১৫ জুন ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১০:৫৩

গাবতলী টার্মিনাল

চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্য অতিষ্ঠ যাত্রীরা

একেকটা বাস আসছে। আর ৫-৭ জনের দল ছুটে যাচ্ছে। ছোট পুঁটলা থেকে যেকোনো ধরনের মালামাল নিয়ে আসা যাত্রীকে ঘিরে ধরছে তারা। চাঁদা চাই। মালামালের চাঁদা। সর্বনিম্ন ২০ টাকা থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত। কারো কারো কাছে হাঁকাচ্ছে ২০০-২৫০ টাকা। ব্যাগ বা বস্তার সাইজ অনুযায়ী চাঁদার পরিমাণ নির্ধারণ করে তা আদায় করছে। শুধু ব্যাগ বা বস্তা নয়, দৃশ্যমান সব ধরনের মালামালের ক্ষেত্রেই আদায় করা হচ্ছে চাঁদা। পাখির খাঁচা, কাঠের জিনিসিপত্র, গৃহসামগ্রীও চাঁদার বাইরে নয়। এ নিয়ে বাক-বিতণ্ডায় জড়াচ্ছেন কেউ কেউ। গাবতলী টার্মিনালের এই চাঁদাবাজি একধরনের অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। তবে বাদ সাধেন নতুন যাত্রীরা। অনেক সময় তারা চাঁদা দিতে চান না। ফলে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন। পরে তাদেরকে দেখানো হয় সিটি করপোরেশনের একটি ফর্ম। বলা হয়, এই চাঁদা তারা সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে আদায় করছে। তবে সিটি করপোরেশন এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। সরজমিনে দেখা গেছে, গাবতলী টার্মিনালজুড়েই বিশাল এই চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট দিনভর সক্রিয়। পর্বত সিনেমা হল থেকে শুরু করে মাজার রোডের মধ্যে যেখানেই বাস থামুক সেখানেই চাঁদার সম্মুখীন হতে হয় যাত্রীদের। সিএনজি চালকদের কাছ থেকেও তারা চাঁদা আদায় করছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই এলাকায় অন্তত ৫০ জন চাঁদাবাজ বিচরণ করে। এছাড়া মাজার রোড থেকে টেকনিক্যাল পর্যন্ত রয়েছে আলাদা সিন্ডিকেট। এলাকাবাসী জানায়, এই চাঁদাবাজরা নেশাখোর। নেশার টাকা যোগাড় করতেই তারা চাঁদাবাজি করে। চাঁদা দিতে গড়িমসি করলে নানা ধরনের গালমন্দও শুনতে হয় যাত্রীদের। অনেক সময় হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে। পুলিশের সামনেই ঘটছে এসব ঘটনা। পুলিশ ও স্থানীয় নেতাদের ম্যানেজ করেই তারা এই চাঁদাবাজি করছে বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ।
জানা যায়, দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের ৩৮টি জেলার রাজধানীর প্রবেশমুখ গাবতলী বাস টার্িমনাল। প্রতিদিন লক্ষাধিক মানুষ এ টার্মিনাল দিয়ে ঢাকায় প্রবেশ করে। কিন্তু গাবতলীতে নামার পরই বিড়ম্বনা শুরু হয় তাদের। এসব যাত্রীদের কেউ এলাকা থেকে চাল, কেউ নিজের ক্ষেতের তরিতরকারী আবার কেউ বিছানাপত্র বা গৃহস্থালীর জিনিস বয়ে নিয়ে এসেছেন। কেউ নিজের জন্য আবার কেউ এগুলো নিয়ে এসেছেন আত্মীয়স্বজন বা সন্তানসন্ততির জন্য। তবে যে যেভাবেই আনুক বা যত সামান্য মালামালই হোক চাঁদা থেকে রেহাই নেই তাদের। না দিলে এসব মালামাল নিতে দেয়া হয় না। চাঁদাবাজরাই তার মালিক হয়ে যায়।
মঙ্গলবার বেলা ১২টা। এ সময় গাবতলী টার্মিনালে এসে পৌঁছায় নাবিল পরিবহনের একটি বাস। বাসটি থামতেই সেখানে ছুটে যায় ৮-১০ জন। এদের পোশাক-পরিচ্ছদ মলিন। কেউ কেউ লুঙ্গি পরিহিত। ১২-১৩ বছরের শিশুও রয়েছে। তাদের দু-একজন দাঁড়িয়ে যায় বাসের গেটে। আর বাকিরা অবস্থান নেয় বাসের মালামাল রাখার নির্ধারিত বক্সের পাশে। খালি হাতে যেসব যাত্রী আসে তারা নির্বিঘ্নে নেমে গেলেও মালামাল নিয়ে আসা যাত্রীদের তারা ঘিরে ধরে। বড় বস্তার জন্য দাবি করে ১৫০-২০০ টাকা। আর ছোট পুঁটলার জন্য ২০ টাকা। সাইজ অনুযায়ী ৪০, ৫০ ৬০, ৭০ বা ১০০ টাকা দাবি করছে। অধিকাংশ যাত্রীই নির্বিঘ্নে এই টাকা দিচ্ছে। কেউ কেউ দর কষাকষি করে টাকার অঙ্ক কমানোর চেষ্টা করছেন। তবে শেষমেশ মালামাল নিয়ে আসা সবাই এই টাকা দিতে বাধ্য হন। এছাড়া মালামাল নিয়ে যাত্রীরা যেসব সিএনজিতে যায় তার চালকের কাছ থেকেও চাঁদা আদায় করছে। প্রত্যেক সিএনজি চালকের কাছ থেকে তারা ২০ টাকা করে আদায় করছে। চাঁদা দেয়ার পর কথা হয়, এই বাসের এক যাত্রী সুজনের সঙ্গে। ২০ বছরের সুজন পেশায় গার্মেন্টকর্মী। ছোট একটি পুঁটলায় করে তিনি বাড়ি থেকে খাদ্যসামগ্রী নিয়ে এসেছেন। কিসের টাকা দিলেন, জানতে চাইলে এই গার্মেন্টকর্মী বলেন, এটা টার্মিনালের ভাড়া। কিছু নিয়ে আসলেই দিতে হবে। মাফ নেই। আমি প্রতিবারই দিই। তবে অনেক সময় বেশি দাবি করে। তখন দর কষাকষি করি। এলাকা থেকে খাঁচায় করে একটি টিয়া পাখি নিয়ে এসেছেন নীলফামারীর মমিন। তার কাছে ওই চক্র দাবি করে ১০০ টাকা। কিন্তু তিনি দিতে নারাজ। পরে ৫০ টাকায় মিটমাট করেন। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, কীসের টাকা এরা নিলো তা জানি না। দেখে তো মনে হয় নেশাখোর। কিন্তু না দিয়ে উপায় কি? আমার পক্ষে তো কেউ কথা বললো না। ষাটোর্ধ্ব জাকির হোসেন মোল্লা। তিনি আসেন নড়াইলের কালিয়া থেকে। হাতে ছোট একটি বাজারের ব্যাগ। তার কাছে টাকা দাবি করতেই তিনি বের করে দিলেন ২০ টাকা। তা নিয়েই চলে গেলো চাঁদাবাজরা। এই বৃদ্ধ জানান, তিনি মেয়ের বাসায় যাচ্ছেন। ব্যাগে রান্না করা দেশি মুরগি। চাঁদা দিলেন কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রতিবারই তো দিই। এই বৃদ্ধের সঙ্গে ছিলেন তার ভাতিজা। তার কাছে একটি বস্তা। তাতে কয়েকটা কাঁঠাল। তিনি দিয়েছেন ৫০ টাকা। এভাবে প্রতিদিনই যাত্রীদের বিড়ম্বনায় ফেলছে এই চাঁদাবাজরা।
টার্মিনাল এলাকার ব্যবসায়ীরা জানান, পুরো টার্মিনাল এলাকায় উজ্জ্বল, উদু ওরফে উদ্দা, বিপ্লব, মফিজ, রিশাত, সাত্তারসহ প্রায় ৫০-৬০ জন চাঁদাবাজ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এদের ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্বপালন করছে সবুজ। ব্যবসায়ীরা জানান, তাদের কোনো বৈধতা নেই। পুলিশে অভিযোগ দিলে অনেক সময় তাদের ধরে নিয়ে যায়। তবে একটু দূরে নিয়েই ছেড়ে দেয়। অনেক সময় না চিনে টার্মিনালে কর্মরতদের আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকেও টাকা আদায় করে। তখন হাঙ্গামা লেগে যায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী বলেন, কিছুদিন আগে এমন একটি ঘটনা ঘটেছিল। কয়েকজন মিলে এই চাঁদাবাজদের খুব পেটানো হয়েছিল। কিন্তু পরদিন থেকেই আবার তারা সক্রিয়। তিনি বলেন, যতদিন পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেবে ততদিন তাদের এ অপকর্ম চলবেই। ওই ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলতে বলতেই আরেকটি বাস এসে থামে। সঙ্গে সঙ্গে ব্যস্ত হয়ে পড়ে চাঁদাবাজরা। এরপর চাঁদা আদায়ের পর সেগুলো ভাগ করে। দেখা যায়, একেকজন ২০০ টাকা করে ভাগ পায়। এভাবেই তাৎক্ষণিকভাবে টাকা ভাগাভাগি দৃশ্যও দেখা যায়। গাবতলীর এক ওয়ার্কশপ ব্যবসায়ী জানান, জনপ্রতি প্রতিদিন ২ হাজার টাকার ওপরে এদের আয়। এ টাকা সম্পর্কে জানতে চাইলে জানান, এটা সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত ফি। সিটি করপোরেশনের কাছ থেকে টার্মিনালের ইজারা নেয়া মালিকদের প্রতিনিধি হিসেবে তারা কাজ করছেন। সরজমিনে দেখা গেছে, মাজার রোড থেকে টেকনিক্যাল পর্যন্তও আরো প্রায় ৪০-৫০ জন এধরনের চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত।
এ ব্যাপারে কথা হয় গাবতলী টার্মিনালে উত্তর সিটি করপোরেশনের অধীনে কুলি, মজুর ও টোল আদায়কারী বুথে বসে থাকা কর্মচারীর সঙ্গে। এই চাঁদাবাজদের প্রসঙ্গ তুলতেই অনেকটা আক্ষেপের সুরে বলেন, ওদের জন্য আমাদের অনেক বদনাম হচ্ছে। একাধিকবার তাদের মারপিটও করেছি আমরা। কিন্তু কোনো কাজ হয় না। তারা সিটি করপোরেশনের নামে ভুয়া একটি কাগজও তৈরি করেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই ব্যক্তি জানান, তারা সিটি করপোরেশনের কাছ থেকে সাব কন্ট্রাক্ট নিয়ে এই টার্মিনাল চালাচ্ছেন। তাদের অধীনে ১৫-২০ জন কুলি কাজ করে। যাদের প্রত্যেকের আইডি কার্ড করে দেয়া হয়েছে। কোনো কাজ করলেই কেবল তারা মজুরি পান। কিন্তু এই চাঁদাবাজরা তাদের কেউ না। তিনি আরো জানান, স্টান্ডে দাঁড়ানো প্রতিটি সিএনজির কাছ থেকে ৫ টাকা করে তাদের নির্ধারিত কুলিরা তুলে থাকেন। এছাড়া বাকি যারা তোলেন সেগুলো অবৈধ। কেবল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাই এ ব্যাপারে সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। এ ব্যাপারে দারুস সালাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সেলিমুজ্জামান বলেন, বিষয়টি জানা নেই। তবে এ রকম কিছু যদি হয়ে থাকে পুলিশ অবশ্যই অ্যাকশন নেবে। পুলিশ এই চাঁদার ভাগ পায় এমন অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, প্রশ্নই ওঠে না। তিনি এ ব্যাপারে স্থানীয় ও ভুক্তভোগীদের যোগাযোগ করারও পরামর্শ দেন।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=70038