২৩ জুন ২০১৭, শুক্রবার, ১১:০৮

পর্যটনে বড় ধাক্কা

রাঙামাটি নাম শুনতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে পাহাড়ের ভাঁজ, হ্রদের স্বচ্ছ পানি, পানির ওপর ঝুলন্ত সেতু কিংবা নির্ঝর ঝর্ণার রূপমাধুরী। প্রতি বছর ঈদ এলে তাই রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের নৈসর্গিক সৌন্দর্য দেখতে ভিড় জমে পর্যটকদের। গত বছরও ঈদের লম্বা ছুটিতে তিন পাহাড়ে ছিলেন লাখো পর্যটক। এবার ঈদেও আছে লম্বা ছুটি। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল থেকেই ঈদ আনন্দ উপভোগ করতে একেকজন ছুটছেন একেক গন্তব্যে। কেউ ঈদ করবেন প্রিয়জনের সানি্নধ্যে, কেউবা ঈদের ছুটি পরিবার-পরিজন নিয়ে কাটাবেন নির্জনে। গত বছর ঈদের আগেই জমজমাট থাকা তিন পাহাড়ি জেলায় এবার যেন নীরবতা। পাহাড় ধসের ঘটনায় দেখা দিয়েছে পর্যটক সংকট। তাই হোটেল-মোটেল-গেস্ট হাউসসহ খাঁ খাঁ করছে সবকিছুই।

রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মানজারুল মান্নান বলেন, 'রাঙামাটি পর্যটকদের কাছে অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান। কিন্তু পাহাড় ধসের ঘটনায় এবার লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে এখানকার অনেক পর্যটন স্পট। আশপাশের পাহাড় ধসে পড়ায় ঝুঁকির মুখে আছে ঝুলন্ত সেতুসহ কয়েকটি স্পট। এসব স্পট জরুরি ভিত্তিতে ঝুঁকিমুক্ত করতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি।' বান্দরবানের জেলা প্রশাসক দীলিপ কুমার বণিক বলেন, 'বান্দরবানে পাহাড় ধসে সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। বেশক'টি পাহাড় ঝুঁকির মধ্যে আছে। এবার পর্যটকদের চলাফেরা করতে হবে সতর্কতার সঙ্গে।'


ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পর্যটকদের বেশিরভাগ রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি কিংবা কক্সবাজারে যাওয়ার আগে অবস্থান করেন চট্টগ্রামের মোটেল কিংবা হোটেলে। চট্টগ্রামের পর্যটন মোটেল সৈকতে এ বছর প্রতি মাসে গড়ে

আড়াই হাজার পর্যটক থাকলেও চলতি জুন মাসে ছিল মাত্র ৭০০ জন। সৈকতের ব্যবস্থাপক মিজানুর রহমান বলেন, 'ঈদের সপ্তাহ দুয়েক আগেই পাহাড় ধসের ঘটনায় রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়িসহ পাঁচ জেলায় প্রাণ গেছে ১৬০ জনের। এ শোক এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি পাহাড়ের মানুষ। বিরূপ আবহাওয়া ও পাহাড় ধসের এ ঘটনায় এবারের ঈদে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে পর্যটন খাতে।'

রাঙামাটির অন্যতম সরকারি পর্যটন কেন্দ্র হলিডে কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা গেছে, সম্প্রতি নির্মাণ করা ভবনের পাশের মাটি ধসে গেছে। রাঙামাটির সবচেয়ে আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট ঝুলন্ত সেতুর পাশেও ধসে পড়েছে পাহাড়। এ সেতুর এক পাশে শিশুপার্কের মাটি ধসে পড়েছে। যে কোনো সময় অবশিষ্ট অংশ ধসে পড়লে বন্ধ হয়ে যাবে সেতুতে ওঠার পথ। ক্ষতিগ্রস্ত হবে মূল সেতুও।

রাঙামাটি হলিডে কমপ্লেক্সের ব্যবস্থাপক আলোক বিকাশ চাকমা বলেন, 'পাহাড় ধসে নতুন ভবনের পেছনে মাটি ধসে পড়েছে। এ ছাড়া ঝুলন্ত সেতুর পাশে থাকা পাহাড়ের মাটিও ধসে গেছে। এ ব্যাপারে পর্যটন করপোরেশনের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।

রাঙামাটির আরেক পর্যটন স্পট ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ইনস্টিটিউটের জাদুঘর। এ জাদুঘর ও ডরমিটরি ভবনেরও পাশের মাটি ধসে গিয়ে কয়েকশ' ফুট নিচে গিয়ে পড়েছে। বৃষ্টিতে যাতে পানি পড়ে আর মাটি ধসে না যায় সে জন্য পলিথিন দিয়ে ভবনের আশপাশ ঢেকে রাখা হয়েছে।

বিষয়টি স্বীকার করে রাঙামাটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ইনস্টিটিউটের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক রনেল চাকমা বলেন, 'পাহাড় ধসের কারণে ইনস্টিটিউটের জাদুঘর ও ডরমিটরি ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এখানে লোকজনকে অবস্থান করতে দেওয়া হচ্ছে না। পর্যটকদের জন্যও এ ভবন এখন ঝুঁকিপূর্ণ। এ ব্যাপারে পরিচালনা কমিটিকে অবগত করা হয়েছে।'

পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রে আছে বান্দরবানও। চোখ জুড়ানো একাধিক পর্যটন স্পট থাকায় প্রতি বছর ঈদ মৌসুমে পর্যটকরা বেছে নেন বান্দরবানকে। কিন্তু এবার অতিবৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বান্দরবানের বেশক'টি পাহাড়। লাশ পড়েছে সাতটি। ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে পাহাড়ের ভাঁজে থাকা পর্যটন স্পটগুলোও। বান্দরবানে রয়েছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বৌদ্ধ মন্দির। বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৌদ্ধ মূর্তিটি রয়েছে বান্দরবানে। শহরের মধ্যেই রয়েছে জাদিপাড়ার রাজবিহার এবং উজানীপাড়ার বিহার। বান্দরবান জেলা সদর থেকে প্রায় ৪৭ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বান্দরবান-থানছি সড়কে পাহাড় চূড়ায় আছে নীলগিরি পর্যটন কেন্দ্র। বান্দরবান-কেরানীহাট সড়কের পাশে পাহাড়বেষ্টিত স্বচ্ছ জলের মনোরম লেক মেঘলা পর্যটন কমপ্লেক্স। বান্দরবান শহর থেকে সাড়ে চার কিলোমিটার দূরে এই কমপ্লেক্সে রয়েছে একটি চিড়িয়াখানাও। শহর থেকে চিম্বুকের পথে যেতে পড়ে বম ও ম্র্রো উপজাতীয়দের গ্রাম। এখানে রয়েছে প্রান্তিক হ্রদ, জীবননগর এবং কিয়াচলং হ্রদসহ আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য পর্যটন স্থান। বান্দরবান শহর থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে আছে আকর্ষণীয় ঝর্ণা শৈলপ্রপাত। এ ছাড়া বাংলাদেশের উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ তাজিংডং এবং বৃহত্তম পর্বতশৃঙ্গ কেওক্রাডং এই বান্দরবান জেলাতেই অবস্থিত।

প্রকৃতির সৌন্দর্যের আরেক লীলাভূমি হচ্ছে খাগড়াছড়ি। পাহাড় ধসে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে এ জেলায়ও। অবিরাম বৃষ্টি হওয়ায় এখানেও ঝুঁকির মুখে আছে পাহাড়ের ভাঁজে গড়ে ওঠা পর্যটন স্পটগুলো। প্রতি বছর ঈদ মৌসুমে পর্যটকদের আনাগোনা বেশি থাকলেও এবারে নীরবতা বিরাজ করছে এ পর্যটন জেলায়ও। অথচ খাগড়াছড়ি শহরের প্রবেশ পথেই চোখে পড়ে আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্র। এখানে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার ও বিশ্রাম কক্ষ আছে। গুহায় যাওয়ার পথে আছে সিঁড়িও। এ টিলার চূড়ায় দাঁড়ালে দেখা যায় পুরো শহর। এ স্থানটিকে আরও আকর্ষণীয় করছে ইকোপার্ক। জেলা সদর থেকে আলুটিলা পেরিয়ে সামান্য পশ্চিমে মূল রাস্তা থেকে উত্তরে ঝর্ণা স্থানের দূরত্ব সাকুল্যে ১১ কিলোমিটার। ২৫ থেকে ৩০ হাত উঁচু পাহাড় থেকে আছড়ে পড়ছে ঝর্ণার জলরাশি। ঢালু পাহাড় গড়িয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে ঝর্ণার এই প্রবাহ। কাছাকাছি দুটি ঝর্ণা রয়েছে এ স্থানে। পর্যটকদের অনেকে এখানে এসে ঝর্ণার শীতল পানিতে ভেজাতেন গা।

http://bangla.samakal.net/2017/06/23/303221