২২ জুন ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১০:৫৭

অজ্ঞাত কারণে আমদানি শুল্ক কমাতে দুই মাস সময় পার

৯৫৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চাল সিন্ডিকেট

জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার ভয়ে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বরাবরই দেশে চালের পর্যাপ্ত মজুদ আছে প্রচার করলেও চালের আমদানি শুল্ক কমাতে এনবিআরকে তিনি অনুরোধ জানিয়েছেন ঠিক দুই মাস আগে। এ সময়ের মধ্যে পদ্মা, মেঘনা, যমুনায় অনেক পানি গড়ালেও অজ্ঞাত কারণে তা কার্যকর হয়নি। অবশেষে আমদানি শুল্ক ২৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ নির্ধারণ করা হলেও তত দিনে জনগণের পকেট থেকে ৯৫৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। অভিযোগ রয়েছে, সিন্ডিকেটের সাথে যোগসাজশের কারণেই চালের আমদানি শুল্ক কমানোর সিদ্ধান্তটি অনেক বিলম্বে এসেছে। আর সিদ্ধান্তটি যখন এসেছে তত দিনে আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় শুল্ক কমিয়েও এ থেকে কোনো সুফল পাওয়া যাবে না বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
অনুসন্ধানে জানা যায়, দেশে প্রতি বছর গড়ে চালের চাহিদা প্রায় তিন কোটি ৫০ লাখ মেট্রিক টন। সে হিসেবে প্রতিদিন গড়ে চাল ব্যবহৃত হয় প্রায় ৯৬ হাজার টন। এ চালের এক-তৃতীয়াংশও যদি বাজার থেকে কিনে খাওয়া হয় তাতে দৈনিক চাল বিক্রি হয় ৩২ হাজার টনের মতো। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে প্রতি টন চালে গড়ে ৫০০ টাকা হারে দাম বাড়ালেও দৈনিক লুট হয়েছে প্রায় ১৬ কোটি টাকা। এভাবে গত দুই মাসে চাল সিন্ডিকেট ৯৫৮ কোটি টাকা লুটে নিয়েছে বলে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। মূলত উত্তরবঙ্গের ১৬ জন বৃহৎ চালকল মালিকের সমন্বয়ে এ সিন্ডিকেট গড়ে উঠলেও এর ছিটেফোঁটা পৌঁছেছে অনেক দূর পর্যন্ত। মাঝে লাভবান হয়েছেন পাইকারি ও খুচরা চাল ব্যবসায়ীরাও।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দৈনিক খাদ্যশস্য পরিস্থিতি প্রতিবেদন অনুযায়ী, এপ্রিল মাসের শেষের দিকে কিংবা মে মাসের প্রথম দিকে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে চাল কেনা হলে তার দাম পড়ত বর্তমানের চেয়ে কেজিতে প্রায় ৮ টাকা কম। এতে বলা হয়, ভারত থেকে ৫ শতাংশ ভাঙা সেদ্ধ চাল আমদানি করলে তখন দেশের বাজারে প্রতি কেজির সম্ভাব্য মূল্য দাঁড়াত ৩২ টাকার কিছু বেশি। পাকিস্তান থেকে আনলে তা কেজিপ্রতি প্রায় ৩৫ টাকা পড়ত। অন্য দিকে থাইল্যান্ড থেকে আতপ চাল আমদানি করলে প্রতি কেজি পড়ত ৩২ টাকা ৪৪ পয়সা ও ভিয়েতনাম থেকে আনলে পড়ত ৩৩ টাকা ৬৪ পয়সা। অথচ দেশে তখনো মোটা চাল বিক্রি হচ্ছিল ৪৩ থেকে ৪৫ টাকা কেজিদরে। কিন্তু গত প্রায় দুই মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম অনেক বেড়ে গেছে। ফলে ১৮ শতাংশ শুল্ক কমানোর ফলে কেজিপ্রতি দাম যেখানে ছয় টাকা কমে আসার কথা বলছেন বাণিজ্যমন্ত্রী, সেখানে চাল আমদানি করতে হচ্ছে আরো বাড়তি দামে।
সরকারি হিসাবে চলতি বছর ধানে ব্লাস্ট রোগ এবং হাওরে আগাম বন্যায় চালের উৎপাদন ১২ লাখ মেট্রিক টন কম হয়েছে। তবে বেসরকারি হিসেবে উৎপাদন ঘাটতির পরিমাণ প্রায় ৪০ লাখ টন। আগের বছরগুলোয় বিদেশ থেকে বেসরকারি পর্যায়ে গড়ে চাল আমদানি করা হতো ১৫ লাখ টন করে। অথচ গত এক বছরে আমদানি হয়েছে মাত্র এক লাখ ২৮ হাজার টন। সরকারি গুদামে চালের মজুদ তলানিতে নেমে এসেছে। সারা বছর যেখানে গড়ে ১০ লাখ টন খাদ্য মজুদ থাকার কথা সেখানে আছে মাত্র ১ লাখ ৯১ হাজার টন। কিন্তু আমদানিকারকদের তীব্র চাপের মুখেও আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার বা কমিয়ে আনার বিষয়টি দুই মাস ধরে এনবিআর এবং খাদ্য মন্ত্রণালয়ের রশি টানাটানির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়ে যায়। প্রতি কেজি মোটা চালের দাম বেড়ে যায় ১৫ টাকা। ১০ থেকে ১২ টাকা বাড়ে সরু চালের দাম।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, সরকারি গুদামে চালের মজুদ গত ১০ বছরের মধ্যে এখন সর্বনিম্ন। গতকাল সরকারি গুদামে চাল ছিল মাত্র ১ লাখ ৯১ হাজার টন। অথচ ২০১১ সালের এই দিনে চালের মজুদ ছিল ৯ লাখ ৯৮ হাজার টন। ২০১২ সালে ছিল ৬ লাখ ৯৯ হাজার টন। ২০১৩ সালে ছিল ৬ লাখ ৫৮ হাজার টন। ২০১৪ সালে ছিল ৭ লাখ ৯৭ হাজার টন। ২০১৫ সালে ছিল ৬ লাখ ৯৬ হাজার টন। এবারই প্রথম চালের মজুদ এতটা নিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে।
জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) মতে, বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীদের হাতেও পর্যাপ্ত চালের মজুদ নেই। স্বাভাবিকের চেয়ে ১০ লাখ টন চাল কম নিয়ে ২০১৭ সাল শুরু করেছেন তারা। ফলস্বরূপ গত এক বছরে ৩০ টাকার মোটা চালের দাম বেড়ে হয়েছে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। ৪২ টাকা থেকে বাড়তে বাড়তে ৬০ টাকায় ঠেকেছে সরু চালের দাম। শেষ পর্যন্ত সরকার যখন আমদানি শুল্ক কমানোর সিদ্ধান্ত নিলো ততক্ষণে মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়ে গেছে।
চালের উৎপাদন নিয়ে প্রকাশিত এফএওর প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে গড়ে ৩ কোটি ৪৫ লাখ টন চাল উৎপাদিত হয়েছে। ২০১৬ সালে তা থেকে ২০ লাখ টন উৎপাদন বেড়েছিল। ২০১৭ সালে উৎপাদন ফের ১০ লাখ টন কমে যায়। এতে বলা হয়, এশিয়ার প্রধান চাল উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে চালের উৎপাদন বৃদ্ধির হার সবচেয়ে কমেছে। ভারতে গত এক বছরে চালের উৎপাদন বেড়েছে ১২ লাখ টন, পাকিস্তানে ২ লাখ টন, থাইল্যান্ডে ৪ লাখ টন ও ভিয়েতনামে ৩ লাখ টন। অথচ বাংলাদেশে উৎপাদন তো বাড়েইনি, বরং গত বছরের চেয়ে ১০ লাখ টন কমেছে। চালের উৎপাদন, আমদানি, মজুদ, বিতরণ সব কিছু কমে যাওয়ায় বাজারে দাম বাড়ছে বলে মনে করছেন দেশের শীর্ষ অর্থনীতিবিদ ও গবেষকেরা। টিসিবির হিসাব অনুযায়ী, সব ধরনের চালের দাম গত এক মাসে ৪ থেকে ৮ শতাংশ এবং এক বছরে ৪৮ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
ক্ষমতায় গেলে ১০ টাকা কেজিদরে চাল খাওয়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পায় হয় বর্তমান সরকার। ক্ষমতায় গিয়ে ১০ টাকা কেজিদরে চাল বিক্রির উদ্যোগও নিয়েছিল তারা। কিন্তু গরিবের ওই চাল ক্ষমতাসীন দলের ধনী নেতাকর্মীদের বাড়িতে যাওয়া ঠেকাতে না পারায় শেষ পর্যন্ত প্রকল্পটিই ভেস্তে যায়। দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার কৃতিত্ব ঘরে তুলতে গিয়ে আরেক দফা হোঁচট খায় সরকার। দেশের মোট জনসংখ্যার যে পরিসংখ্যান দেয়া হয় তার সাথে পুরোপুরি একমত হতে পারছেন না বেসরকারি গবেষকেরা। আবার চালের উৎপাদন বাড়িয়ে দেখানোর প্রবণতা থেকেও সরকার বেরিয়ে আসতে পারছে না। ১৫ লাখ টন খাদ্য আমদানির বছরও কিছু চাল রফতানি করে বাহাবা নিতে চেয়েছিল সরকার। এভাবেই মূলত জটিল হয়ে ওঠে চাল সঙ্কট।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/230526#sthash.rV8GgILN.dpufhttp://www.dailynayadiganta.com/detail/news/230526