রাজধানী থেকে বের হওয়ার মুখেই দীর্ঘ যানজট। ছবিটি গতকাল বিকেলে গাবতলী এলাকা থেকে তোলা l প্রথম আলো
২২ জুন ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১০:৩৯

ঈদযাত্রার প্রথম দিন

ঢাকা থেকে বেরোতেই ঝক্কি

সড়কপথে রাজধানী ঢাকা থেকে বের হওয়ার এবং প্রবেশের মূল তিনটি পথ আগে থেকেই সমস্যাসংকুল। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ঈদযাত্রার চাপ। এতে গাবতলী, মহাখালী ও সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে বাস বের হয়ে মহাসড়কে উঠতে এবং ঢাকায় প্রবেশে ঝক্কিতে পড়তে হচ্ছে।
গতকাল বুধবার থেকে সড়কপথে আনুষ্ঠানিক ঈদযাত্রা শুরু হয়েছে। পরিবহন কোম্পানিগুলোর টিকিট বিক্রির যে চিত্র পাওয়া গেছে, তাতে মূল চাপ শুরু হচ্ছে আজ বৃহস্পতিবার থেকে। চলবে ঈদের আগের দিন পর্যন্ত। পুলিশও বলছে, আজ থেকেই তাদের মূল চ্যালেঞ্জ শুরু হবে।
দেশের উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ৪০ জেলায় যাতায়াতে গাবতলী আন্তজেলা বাস টার্মিনালের আগে-পরে রাতে দীর্ঘ যানজট হচ্ছে। এই পথের মূল সমস্যা অব্যবস্থাপনা ও যানবাহনের এলোমেলো চলাচল। মহাখালী টার্মিনাল থেকে বাস আবদুল্লাহপুর, টঙ্গী-ভোগড়া বাইপাস ও টঙ্গী স্টেশন রোড এলাকায় দিয়ে বিভিন্ন গন্তব্যে যায়। কিন্তু এই পথে খানাখন্দ ও বাড়তি চাপে যানজট হচ্ছে। আর গর্ত-জলাবদ্ধতার কারণে যাত্রাবাড়ী হয়ে পূর্বাঞ্চলের যাত্রাও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
ঢাকার প্রবেশ ও বের হওয়ার এই স্থানগুলোর ঝক্কি সম্পর্কে পরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ঈদ পড়েছে বর্ষাকালে। ফলে খানাখন্দ বা নির্মাণ কাজের কারণে সড়কে পানি জমে যাচ্ছে। আরেকটি চিরায়ত সমস্যা বিশৃঙ্খলা ও এলোমেলো যান চলাচল। বাংলাদেশের যান চলাচল বিজ্ঞানভিত্তিক নয়, লাঠি হাতে গায়ে-গতরে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ফলে রাস্তায় পুলিশের প্রচুর লোকবল নামিয়ে সমাধান ছাড়া কোনো উপায় নেই।
গাবতলী, মহাখালী ও সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল এবং এগুলোর আশপাশের এলাকা থেকে প্রতিদিন ১০ হাজারের মতো দূরপাল্লার বাস চলাচল করে। ঈদে এই সংখ্যা বেড়ে যায়। এসব বাসের একটা বড় অংশই সন্ধ্যা থেকে ভোরের মধ্যে আসা-যাওয়া করে বলে পরিবহনমালিক-শ্রমিকেরা জানিয়েছেন।
ঈদ উপলক্ষে তিন টার্মিনালসহ গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে পুলিশের উপস্থিতি বেড়েছে। টার্মিনালগুলোতে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার নির্মাণ করেছে পুলিশ। জানতে চাইলে মহানগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের উপকমিশনার (পশ্চিম) লিটন কুমার সাহা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর অধীনে গাবতলী ও এর আশপাশের এলাকা। কিছু বিশৃঙ্খলা ও অব্যবস্থাপনা তাঁরা চিহ্নিত করেছেন। এখন বেশি পরিমাণে লোকবল দিয়ে সমাধানের চেষ্টা চলছে। আজ চাপ বাড়বে জানিয়ে তিনি বলেন, মানুষের যাতায়াত স্বাচ্ছন্দ্য করতে তাঁরা সবকিছু করবেন।
গতকাল প্রথম আলোর চারজন প্রতিবেদক ও তিনজন ফটোসাংবাদিক ঢাকার প্রবেশ ও বের হওয়ার স্থানগুলো ঘুরে দেখেছেন। গাবতলী থেকে যাতায়াত পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে গত মঙ্গলবার রাতেও।
গাবতলী: রাতের যাতায়াত কঠিন
মঙ্গলবার রাতে ও গতকাল সকালে গাবতলী ধরে যাতায়াতে বিড়ম্বনার চিত্র দেখা যায়। এই পথে দুটি মহাসড়কের যানবাহন চলাচল করে। একটা অংশ চলে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক ধরে, অন্য অংশ ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক ধরে। এই দুই পথে দেশের প্রায় ৪০টি জেলার সঙ্গে সরাসরি বাস যোগাযোগ আছে। কল্যাণপুর, দারুস সালাম, টেকনিক্যাল, মাজার রোড ও গাবতলী টার্মিনাল থেকে এসব বাস ছেড়ে যায়।
মঙ্গলবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে শ্যামলী থেকে তীব্র যানজট পাওয়া যায়। কল্যাণপুরে দেখা গেল, তিন লেনের সড়কের দুই লেনেই এলোমেলোভাবে অন্তত ৩০টি বাস রেখে যাত্রী তোলা হচ্ছে।
গাবতলী-সায়েদাবাদ পথের লোকাল বাসের চালক মো. আতাউল্লাহ বলেন, এই বিড়ম্বনা নিত্যদিনের। তবে ঈদে কয়েক গুণ বেড়ে যায়। বিশেষ করে ঈদের আগের দুই দিন এই পথে চলা কঠিন হয়ে পড়ে।
দারুস সালাম ও মাজার রোডেও প্রায় একই চিত্র দেখা গেছে। গাবতলী টার্মিনালের সামনের অংশ ফাঁকাই ছিল। কিন্তু আমিনবাজার সেতুতে ওঠার আগে পর্বত সিনেমা হলের সামনের মোড়ে যান চলাচলে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা গেল। সদরঘাট থেকে বেড়িবাঁধ হয়ে আসা ট্রাক আমিনবাজার সেতুর নিচ দিয়ে চলার কথা। কিন্তু সেগুলো উল্টো পথে, এলোপাতাড়ি চলতে দেখা যায়।
আমিনবাজার সেতু পার হওয়ার পর যাওয়ার পথ ফাঁকাই দেখা যায়। গাবতলী থেকে সাভার পর্যন্ত ২৩টি স্থান দেখা গেছে, যেখান দিয়ে ঘন ঘন যানবাহন এপার-ওপার হচ্ছে। অথচ এই পথের দূরত্ব মাত্র ১৪ কিলোমিটার। মঙ্গলবার রাতে শ্যামলী থেকে আমিনবাজারে যেতে দেড় ঘণ্টা লেগে যায়।
আমিনবাজার সেতু পার হওয়ার পর ঢাকামুখী পথেও ছিল তীব্র যানজট। এই জট গাবতলী থেকে ছয় কিলোমিটার দূরের বলিয়ারপুর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। কল্যাণপুর পর্যন্ত ধরলে জটের দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় প্রায় ১০ কিলোমিটার।
গতকাল সকাল আটটার দিকেও ঢাকামুখী পথের জটের রেশ ছিল। সালেহপুর সেতু থেকে পর্বত সিনেমা হলের মোড় পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার অংশে জট হয়। এ সময় পর্বতের সামনে ভাঙা সড়কে পিচ ঢেলে মেরামত করতে দেখা যায়।
গাজীপুরের যানজটে আবদুল্লাহপুরে দুশ্চিন্তা
শেরপুর-ঢাকার পথে প্রতিদিন ১২ ঘণ্টায় বাস চালিয়ে একবার আসা-যাওয়া করতেন শাহী মণি পরিবহনের চালক মোজাম্মেল হক। কিন্তু সাত দিন ধরে তাঁর ঢাকা থেকে শেরপুর পৌঁছাতেই লাগছে ১০ ঘণ্টার বেশি। তিনি বলেন, উত্তরার আবদুল্লাহপুর থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পার হতেই লাগে চার ঘণ্টার বেশি। টঙ্গীর পর রাস্তা খুব খারাপ।
ট্রাফিক বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে প্রতিদিন প্রায় তিন হাজার বাস ছাড়ে। এর বেশির ভাগ আবদুল্লাহপুর হয়ে দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় যায়। এ ছাড়া নগরের বিভিন্ন পথের দেড় হাজার বাস-মিনিবাস আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত যাতায়াত করে। এর সঙ্গে অসংখ্য ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাসও চলে। এতে আবদুল্লাহপুর মোড়ে প্রায়ই যানজট হয়।
আবদুল্লাহপুরে ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক মো. মাহফুজুর রহমান বলেন, ঢাকা মহানগর ট্রাফিক পুলিশের সীমানা শেষ হয়েছে ধউড় সেতুর পূর্ব প্রান্তে। এই সেতুর ওপর প্রায়ই যানবাহন বিকল হয়ে পড়ে। এর ফলে সেখানে যানজট হয়।
আমাদের গাজীপুর প্রতিনিধি জানান, টঙ্গী সেতু থেকে গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত সাড়ে ১২ কিলোমিটার সড়কের বিভিন্ন অংশে খানাখন্দ দেখা গেছে। মেরামতের পরই আবার তা গর্ত হয়ে যাচ্ছে।
মালেকের বাড়ি এলাকায় বাসচালক ইদ্রিস আলী বলেন, মহাসড়কে যানজটের এখন মূল কারণ পানি জমে থাকা। বৃষ্টি হলেই রাস্তায় পানি জমে থাকছে, এতে যানজট হচ্ছে।
নাওজোড় হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল হাই বলেন, কুনিয়া, মালেকের বাড়ি এলাকায় খানাখন্দ, বাসন সড়ক, ভোগড়া বাইপাস এলাকায় মহাসড়কের পাশে বৃষ্টির পানি জমে থাকায় গত কয়েক দিন যানজট ছিল। তবে গতকাল কোথাও যানজট হয়নি।
জলাবদ্ধতা ও গর্ত যাত্রার দুঃখ
সায়েদাবাদ টার্মিনালে গিয়ে দেখা গেল, ঈদযাত্রার তেমন চাপ নেই। এখান থেকে চলাচল করা বাসের অগ্রিম টিকিটও ছাড়া হয়নি। টার্মিনাল থেকে এগিয়ে দেখা যায়, যাত্রাবাড়ী মোড় পর্যন্ত যানবাহন চলছে ধীরে।
যাত্রাবাড়ী মোড় থেকে কাজলার পেট্রলপাম্প পর্যন্ত মেয়র মোহাম্মদ হানিফ উড়ালসড়কের নিচের সড়ক বেহাল। জলাবদ্ধ ও খানাখন্দের সড়কে চলছে সংস্কারকাজ। ফলে নিচ দিয়ে সরু পথে যানগুলোকে চলতে হচ্ছে ধীরগতিতে, যানজটে আটকে থেকে। কাজলা গেলেই প্রশস্ত সড়কে সাইনবোর্ড পর্যন্ত আর কোনো বাধা পড়ছে না।
কিন্তু ঢাকায় প্রবেশের পথে উড়ালসড়কের কাজলা প্রান্ত থেকে সড়ক সরু ও খানাখন্দের হওয়ায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। সময় গড়ানোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জট বাড়ছে।
সংস্কারকাজের বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ বিলাল বলেন, ডেমরা, চিটাগাং রোড এবং নারায়ণগঞ্জের তিনটি সড়ক সংস্কার করা হচ্ছে। প্রতিটি সড়ক এক কিলোমিটার করে তিন কিলোমিটার।
দুই জেলার নির্বাহী প্রকৌশলীকে কারণ দর্শানোর নির্দেশ
কর্তব্যে অবহেলার অভিযোগে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর গাজীপুরের নির্বাহী প্রকোশলী ডি এ কে এম নাহিন রেজা ও মানিকগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মুহিবুল হককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। গতকাল সকালে গাজীপুরের চন্দ্রা মোড়ে পুলিশের নিয়ন্ত্রণকক্ষ উদ্বোধন শেষে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এই নির্দেশ দেন।

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1227011/