২১ জুন ২০১৭, বুধবার, ৩:১৩

ঈদ সামনে রেখে চাঁদাবাজির মচ্ছব

ঈদকে সামনে রেখে সারা দেশে শুরু হয়েছে চাঁদাবাজির মচ্ছব। রাজধানীসহ বড় বড় শহর তো বটেই, পথেঘাটেও শুরু হয়েছে বেপরোয়া চাঁদাবাজি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে চাঁদাবাজি রোধে নানা ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হলেও বাস্তবে চাঁদাবাজি চলছেই। রাজধানীর ফুটপাথ থেকেই প্রতিদিন কয়েক কোটি টাকা চাঁদা আদায় হচ্ছে বলে ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন। 

ঈদকে সামনে রেখে প্রতি বছরের মতো এবারো শুরু হয়েছে ব্যাপক চাঁদাবাজি। ফুটপাথ থেকে শুরু করে মার্কেট-বিপণিবিতানেও এ চাঁদাবাজি চলছে। এসব ঘটনার থানায় কোনো অভিযোগ নেই। বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেছেন, অতীতের অভিজ্ঞতা হলো থানায় অভিযোগ করে লাভ হয় না; বরং যতটা কমে ম্যানেজ করা যায় সেটাই ভালো।
পরিবহন মালিক শ্রমিকেরা বলেছেন, ঈদকে সামনে রেখে পরিবহন সেক্টরে ব্যাপক চাঁদাবাজি শুরু হয়েছে। উত্তরবঙ্গ থেকে একটি ট্রাক ঢাকায় আসতে ১৮০০ থেকে ২২০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হচ্ছে। মালিক-শ্রমিক ইউনিয়নের নামেই বেশির ভাগ চাঁদা উত্তোলন হচ্ছে বলে অভিযোগ মিলেছে। একাধিক মালিক ও শ্রমিক বলেছেন, বগুড়ায় শ্রমিক ইউনিয়নের নামে আদায় করা হচ্ছে ৪৫০ টাকা, রাজশাহীতে আদায় করা হচ্ছে সাড়ে ৪০০ টাকা, টাঙ্গাইল বাইপাস এলাকায় আদায় করা হচ্ছে ১৭০ টাকা। এভাবে মহাসড়গকের বিভিন্ন স্থানে চাঁদা আদায় হচ্ছে। খুলনা ও বরিশাল থেকে একটি গাড়ি ঢাকায় আসতে বিভিন্ন স্থানে এক হাজার টাকার ওপরে চাঁদা দিতে হয়। বরিশালের রূপাতলী, মেডিক্যাল মোড়, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও ভাঙ্গায় চাঁদা দিতে হয়। বাড়তি টোল দিতে হয় ফেরিঘাটে। ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের সায়েদাবাদ, শিমরাইল, কাঁচপুর ব্রিজের দুই পাড়ে এবং তারাবো এলাকায় চাঁদা দিতে হয় বলে একাধিক পরিবহন শ্রমিক বলেছেন। কাচপুরের ওপারে ১০০ টাকা, এপারে ৭০ টাকা, তারাবোতে ১০০ টাকা চাঁদা দিতে হয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়। ঢাকা-কুমিল্লা রুটের সায়েদাবাদ এলাকায় মুকুল নামে একজন চাঁদা আদায় করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
পরিবহন শ্রমিক নেতা আলী রেজা বলেছেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিবহন সেক্টরে ঈদকে সামনে রেখে চাঁদাবাজি চলছে। কোনো কোনো এলাকায় পুলিশও চাঁদাবাজি করছে বলে তিনি অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, এই চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে। না হলে পরিবহন সেক্টরে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। তিনি বলেন, ঈদ এলেই ফেরিঘাট ও টোল প্লাজায় বাড়তি চাঁদাবাজি শুরু হয়ে যায়। পরিবহন মালিক-শ্রমিকেরা তখন চরম বিপাকে পড়েন।
তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ডে তিনটি সংগঠনের নামে চাঁদাবাজি শুরু হয়েছে বলে মালিক-শ্রমিকেরা অভিযোগ করেছেন। ভুক্তভোগীরা বলেছেন, ট্রাকস্ট্যান্ডে ঢুকতে এবং বের হতে গড়ে ৩০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। কাওরানবাজার এলাকায় কয়েকটি গ্রুপ পাল্লা দিয়ে চাঁদাবাজি করছে। এখানে ট্রাক থেকে শুরু করে রিকশাভ্যান পর্যন্ত চাঁদাবাজির শিকার। স্থানীয় সূত্র জানান, ভোরে এখানে দাঁড়ালেই প্রকাশ্যে চাঁদাবাজির দৃশ্য চোখে পড়বে।
পরিবহন শ্রমিক নেতা মাহমুদুল আলম মন্টু বলেছেন, পরিবহন সেক্টরে চাঁদাবাজি চলছে। চাঁদাবাজি রোধে তিনি সংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
পরিবহন মালিক নেতা রুস্তম আলী খান বলেছেন, চাঁদাবাজি বিভিন্ন জায়গায় হচ্ছে। ঈদকে সামনে রেখে চাঁদাবাজি বাড়ে। বেশির ভাগ ঘটনার সাথে পুলিশ জড়িত বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের লোকজনও কোথাও কোথাও চাঁদাবাজি করছে।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ফুটপাথ থেকে যারা নিয়মিত টাকা আদায় করছে তারা বরাবরই বহাল তবিয়তে। অভিযোগ রয়েছে, তাদের সাথে পুলিশের কিছু সদস্যের সখ্য থাকায় চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিভিন্ন স্থানে লাইনম্যানরা চাঁদা উত্তোলন করে তা বিভিন্ন মহলে ভাগ করে দেয়। রাজধানীর পল্টন এলাকার ফুটপাথের লাইনম্যানদের সর্দার হচ্ছে বাবুল, আর ক্যাশিয়ার হলো দুলাল ও আমিন। বঙ্গবন্ধু এভিনিউর হামদর্দের সামনে চাঁদা আদায় করছে সাবেক সরদার সালাম। সুন্দরবন স্কোয়ার মার্কেটের উত্তর পাশে জজ মিয়া ও ভোলা, আল মনসুরের পূর্ব পাশে খোরশেদ ওরফে বড় মিয়া, শহীদ ও তার ভাই হাসান, রেলওয়ে মার্কেটের পশ্চিম পাশে সুলতান, রমনা ভবনের পশ্চিম ও উত্তর পাশে মনির ও তৌহিদ, রাজধানী হোটেল ও সিঙ্গারের সামনে শ্রী বাবুল, রব, আহাদ পুলিশ বক্সের উত্তর পাশে লম্বা হারুন, পশ্চিম পাশে কানা সিরাজ, কাপ্তান বাজার এলাকায় জয়নাল, ভাসানী স্টেডিয়ামের পশ্চিম পাশে আব্দুল আলী, বায়তুল মোকাররম দক্ষিণ গেটে আব্দুল কাদের ও খলিল, পশ্চিম পাশে কোটন, স্বর্ণ মার্কেটের সামনে চাটগাইয়া হারুন ও জাহাঙ্গীর, উত্তর পাশে সাজু, জিপিওর দক্ষিণ পাশে দাঁড়িওয়ালা সালাম, বাসসের সামনে আবুল হাশেম কবির, ক্রীড়া ভবনের সামনে নুরু, হাউজ বিল্ডিংয়ের সামনে দুলাল, আলম, বঙ্গবন্ধু এভিনিউর বেল্টের গলিতে কালা নবি, পূর্ণিমার সামনে আক্তার ও জাহাঙ্গীর, মতিঝিল এলাকায় ৩০টি ফুটের নিয়ন্ত্রণ নাসির ওরফে ফেন্সি নাসির বাহিনীর হাতে বলে হকাররা জানান। এই এলাকার ক্যাশিয়ার কালা কাশেম। আলিকোর সামনে চাঁদা আদায় করছে সাদেক, সোনালী ব্যাংকের সামনে মকবুল, রূপালী ব্যাংকের সামনে তাজু ও তার ছেলে, সেনাকল্যাণের সামনে গাঞ্জুটি হারুন, ফারুক, বলাকার সামনে নুরুল ইসলাম নুরু, আইডিয়ালের সামনে সাইফুল, মোল্লা নাসির শাহজাহান ও মোহর আলী। কোতোয়ালি এলাকায় সর্দার হলো কণ্ডু। ওয়াইজঘাট এলাকায় চাঁদা নিচ্ছে নুরু মোল্লা, পাখি ও কালু, কোর্টকাচারি এলাকায় সফিক, নয়াবাজারে মন্টু, কালু, সফি ও আজম। সূত্রাপুর এলাকার কাপ্তান বাজারে সেকেন্দার, হাই, সাজু ও বিষু। যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা এলাকার সর্দার হচ্ছে সোনামিয়া। অন্যান্যের মধ্যে আছে তোরাব আলী, জুলমাত, আবুল কালাম ও মান্নান। কদমতলী ও শ্যামপুর এলাকায় সর্দার হচ্ছে সিরাজ তালুকদার। এ ছাড়া অন্যান্যের মধ্যে রয়েছে নুরুল ইসলাম, তার ছেলে বাবু, হালিম, জাহাঙ্গীর, ফটিক, রহমান সরদার, ফারুক ও রহিম। শাহবাগ এলাকার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের দুই গেটে রফিক। অন্যান্য এলাকায় চাঁদা আদায় করছে সোহেল, হেদায়েত, ফজর আলী, কামাল, সোহেল, ওবায়েদ, হানিফ, বাবুল ওরফে গাইরা, দেলু ও শাজাহান। এদের বিরুদ্ধে থানায় মামলাও রয়েছে। কিন্তু কেউ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। আইডিয়ালের সামনে সাইফুল মোল্লা চাঁদা না পেলে হকারদের মারধর করে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। স্থানীয় সূত্র জানায়, মতিঝিল এলাকার এক পুলিশ কর্মকর্তা রয়েছেন, যিনি চাঁদাবাজদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।
বাংলাদেশ হকার ফেডারেশনের সভাপতি ও হকার্স লীগের সভাপতি এম এ কাশেম বলেছেন, ফুটপাথ নিয়ন্ত্রণ করে লাইনম্যানরা। লাইনম্যান নামক চাঁদাবাজরাই হকার বসায়। একজন হকার বসাতে পারলেই লাইনম্যানের দিনে ১০০-২০০ টাকা উপার্জন। তিনি বলেন, চাঁদা এখন দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া সেলের ডিসি মাসুদুর রহমান বলেন, চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ থাকলে অবশ্যই পুলিশ ব্যবস্থা নেবে।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/230218