২১ জুন ২০১৭, বুধবার, ৩:০৬

অপহরণের পর মাকে ফোন

চাঁদা না দিলে ছেলের লাশ পাবে

রাজধানীতে নানা কৌশলে বাড়ছে চাঁদাবাজি

তোমার ছেলে কাউসার (২৮) এখন কদমতলীর হাজী লাল মিয়া সরকার রোডের বিক্রমপুর হাউসে আমাদের হাতে আটক আছে। ছেলেকে জীবিত পেতে হলে নগদ এক লাখ টাকা আমার বিকাশ নম্বরে দিতে হবে। চাঁদা না দিয়ে কোনো চালাকি করলে ছেলের লাশ পাবে। চাঁদাবাজ তাজুল ইসলাম ১৬ জুন এভাবেই ০১৭৬০-৯০৮০৭৬ নম্বর থেকে ফোন করে চাঁদা দাবি করে চকবাজারের দুলু বেগমের কাছে। ফোন পাওয়ার পর কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন দুলু বেগম। পরদিন রাতে তাজুলের দেয়া ০১৭২৪-২১১৭৯৭ নম্বরে বিকাশের মাধ্যমে ২০ হাজার টাকা পাঠান। কিন্তু এতে সন্তুষ্ট হয়নি চাঁদাবাজরা। আরও চাঁদার জন্য তরুণী চাঁদাবাজ সেলিনা আক্তার (২২) বেধড়ক মারধর করে কাউসারকে। ছিনিয়ে নেয় তার সঙ্গে থাকা নগদ ২১ হাজার ৩০০ টাকা। ১৮ হাজার টাকা মূল্যমানের একটি স্যামসাং মোবাইল ফোন সেট ছিনিয়ে নেয় অপর চাঁদাবাজ মো. শাহিন।
বিষয়টি কদমতলী থানা পুলিশকে জানালে সোমবার উদ্ধার করা হয় কাউসারকে। পাশাপাশি গ্রেফতার করা হয় সেলিনা আক্তারকে। অন্যরা পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় দুলু বেগম বাদী হয়ে সেলিনা, তাজুল এবং শাহিনের নাম উল্লেখ করে এবং ৭-৮ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে সোমবার কদমতলী থানায় মামলা করেন।
মঙ্গলবার সেলিনাকে আদালতে হাজির করে ৭ দিনের রিমান্ড চাওয়া হলে আদালত রিমান্ড নামঞ্জুর করে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সেলিনা পুলিশকে জানিয়েছে, প্রেমের ফাঁদে ফেলে তার নেতৃত্বেই কাউসারকে অপহরণ করা হয়। উদ্দেশ্য ছিল মোটা অঙ্কের চাঁদা আদায়। প্রাথমিকভাবে দাবি করা এক লাখ টাকা পাওয়া গেলে কাউসারের পরিবারের কাছে আরও টাকা দাবি করা হতো।
জানা যায়, ঈদকে সামনে রেখে রাজধানীতে নানা কৌশলে সক্রিয় চাঁদাবাজরা। কখনও পুলিশ, কখনও সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে, কখনও ভ্রাম্যমাণ আদালত বা আগ্নেয়াস্ত্রের ভয় দেখিয়ে চাঁদা দাবি করছে তারা। এ ছাড়া প্রেমের ফাঁদে ফেলে আটকের পরও চাঁদা আদায় করছে। চাঁদা না পেয়ে গুলির ঘটনাও ঘটাচ্ছে চিহ্নিত চাঁদাবাজরা। নগদ টাকা না পেলে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মূল্যবান জিনিসপত্রও নিয়ে যাচ্ছে চাঁদা হিসেবে।
চাঁদাবাজদের হাত থেকে উদ্ধার কাউসারের মা দুলু বেগম জানান, চাঁদাবাজরা তার ছেলেকে তিন দিন চার রাত আটকে রেখে ভয়াবহ নির্যাতন করেছে। তার সারা শরীরে জখম রয়েছে। হাত-পায়ের অবস্থা খুবই খারাপ। উদ্ধারের পর তাকে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, তার বাসা চকবাজারের কামালবাগে। ছেলে কাউসার সিঙ্গাপুরে থাকত। সেখানে থাকা অবস্থায় মিসড কলের মাধ্যমে সেলিনার সঙ্গে পরিচয় হয়। এরপর কৌশলে সে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে। সেলিনার বাসা কামরাঙ্গীরচরে। ২৮ এপ্রিল কাউসার দেশে আসার পর তার সঙ্গে সেলিনা মোবাইল ফোনে প্রায়ই কথা বলত। ১৫ জুন দুপুরে ভিসা সংক্রান্ত কাজে কাউসার তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকায় যায়। ওই সময় ফোন করে কাউসারের সঙ্গে দেখা করতে চায় সেলিনা। পরে তেজগাঁও তিব্বত এলাকায় এসে সেলিনা কৌশলে কাউসারকে সিএনজিতে তুলে নেয়। পরে কদমতলী এলাকায় নিয়ে তার সহযোগীদের মাধ্যমে বিক্রমপুর হাউসে আটকে রেখে চাঁদা দাবি করে।
কদমতলী থানার এসআই ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দিপংকর মণ্ডল জানান, প্রেমের ফাঁদে ফেলে সেলিনা এর আগে আরও অনেক চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটিয়েছে বলে পুলিশের কাছে তথ্য আছে। কিন্তু সে জানিয়েছে, এটিই তার প্রথম ঘটনা। বিস্তারিত জানতে তাকে রিমান্ডে নেয়ার আবেদন করা হয়ছিল। যেহেতু রিমান্ড হয়নি, তাই জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে তার কাছ থেকে অধিকতর তথ্য জানার চেষ্টা করা হবে।
এদিকে যাত্রাবাড়ীর মাতুয়াইল মাঝপাড়া এলাকার হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার মোস্তাক আল রুবিন জানান, তিনি মাতুয়াইলের মাসুদ ফার্মকো লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কর্মরত। ১ জুন দুপুরে ৭-৮ জন লোক তার কারখানায় গিয়ে নিজেদের সিআইডি এবং সাংবাদিক বলে পরিচয় দেয়। তাদের মধ্যে আশিক সরকার নামে একজন নিজেকে জেটিভির ক্রাইম রিপোর্টার বলে পরিচয় দেয়। যদিও এই নামে কোনো টেলিভিশন চ্যানেল নেই। রাসেল দেওয়ান নামে একজন নিজেকে সিআইডি কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে বলে, ‘আপনার প্রতিষ্ঠানে অবৈধ স্প্রিট আছে। আমাদের দুই লাখ টাকা দিতে হবে। টাকা না দিলে অস্ত্র মামলায় ফাঁসানো হবে। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটি সিলগালা করা হবে। ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের মালিককে ২০ লাখ টাকা জরিমানা করা হবে এবং ১০ বছরের জেল দেয়া হবে।’
মোস্তাক আল রুবিন বলেন, ‘চাঁদাবাজদের ভয়ে একপর্যায়ে আমি তাদের ১৭ হাজার টাকা দিই। পরে তারা বাকি টাকা রেডি রাখার নির্দেশ দিয়ে চলে যায়। ৭ জুন সকালে তারা আবার চাঁদার জন্য আসে। আমার কাছে আরও এক লাখ ৮৩ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করলে আমি চিৎকার শুরু করি। এ সময় তারা দৌড়ে পালাতে গেলে আশপাশের লোকজন এসে রাসেল দেওয়ানকে আটক করে।
বংশালের শরৎ চন্দ্র চক্রবর্তী রোডের মোজাম্মেল হক লিটন বলেন, ‘স্থানীয় চাঁদাবাজ রবিন তার ২-৩ জন সহযোগী নিয়ে ৫ জুন আমার প্রতিষ্ঠানে এসে ঈদ উপলক্ষে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করে। দিতে অস্বীকৃতি জানালে পিস্তল ঠেকিয়ে ৩০ হাজার টাকা মূল্যমানের বিজি মোটর মেশিনের দুটি বক্স/কার্টন নিয়ে যায়।
মহাখালীর মো. আজাদ জানান, চাঁদা না দেয়ায় ১৩ জুন মহাখালীর ৭ তলা বস্তিতে তার ভাই শামীম আহমেদকে গুলি করে চাঁদাবাজরা। এলাকার চিহ্নিত চাঁদাবাজ শিমুল, লিটন, মনির, মল্লিকসহ কয়েকজন তাদের কাছ থেকে নিয়মিত চাঁদা নিত। কিছুদিন আগে তাদের এক লাখ টাকা চাঁদা দেয়া হয়েছিল। ঈদ উপলক্ষে তারা আবারও এক লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে চাঁদাবাজরা বাসায় ঢুকে শামীমকে গুলি করে।
বংশালের মো. রিয়াজ জানান, ২ নম্বর মালিটোলা রোডে ‘নিউ বিসমিল্লাহ বিরানি’ নামে তার একটি হোটেল আছে। ২১ মার্চ চাঁদাবাজ দেলোয়ার হোসেন এবং নাসির উদ্দিন তার হোটেলে প্রবেশ করে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই নাসির তার হাতে থাকা ক্যামেরা দিয়ে খাবার হোটেলের ছবি তুলতে থাকে। একপর্যায়ে রিয়াজকে ধমক দিয়ে বলে ‘রান্নাঘরের পাশে বাথরুম কেন? আমরা রিপোর্ট করে দিলে তোর কমপক্ষে এক লাখ টাকা জরিমানা হবে। ম্যাজিস্ট্রেট নিয়ে এসে মোবাইল কোর্ট করে তোকে গ্রেফতার করব। আমাদের ২০ হাজার টাকা দিলে তোকে বাঁচিয়ে দেব।’ রিয়াজ বলেন, ‘আমি ভয়ে তাদের হাতে তিন হাজার টাকা তুলে দিই।’ এ টাকা নেয়ার পর দেলোয়ার এবং নাসির হুমকি দেয়, ‘২৫ রোজায় আসব। ঈদের টাকা রেখে দিবি।’ এরপর তারা ওই ভবনের ৬ষ্ঠ তলায় অবস্থিত বাউফল হোটেলে গিয়ে হোটেল মালিক মফিজুর রহমানের কাছ থেকে একই কায়দায় দুই হাজার টাকা নেয়। পরে তারা নিচে নেমে পাশের মিরিয়ানা হোটেলেও চাঁদা আদায়ের চেষ্টা চালায়।
এ ব্যাপারে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারের উপকমিশনার মাসুদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, চাঁদাবাজদের তৎপরতা শক্ত হাতে দমন করা হচ্ছে। যেখানেই কোনো ধরনের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে সেখানেই ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। মামলা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আসামিদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।

http://www.jugantor.com/last-page/2017/06/21/134260/