২১ জুন ২০১৭, বুধবার, ৩:১২

লাগামহীন চালের বাজারে উত্তরাঞ্চলের স্বল্প আয়ের মানুষ দিশেহারা

পাইকারি ব্যবসায়ীরা দুষছেন মিলার সিন্ডিকেট ও ধানের উৎপাদন কম হওয়াকে ; মিলাররা এলসির ২৯ ভাগ ট্যাক্স তুলে দিতে বলছেন

রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলে চালের দাম এখন লাগামহীন। প্রতিদিনই বাড়ছে দাম। এতে কঠিন সঙ্কটে পড়েছেন স্বল্প আয়ের মানুষ। এমনিতে এক কেজি মোটা চাল কিনতে হচ্ছে তাদের ৫০ টাকার বেশি দিয়ে। ৫০ টাকার নিচের চাল কিনলে তা দুর্গন্ধে খাওয়া যায় না। তার ওপর ঈদ। প্রতিটি বাড়ির কর্তাব্যক্তিদের জন্য এই দাম মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো। পাইকারি ব্যবসায়ীরা চালের মূল্যবৃদ্ধির জন্য দুষছেন মিলার সিন্ডিকেট ও ধানের উৎপাদন কম হওয়াকে। আর মিলাররা বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য এলসির ২৯ ভাগ ট্যাক্স তুলে দেয়ার আবদার করছেন। যদিও খাদ্য বিভাগ বলছে, প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি চাল মজুদ আছে। মিলার ও অসাধু ব্যবসায়ীদের কারণেই মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে চলছে মনিটরিং। ব্যবসায়ী নেতারাও বলছেন সিন্ডিকেটের কারণেই চালের দাম চড়া। এ জন্য প্রয়োজন সরকারি নীতিমালার পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের মানবিক হওয়ার কথা। নয়া দিগন্তের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এসব তথ্য।
রংপুর বিভাগের অন্যতম চালের আড়ত মাহিগঞ্জ ও সিটি বাজার। সোমবার এ দু’টি বাজারে পাইকারি পর্যায়ে ৮৪ কেজি ওজনের মোটা চালের বস্তা ২৮২০ থেকে ২৮৭০ টাকা, ২৮ নম্বর মোটা চাল ৩২০০ থেকে ৩৪০০ টাকা এবং ৫০ কেজি ওজনের মিনিকেট চালের বস্তা ২৪০০ থেকে ২৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সে হিসাবে মোটা চালের পাইকারি বাজার কেজি প্রতি ৩৪ টাকা থেকে ৪৩ টাকা এবং মিনিকেট চিকন চাল ৫০ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। আর খুচরা বাজারে গিয়ে এই মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৩ থেকে ৬০ এবং চিকন চাল ৬৫ থেকে ৭৫ টাকায়।
মাহিগঞ্জ বাজারে কথা হলে সবজি বিক্রেতা আব্দুল আলিম জানান, আমরা সাধারণ মানুষ দিশেহারা। মোটামুটি যে চালের ভাত খাওয়া যায় তা কিনতে গেলে প্রতি কেজি টাকা লাগে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। ৫০ টাকার নিচে যে চাল পাওয়া যায় সেটা খাওয়া যায় না। গন্ধ করে।
নগরীর জাহাজ কোম্পানি মোড়ে রিকশাচালক মাহবুব জানান, সারা দিন কামাই করি ৩০০ টাকা। বাবা-মা, ভাইবোন ছেলেমেয়েসহ ১০ জনের সংসারে চাল লাগে ৪ কেজির ওপরে। যে টাকা পাই তা দিয়ে চাল কিনলে তরকারি কিনতে পারি না। চালের কেজি ৫৫-৬০ টাকা। মাছ গোশত তো দূরের কথা। এখন ঈদও এসেছে। পোশাক কিনি কেমন করে।
নগরীর টার্মিনাল এলাকায় কথা হলে অটো শ্রমিক আকবর আলী জানান, ৫০ টাকা কেজির নিচের চাল কিনলে গন্ধে সে চাল খাওয়া যায় না। ৬০ টাকা কেজি কিনলে মোটামুটি খাওয়া যায়। আমার যে কামাই ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা।
নগরীর কামারপাড়ার বাসিন্দা কলেজ শিক্ষক মাহমুদুর রহমান জানান, চালের দামটা অস্বাভাবিক। সরকারের উচিত এটা মনিটরিং করা। যারা মজুদ করছেন বা চালের দাম বাড়াচ্ছেন তাদের ওপর যদি সরকার নজরদারি করত তা হলে হয়তো চালের দাম কমে যেত।
কৃষি শ্রমিক আকবর আলী জানান, সরকারের কাছে আমাদের একটাই দাবি, ধান চালের দাম কমাতে হবে। সব কিছু ন্যায্যমূল্যে দিতে হবে।
রোকেয়া বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ড. তুহিন ওয়াদুদ জানান, চালের বাজার বেশি হওয়ায় উচ্চবিত্তরা ভালো আছেন। নিম্ন, মধ্য ও ফিক্সড আয়ের মানুষের অবস্থা একেবারেই শোচনীয়। চালের দাম বৃদ্ধি এতটাই লাগামহীন হয়েছে যে লাগাম টেনে ধরা দরকার।
চালের দাম নিয়ে যখন সাধারণ মানুষের এমন প্রতিক্রিয়া তখন পাইকার, মিলার ও সরকারের তেমন একটা ভ্রƒক্ষেপ নেই। সাত দিন ধরে রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলে চালেরবাজার মনিটরিং করে দেখা গেছে, অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন চালেরবাজার চড়া এবং প্রতিদিন দর বাড়ছেই। সবাই আতঙ্কে আছেন। গরিব মানুষ চাল কিনতে পারছেন না। কিন্তু চালের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে পাইকারি ব্যবসায়ীরা দেখাচ্ছেন নানা যুক্তি।
মাহিগঞ্জের বৃহৎ পাইকারি চাল বিক্রেতা শাওন জানান, যেসব ধান বাজারে আছে তা বড় বড় অটো মিলাররা নিয়ে যাচ্ছেন। তারা ধান ভাঙ্গতেছে এবং চাল বাজারে দিচ্ছে। এ ছাড়াও এবার ধানে চিটা হওয়ায় আমদানি কম। এ কারণে বাজারে চালের দাম বেড়েছে। এতে বাজারে চালের বিক্রি কমে যাচ্ছে। নি¤œ আয়ের মানুষ চাল কিনতে পারছেন না।
মাহিগঞ্জের হক ট্রেডার্সের মালিক আব্দুল হক জানান, প্রতি বস্তা চালের দাম গত দুই-তিন দিনে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বেড়েছে। ধানের দাম বেশি সরবরাহও কম। সেকারণেই দাম বেড়েছে দাবি এই চাল ব্যবসায়ীর।
মিলন নামে এক পাইকারি বিক্রেতা জানান, সরকারের বিভিন্ন ধরনের কথাবার্তায় মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। অনেকের স্টক ছিল। সেগুলো ছেড়ে দিচ্ছেন। সরকার কখন কি প্রোগ্রাম দেয়। এ কারণে চালের দাম বেড়েছে।
বাংলাদেশ চালকল মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও রংপুর জেলার কোষাধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম বাবু বলেন, চালের দাম এখন অনেক চড়া। কৃষকেরা ২৪ টাকা রেটে ধানের দাম ধরে রেখেছে। এটাই উঠতি বাজারের কারণ। সরকারকে এই দ্বৈত নীতি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। হয় ধানের দাম কমাতে হবে। নয় চালের দাম বাড়াতে হবে। তিনি বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য পরামর্শ দিয়ে বলেন, এই পরিস্থিতিতে চালের উঠতি বাজার সামলানোর জন্য ইন্ডিয়া থেকে যে স্বর্ণা-৫ চাল আসতেছে তার ওপর ২৯ ভাগ ট্যাক্স মওকুফ করতে হবে।
এ দিকে চালের দাম বৃদ্ধির জন্য মিল কলকারখানার মালিকদের সিন্ডিকেটকেই দায়ী করলেন রংপুর মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের প্রেসিডেন্ট রেজাউল ইসলাম মিলন। তরুণ এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, ব্যবসায়ীদের কারণে চালের বাজার হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে বলে আমি মনে করি। মিল কলকারখানা যাদের আছে তাদের একটি শক্ত সিন্ডিকেট আছে। এই সিন্ডিকেটের কারণেই দাম বাড়ছে। আমরা ব্যবসায়ীরা সব সময়ে মুনাফার দিকে নজর দিই। তিনি বলেন, চাল ব্যবসায়ীদের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা করা দরকার।
চালের বাজারের যখন এমন পরিস্থিতি তখন খাদ্য বিভাগ বলছে তাদের মজুদ প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি। রংপুর আঞ্চলিক খাদ্য নিয়ন্ত্রক রায়হানুল কবির জানান, রংপুর বিভাগের আট জেলায় ৩৬ হাজার টন চাল এবং ৩৫ হাজার টন গমের মজুদ আছে আমাদের। এই মজুদ আগামী আগস্ট মাস পর্যন্ত চাহিদা মিটিয়েও অতিরিক্ত থাকবে। এর বাইরেও আমরা প্রতিদিন এক থেকে দেড় হাজার টন চাল মজুদ করছি। তাহলে চালের বাজার বৃদ্ধির কারণ কি এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, মিলার ও একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীই মূল্য বৃদ্ধির জন্য দায়ী। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
তবে ব্যবসায়ী নেতা ও খাদ্য বিভাগের ‘সিন্ডিকেটের কারণে দাম চড়া’ বিষয়টি অস্বীকার করেন মিল মালিকরা। বাংলাদেশ চালকল মালিক সমিতির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও রংপুর জেলার কোষাধ্যক্ষ নজরুল ইসলাম বাবু বলেন, মিল মালিকদের মজুদের ব্যাপারে মনিটরিং করা হচ্ছে সারা দেশে। ডিসি ফুডরা সব মিলে গেছেন। কোথাও তারা গিয়ে মজুদ পাননি। আমার অটোমেটিক মিলে ২ হাজার মেট্রিক টন ধান প্রতিদিন লাগে। কিন্তু আমার তা নেই। আমি মিল বন্ধ রেখেছি। সুতরাং সিন্ডিকেটের বিষয়টি ঠিক নয়।
পাইকারি ব্যবসায়ী, মিলার, ব্যবসায়ী নেতা ও খাদ্য বিভাগের পাল্টাপাল্টি এই বক্তব্যে সাধারণ মানুষের কোনো আস্থা নেই। তারা চান চালের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করে সাধ্যের মধ্যে নামিয়ে আনা হোক দাম।
এ ব্যাপারে রোকেয়া বিশ^বিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সদস্য মোরশেদ আলম জানান, সিন্ডিকেটের কারণেই চালের বাজার লাগামহীন। এই বাজার শক্তহাতে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে সরকারকে। রাজনৈতিক কমিটমেন্টও লাগবে বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য। তা হলে নি¤œ, মধ্য ও ফিক্সড আয়ের মানুষের মধ্যে খাদ্য নিরাপত্তা বিঘিœত হবে। মানবিক বিপর্যয় নেমে আসবে।


http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/230209