২১ জুন ২০১৭, বুধবার, ২:৪০

দলীয় পরিচয়ে নিয়োগ অনৈতিক ও ক্ষতিকর

১১ জুন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) অডিটোরিয়ামে ছাত্রলীগের বর্ধিত সভা ও প্রশিক্ষণ কর্মশালার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘তোমরা অপকর্মে লিপ্ত হবে না। টাকার দরকার হলে আমার কাছে এসো। যখন ছাত্রত্ব শেষ করবে, চাকরি দরকার, আমার কাছে আসবে। এটা নেত্রী আমাকে বলে দিয়েছেন’ (যুগান্তর, ১২ জুন)। তিনি আরও বলেছেন, লিখিত পরীক্ষায় টিকতে হবে, তারপর তিনি প্রত্যেকের (ছাত্রলীগের) জন্য চেষ্টা করবেন। জনাব ওবায়দুল কাদের তার দলের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের অপকর্মে লিপ্ত না হতে যে পরামর্শ দিয়েছেন তা অবশ্যই প্রশংসনীয়। কারণ এ ছাত্র সংগঠনটির অপকর্ম এখন শুধু ব্যবসায়ী সম্প্রদায় ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্যই বোঝা হয়ে দাঁড়ায়নি, বরং খোদ দলের জন্যও বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। আমাদের মতো দেশে ক্ষমতায় থাকলে টাকার অভাব হয় না। সুতরাং ওবায়দুল কাদের তার ‘সোনার ছেলেদের’ টাকা দিন তাতে আমাদের আপত্তি নেই। আমাদের আপত্তি তাদের অনৈতিকভাবে প্রজাতন্ত্রের চাকরি (প্রজাতন্ত্রের চাকরি বলতে সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিকে বোঝায়) দেয়া নিয়ে।


আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বিগত মহাজোট সরকার এবং বর্তমান সরকারের শাসনকাল পর্যালোচনা করলে এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না, দলটি তাদের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ ও এর সমর্থক প্রার্থীদের প্রজাতন্ত্রের চাকরিতে নিয়োগে অগ্রাধিকার প্রদানের তত্ত্বে বিশ্বাস করে এবং সে বিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে দলটির নেতারা রাখঢাক না করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের প্রজাতন্ত্রের চাকরিতে নিয়োগের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছেন এবং এখনও ধরছেন। ইতিপূর্বে প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টাও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের প্রজাতন্ত্রের চাকরিতে নিয়োগ প্রদানের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছিলেন। ২০১৪ সালের ১২ নভেম্বর ছাত্রলীগ আয়োজিত এক আলোচনা সভায় সংগঠনটির নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেছিলেন, ‘রাজনীতি করার কারণে তোমাদের সময় কম, আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন হিসেবে তাই আমাদের উচিত ছাত্রলীগের পাশে দাঁড়ানো। তাই তোমরা বিভিন্ন চাকরির লিখিত পরীক্ষা একটু ভালো করে দাও, বাকিটা আমরা দেখব।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা তোমাদের সঙ্গে আগেও ছিলাম, এখনও আছি। এখনও প্রধানমন্ত্রীর কাছে যখনই কারও বায়োডাটা নিয়ে যাই, তখনই তিনি জিজ্ঞেস করেন, সে কি ছাত্রলীগ করেছে? কোথায় করেছে? কোন পদে ছিল? তোমাদের চাকরি দিতে প্রধানমন্ত্রী ও আমি কম চেষ্টা করি না।’ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আমলে প্রধানমন্ত্রীর আরেক উপদেষ্টা ঘোষণা দিয়েছিলেন, দেশের স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোয় সৃষ্ট বিভিন্ন ক্যাটাগরির ১৩,৫০০টি পদ শুধু আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের প্রার্থীদের দিয়েই পূরণ করা হবে। ওই আমলে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ও নির্বাচনে জয়ী রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র বলেছিলেন, দল আমাকে নির্বাচিত করেছে, মেয়র হিসেবে দলের লোকদের নিয়োগ তো দেবই। তিনি আরও বলেছিলেন, বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় তিনি তার দলের লোকদের নিয়োগ দিয়েছেন এবং তাদের অনেককে স্থায়ীও করেছেন।

সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছ থেকে দলীয় পরিচয়ে কাউকে প্রজাতন্ত্রের চাকরিতে নিয়োগে সহায়তা প্রদানের আশ্বাস বা প্রতিশ্রুতি দেশের প্রচলিত আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আমাদের সংবিধানে বলা হয়েছে, বিশেষ বিধান প্রণয়নের মাধ্যমে নাগরিকদের কোনো অনগ্রসর অংশের প্রজাতন্ত্রের কর্মে উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভ, কোনো ধর্মীয় বা উপ-সম্প্রদায়গত প্রতিষ্ঠানে ওই ধর্মাবলম্বী বা উপ-সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তিদের নিয়োগ অথবা কোনো কর্মের বিশেষ প্রকৃতির জন্য তা নারী বা পুরুষের জন্য সংরক্ষণ ব্যতীত প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সব নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকবে (অনুচ্ছেদ ২৯)।

স্বাধীনতার পরপরই দলীয় বিবেচনায় প্রজাতন্ত্রের চাকরিতে লোক নিয়োগ দেয়া শুরু হলেও তা ছিল সীমিত। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর দু’জন সামরিক শাসক সামরিক ও বেসামরিক পোশাকে ১৫ বছর দেশ শাসন করেন। তাদের শাসনকালে গণতন্ত্র বিপদগ্রস্ত হলেও প্রজাতন্ত্রের চাকরিতে নিয়োগে যে কোনো প্রকার অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতি হয়নি এটা জোর দিয়ে বলা যেতে পারে। ১৯৯১-২০০৬ সময়কালে দেশের দুটি বড় দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ পালাক্রমে দেশ শাসনের দায়িত্বে থাকাকালে দলীয় বিবেচনায় প্রজাতন্ত্রের চাকরিতে নিয়োগের প্রসার ঘটতে থাকে। ২০০৭-২০০৮ সময়কালে সেনাসমর্থিত নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এ অনৈতিক কার্যকলাপ বন্ধ থাকে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের আমলে তা আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। মহাজোট সরকার এবং বর্তমান সরকারের আমলে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ সমর্থক প্রার্থীদের সরকারি চাকরিতে নিয়োগ প্রদান অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে বলে মনে করা হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের লোক না হলে অথবা ক্ষমতাসীন দলের কোনো ক্ষমতাধর ব্যক্তির সক্রিয় সহযোগিতা না পেলে অথবা মোটা অংকের ঘুষ না দিলে যে প্রজাতন্ত্রের চাকরি হতে পারে, জনগণ তা বিশ্বাস করতেই ভুলে গেছেন।

প্রশ্ন উঠতে পারে, দলীয় পরিচয়ে প্রজাতন্ত্রের চাকরিতে নিয়োগ অনৈতিক ও ক্ষতিকর কেন?

এক. ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনামলে প্রবর্তিত শাসনব্যবস্থা আমরা পেয়েছি উত্তরাধিকার সূত্রে। জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রে এ শাসনব্যবস্থার নীতি হল, উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে মেধাবী ও যোগ্য ব্যক্তিকে নিয়োগদান। আরেকটি নিয়ম হল, সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে নিয়োজিত ব্যক্তিদের চাকরিতে বহালের কোনো সম্পর্ক না থাকা এবং তাদের দলীয় প্রভাবমুক্ত রেখে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতা বজায় রাখা। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের সুফল বিভিন্ন মতাবলম্বী মানুষের কাছে পৌঁছাতে নিরপেক্ষ প্রশাসনের বিকল্প নেই।

কেউ কেউ যোগ্যতার প্রশ্নের ঊর্ধ্বে উঠে দলীয় পরিচয়ে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের সমর্থনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্পয়েলস সিস্টেমের (spoils system) উদাহরণ টানেন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্পয়েলস সিস্টেমের সীমিত প্রচলন আছে। এ পদ্ধতির সারবত্তা হল, ক্ষমতা লাভকারী রাজনৈতিক দলের সমর্থকদের যোগ্যতা বিচার না করে পুরস্কারস্বরূপ সরকারি চাকরি প্রদান। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে সপ্তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্র– জ্যাকসনের সময় এ পদ্ধতি চালু হয়। সরকারি চাকরিতে মেধা ও যোগ্যতা অবহেলিত হওয়ায় স্পয়েলস সিস্টেমের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়। এর ফলে উনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে মেধা মূল্যায়নের মাধ্যমে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের সুপারিশ প্রদানের জন্য আইন পাসের মাধ্যমে সিভিল সার্ভিস কমিশন গঠন করা হয়। স্পয়েলস সিস্টেম বর্তমানে মূলত ফেডারেল সরকারের উচ্চ পদগুলোতে নিয়োগের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

দুই. কেউ সপ্তাহে বেতন বা লাভের জন্য এক ঘণ্টা কাজ করলেও বেকার হিসেবে গণ্য হয় না- বেকারত্ব নির্ধারণে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) এ সংজ্ঞা অনুসরণ করে সরকারের পরিসংখ্যান বু্যুরো (বিবিএস) বলছে, দেশে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ। কিন্তু দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদ, সিপিডি, সুশীল সমাজ বেকারের এ সংখ্যা মানতে রাজি নন। তারা বলছেন, বেকারত্ব নির্ধারণে আইএলও’র সংজ্ঞা বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য নয়। সেটি উন্নত দেশের জন্য। তাদের মতে, দেশে মোট কর্মসংস্থানের ৮০ ভাগ চাহিদা পূরণকারী বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ স্থবির হয়ে পড়ায় নতুন করে কর্মসংস্থান হচ্ছে না। তাই দেশে বেকারের সংখ্যা সরকার নির্ধারিত সংখ্যার চেয়ে অনেকগুণ বেশি। আর যে বিষয়টি বিশেষভাবে লক্ষণীয় তা হল, শিক্ষিত ও উচ্চশিক্ষিত বেকারের আধিক্য। বিবিএসের লেবার ফোর্স সার্ভে ২০১০ থেকে দেখা যায়, নিরক্ষর, ১ম-৫ম শ্রেণী ও ৬ষ্ঠ-৮ম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে এমন যুবকদের বেকারত্বের হার যেখানে যথাক্রমে ২.৮২, ৩.৭৯ ও ৫.১৮ শতাংশ, সেখানে এইচএসসি, স্নাতকোত্তর/সমপর্যায়, ইঞ্জিনিয়ারিং/ মেডিকেল গ্রাজুয়েটদের বেকারত্বের হার যথাক্রমে ১৩.৭৪, ১০.২৫ ও ১৪.২৭ শতাংশ। বিপুলসংখ্যক শিক্ষিত বেকার যুবককে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে প্রজাতন্ত্রের চাকরিতে নিয়োগ না করে ক্ষমতাসীন দলের পরিচয়ে নিয়োগ প্রদান করা হলে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন এমন মেধাবী ও যোগ্য প্রার্থীরা চাকরি থেকে বঞ্চিত হবেন। এটা অন্যায় ও অবৈধ।

তিন. মেধাবী ও যোগ্য প্রার্থীরা চাকরি না পেলে রাষ্ট্র তাদের সেবা থেকে বঞ্চিত হয়। এতে রাষ্ট্রের সব স্তরে অদক্ষতা ও স্থবিরতা দেখা দেয়। ওবায়দুল কাদের সাহেবরা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ করে যে কথা বলেছেন তার সারমর্ম হল- লিখিত পরীক্ষায় যদি তারা পাস করে তাহলে মৌখিক পরীক্ষায় তাদের কোনো অসুবিধায় পড়তে হবে না। সরকার তাদের চাকরির ব্যবস্থা করবে। এমন ব্যবস্থায় ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ছাড়া অন্য কারও পক্ষে প্রজাতন্ত্রের চাকরিতে ঢোকা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। এতে প্রশাসনে দলীয়করণ আরও তীব্র আকার ধারণ করবে, যা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠানে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।

আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক

latifm43@gmail.com http://www.jugantor.com/window/2017/06/21/134313/