পাহাড়ধসে চাপা পড়া মাটি সরিয়ে একের পর এক মরদেহ তুলে আনছিলেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। ছবিটি গতকাল সকালে রাঙামাটি শহরের রাঙাপানি এলাকা থেকে তোলা n ছবিগুলো তুলেছেন—সুপ্রিয় চাকমা, জুয়েল শীল, বুদ্ধজ্যোতি চাকমা ও গিয়াস উদ্দীন
১৫ জুন ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১১:১২

তিন পার্বত্য জেলার ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার তালিকাও নেই

পাহাড়ধসে প্রাণহানি ঠেকাতে আগাম প্রস্তুতি ছিল না

পাহাড়ধসের ঝুঁকি রয়েছে এমন এলাকাগুলোর পূর্ণাঙ্গ তালিকা তিন পার্বত্য জেলা প্রশাসনের কাছে নেই। তাই পাহাড়ধসে প্রাণহানি ঠেকাতে প্রশাসনের সামগ্রিক প্রস্তুতিও ছিল না।

শুধু বর্ষা মৌসুমের আগে প্রতি জেলায় পৃথকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করা হয়। এবার তিন পার্বত্য জেলার দুটিতে সেই তালিকাও করা হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভৌগোলিক দিক থেকে বিশেষ এই অঞ্চলে বসতি স্থাপনের জায়গা নির্বাচন করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। যত্রতত্র বসতবাড়ি করা হলে তা বিপর্যয়ের কারণ হতে বাধ্য। তাই বৈজ্ঞানিক গবেষণা বা জরিপ করে বসতি স্থাপনের এলাকা চিহ্নিত করতে হবে।
প্রায় এক দশক ধরে পার্বত্য এলাকায় নিয়মিত ধস হচ্ছে। এ জন্য আশির দশক থেকে শুরু হওয়া যত্রতত্র বসতি স্থাপন, বন উজাড়কে মূলত দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, বৈজ্ঞানিকভাবে অনেক আগেই ঝুঁকির একটি ম্যাপিং করা উচিত ছিল। সেটি হলে এত প্রাণহানি হয়তো রোধ হতো।
এবারে পাহাড়ধসে তিন জেলার মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত রাঙামাটি। মোট নিহত ১৪০ জনের মধ্যে কেবল এই জেলায় গতকাল বুধবার পর্যন্ত মারা গেছেন ১০৫ জন। এ জেলায় ঝুঁকিপূর্ণ বসতির কোনো তালিকা নেই।

শহরতলির লেমুঝিরি আগাপাড়া এলাকায় পাহাড়ধসে নিখোঁজদের সন্ধানে উদ্ধারকাজে ব্যস্ত সেনাবাহিনীর সদস্যরা। ছবিটি গতকাল দুপুরে তোলা

এ বিষয়ে রাঙামাটির অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) প্রকাশ কান্তি চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, জেলা প্রশাসনের কাছে ঝুঁকিপূর্ণ বসতির কোনো তালিকা নেই। তবে সড়ক ও জনপথের (সওজ) কাছে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার একটি তালিকা আছে।
সওজের কাছে থাকা তালিকা মূলত তাদের অধীন রাস্তাঘাটগুলো নিয়ে। জনবসতির বিষয় এর অন্তর্ভুক্ত নয়। তাই সে তালিকা কতটুকু কার্যকর, এর জবাবে প্রকাশ কান্তি চৌধুরী বলেন, একটি তালিকা থাকলে ভালো। তবে এ মুহূর্তে বড় বিষয় উদ্ধারকাজ।

টেকনাফ : পাহাড়ধসে মারা যান বাবা-মেয়ে। ছবিটি গতকাল দুপুরে কক্সবাজারের টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের পশ্চিম সাতঘরিয়াপাড়া থেকে তোলা

তিন জেলার মধ্যে এবার পাহাড়ধসে সবচেয়ে কম প্রাণহানি হয়েছে খাগড়াছড়িতে। এই জেলার লক্ষ্মীছড়িতে একজন মারা গেছে। তবে গত দুই বছর জেলার পানছড়ি, রামগড়, মাটিরাঙ্গা, লক্ষ্মীছড়ি, গুইমারা, মহালছড়ি, মানিকছড়িসহ জেলা সদরের শালবাগান, কুমিল্লাটিলা, সবুজবাগ, মধ্য শালবন ও আদর্শপাড়ায় প্রায় সাড়ে চার শ পরিবারের বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বর্ষা শুরু হওয়ার পর কিছু এলাকায় মাইকিং করে সতর্ক করা হয় বলে জানান খাগড়াছড়ির অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) গোফরান ফারুকী। তবে জেলার কোন এলাকাগুলো পাহাড়ধসের ঝুঁকিতে আছে, তার তালিকা নেই বলে জানান তিনি। এমন তালিকার প্রয়োজনীয়তার কথা তিনিও বলেন।
বান্দরবানের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) দিদারে আলম মো. মাকসুদ চৌধুরী বলেন, প্রতিবছর দুর্যোগের মৌসুম শুরু হলে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার তালিকা তৈরি করা হয়। এবারও হয়েছিল। বৃষ্টি শুরু হওয়ার পর সে অনুযায়ী ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় মাইকিং করে লোকজনকে সরানো হয়েছে।
যে দুটো এলাকায় এবার পাহাড়ধস হয়ে প্রাণহানি হলো, তা কি জেলা প্রশাসনের তালিকায় ছিল? জবাবে মাকসুদ চৌধুরী বলেন, ‘না। আমাদের চরম ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মধ্যে ধস হওয়া এসব এলাকা ছিল না।’
২০০৭ সালে চট্টগ্রাম জেলায় পাহাড়ধসে ১২৭ জন নিহত হয়। এই ব্যাপক প্রাণহানির পর ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোর একটি তালিকা করা হয়েছিল বলে জানান দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. রিয়াজ আহমেদ। তিনি বলেন, এ তালিকা হালনাগাদ করা হয়নি। একটি তালিকা থাকলে হয়তো ভালো হতো। তবে এ বছর রাঙামাটিতে ৩৪৬ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এটা অস্বাভাবিক। তাই এবারের পাহাড়ধসের কারণ এই বৃষ্টিপাত।
অবশ্য দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রস্তুতি ছিল না বলে মনে করেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ গওহার নঈম ওয়ারা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রশাসনের কাছে ঝুঁকিপূর্ণ বসতির সমন্বিত তালিকা নেই। আবার ঝুঁকি সম্পর্কে মানুষকে জানানোর কোনো তাগিদও প্রশাসনের নেই। প্রশাসনের ব্যর্থতা ও সীমাবদ্ধতা পার্বত্য অঞ্চলের মানুষকে সীমাহীন দুর্যোগের মুখোমুখি করেছে। ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রশাসনের যে প্রস্তুতি ছিল না, এ বিপর্যয়ই তার বড় উদাহরণ।

http://www.prothom-alo.com/bangladesh/article/1218366/