখানে চাল আমদানি করতে হচ্ছে আরো বাড়তি দামে।
সূত্রটির দাবি, ওই চক্র চালের আমদানি শুল্ক কমানোর বিষয়টি বিলম্বিত করার চেষ্টায় তৎপর। ফলে বেসরকারিভাবে চাল আমদানিও শুরু হয়নি ব্যাপকহারে। আর তাই দেশে চালের মজুদ পৌছে আশংকাজনক পর্যায়ে।
মজুদ পরিস্থিতি ও সিন্ডিকেটের কমিশন বাণিজ্য নিয়ে দু'দিন চেষ্টা করেও খাদ্য মন্ত্রণালয় কিংবা খাদ্য অধিদপ্তরের কারো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম এই সংকটের জন্য সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বিএনপিপন্থী মিল মালিকদের দায়ী করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানান।
কিন্তু বিএনপিপন্থী কোন কোন মিলাররা এর সাথে জড়িত না তিনি প্রকাশ করেননি। তিনি অবশ্য বলেছেন তার কাছে তথ্য রয়েছে। যারা এই সংকট তৈরির সাথে জড়িত তাদের বিচারের আওতায় আনা হবে।
জানা গেছে, সরকারের খাদ্যমন্ত্রনালয়ের সংশ্লিষ্টরা নানা যুক্তি দার করিয়ে চাল আমদানিতে বিলম্ব করেছে। একইভাবে অভ্যন্তরিন বাজার থেকেও তারা ধান চাল সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এতে করে দেশে মজুদ নেমে আসে ঝুকিতে।
পরিকল্পনা মন্ত্রনালয়ের সচিব বলেন, বোর মওসুমে ধান উৎপাদন হওয়ার কথা ১ কোটি ৯৫ লাখ মেট্রিক টন। কিন্তু বন্যার কারণ এবার ধান নষ্ট হয়েছে ৩ লাখ টন। এতে খাদ্য সংকট হবে না বলে মনে করেন তিনি। কিন্তু তার এই বক্তব্যের সাথে কোন মিল খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। যদি এত ধান উৎপাদন হয়ে থাকে তাহলে তা গেলো কোথায়।
জানা গেছে, হাওর অঞ্চলের কৃষকরা তেমন চাল বিক্রি করতে পারে না। তাদের উৎপাদিত চাল দিয়ে তাদের সংসার চলে মাত্র। মূল বাণিজ্যিকভাবে ধান উৎপাদন হয়ে থাকে রাজশাহী, নওগাঁ, নাটর, চাপাই নবাব গঞ্জ, দিনাজপুর, পাবনা এবং বরিশালের কিছু অংশ। এসব এলাকায় এখনও বন্যায় ফসল হানির কোন খবর পাওয়া যায়নি। অথচ হাওর অঞ্চলের বন্যার অজুহাতে ইতোমধ্যেই চালের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে মিল মালিকরা।
অভিযোগ রয়েছে, মিল মালিকরা চালের দাম বাড়ানোর ইচ্ছা করলেই চাল বিক্রি বন্ধ করে তা মজুদ রাখেন। এতে করে বাজার চাহিদা বেড়ে যায় এবং সরবরাহ কমে যায়। ফলে কোন কারণ ছাড়াই চাল দাম বাড়িয়ে থাকেন পাইকারি আড়তদাররা। আর এর প্রভাব পড়তে থাকে খুচরা বাজারে।
এদিকে চালের দাম বাড়ার জন্য খুচরা, পাইকারি ও মিলাররা একে অপরকে দায়ী করছেন। খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, পাইকারি বাজারে চালের দাম বাড়ার কারণে তারাও বাড়াতে বাধ্য হয়েছেন। আবার পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, মিল মালিকরা চালের সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন, একই সঙ্গে দামও বাড়িয়েছেন। ফলে তাদের কাছ থেকে বেশি দামে চাল কেনার কারণে বাজারেও বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।

http://www.dailysangram.com/post/289200-