১৫ জুন ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১০:৪৬

সংবাদপত্র শিল্পে কুঠারাঘাত

২০১৩ সালে সংবাদপত্রের কর্মীদের জন্য অষ্টম ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়নের সময় বেড়ে গেছে কাগজসহ অন্যান্য উপকরণের দাম, বেড়েছে বিদ্যুতের দামও। ফলে সংবাদপত্রের উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়েছে।

কিন্তু দাম বাড়েনি। বাড়েনি সংবাদপত্রের আয়ও। দেশে বেসরকারি বিনিয়োগে গতি না থাকায় এই খাত থেকে বাড়তি বিজ্ঞাপন পাওয়ার সুযোগও তৈরি হয়নি। উল্টো বিপুলসংখ্যক টেলিভিশন ও অনলাইন সংবাদমাধ্যম বিকশিত হওয়ার কারণে বেসরকারি বিজ্ঞাপন থেকে সংবাদপত্রের আয় কমেছে। ওয়েজ বোর্ড ঘোষণাকালে সরকারি বিজ্ঞাপনের মূল্যহার দ্বিগুণ করা হলেও ই-টেন্ডারিংয়ের কারণে পূর্ণ পৃষ্ঠার দরপত্র বিজ্ঞাপনের আকার এখন দুই কলাম দুই ইঞ্চিতে নেমেছে।
সংবাদপত্রশিল্পের রুগ্ণদশার এই সময়ে আবার উল্টোপথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে সরকার। আগামী ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে সংবাদপত্রের বিভিন্ন উপকরণ ও আয়ের ওপর বাড়তি শুল্ক-কর চাপানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। সংবাদপত্রের আয়ের অন্যতম খাত বিজ্ঞাপনের ওপর ৪ শতাংশ হারে অগ্রিম কর আগে থেকেই ছিল। বিজ্ঞাপনের ওপর নতুন করে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপসহ ছাপাখানায় ব্যবহৃত নানা উপকরণের ওপর শুল্ক-কর ও ভ্যাট আরোপ করা হচ্ছে। এতে সংবাদপত্রশিল্পের টিকে থাকাই মুশকিল হয়ে পড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
দুনিয়াজুড়ে সংবাদপত্রশিল্প ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বিভিন্ন দেশের বড় পত্রিকাগুলো সংস্করণ কমিয়ে দিচ্ছে, কর্মী ছাঁটাই করছে, খরচ কমাচ্ছে, সার্কুলেশন ও বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ থামিয়ে দিয়েছে। ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচতে যুক্তরাষ্ট্র, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি ও যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলোর সরকার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহায়তা দিচ্ছে তাদের বেসরকারি সংবাদপত্রগুলোকে। শুধু সাংবাদিকদের কর্মসংস্থান কিংবা সংবাদপত্র টিকিয়ে রাখা কিংবা সংবাদমাধ্যমের কাছ থেকে সমর্থন পাওয়ার জন্য দেশগুলোর সরকার যে এ শিল্পে সহায়তা করছে তা নয়; বরং জনগণের তথ্য ও বিনোদন পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে তথ্যভিত্তিক সমাজ গঠনের অংশ হিসেবে এসব উদ্যোগ নিচ্ছে দেশগুলো।
ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ড ও রয়টার্স ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অব জার্নালিজমের যৌথভাবে করা এক গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলো কর ছাড় দিয়ে সংবাদপত্রের করহার বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বোয়িংয়ের সমান করা হয়েছে। সংবাদপত্র বিক্রির আয়ের পাশাপাশি বিজ্ঞাপনের আয়কেও ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া প্রচারসংখ্যা বাড়ানো ও ব্যবস্থাপনা খরচকেও কর-ভ্যাট থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এভাবে প্রতিবছর ৯০ কোটি ডলারেরও বেশি রাজস্ব ছাড় দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
সংবাদপত্রসহ গণমাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সহায়তার ক্ষেত্রে সবার চেয়ে এগিয়ে ফিনল্যান্ড। দেশটি সংবাদপত্র বিক্রির আয় ছাড়াও বিজ্ঞাপন, নিউজপ্রিন্ট, ছাপাখানা ও ছাপাখানায় ব্যবহৃত সব ধরনের উপকরণকে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা দিয়েছে। এ ছাড়া সংখ্যালঘু বা আঞ্চলিক ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলোও ভর্তুকি পায় সে দেশে। ফ্রান্স নিবন্ধিত সংবাদপত্রগুলোর ওপর হ্রাসকৃতহারে ভ্যাট আরোপ করে, সংবাদপত্রে বিভিন্ন পদে কর্মরতদের কর অব্যাহতি সুবিধা দিচ্ছে। এ ছাড়া যেসব সংবাদপত্র কম বিজ্ঞাপন পায়, তাদের সরাসরি ভর্তুকি দেওয়ার পাশাপাশি আধুনিক ছাপাখানা স্থাপন ও নতুন প্রযুক্তি বিনিয়োগে সহায়তা করে ফ্রান্স। ইতালিও নিউজপ্রিন্ট, কম্পোজিশন ও ছাপাখানার ওপর হ্রাসকৃতহারে ভ্যাট নেয়। সংবাদপত্রশিল্পের নেওয়া ঋণের সুদেও ভর্তুকি দেয় দেশটি। এ ছাড়া সাংবাদিকরা সমবায়ের মাধ্যমে কোনো সংবাদপত্র প্রকাশ করলে সেখানেও ভর্তুকি দেয় ইতালি সরকার।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাজেট কেবল একটি দেশের সরকারের আয়-ব্যয়ের দলিল নয়; সরকার কোন কোন শিল্প খাত বিকাশের পথ রচনা করবে, কোন দিকে সুরক্ষা দেবে আর কোনটির বিকাশের পথ রুদ্ধ করবে তারও একটি পরিকল্পিত দলিল। সরকারের রাজস্বনীতি যেকোনো শিল্প খাতের সফলতা ও ব্যর্থতার পেছনে বড় ভূমিকা রাখে। ব্যবসা কিভাবে পরিচালিত হবে, কে কী হারে শুল্ক-কর পরিশোধ করবে তা নির্ধারণ করেন আইন প্রণেতারা বাজেট পাসের মাধ্যমে; কিন্তু এর কমবেশি প্রভাব পড়ে দেশের সব শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও প্রত্যেক মানুষের ওপর।
সংবাদপত্র কেবল একটি পণ্য নয়। সমাজ ও জাতিকে শিক্ষাদীক্ষায় অগ্রসর করার পাশাপাশি তাদের তথ্য জানার অধিকার নিশ্চিত করার দায়িত্বও সংবাদপত্রের। শুল্ক-করে ছাড় পাওয়ার মধ্য দিয়ে সংবাদপত্রগুলো যাতে আরো সংবাদ সংগ্রহের জন্য পুনর্বিনিয়োগ করতে পারে, সে জন্য উদ্যোগ নিয়েছে বিভিন্ন দেশ।
বাংলাদেশের শিল্পনীতিতেও সংবাদপত্রকে ‘শিল্প’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু অন্যান্য শিল্পের কাঁচামালের মতো সংবাদপত্রশিল্প তার প্রধান কাঁচামাল কাগজ, কালি, প্লেটসহ অন্যান্য উপকরণ শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানির সুযোগ পায় না, বরং নতুন প্রস্তাবিত বাজেটে নানাভাবে বাড়তি শুল্ক-কর আরোপের কথা বলা হয়েছে। এতে কেবল সংবাদপত্রশিল্পই সংকুচিত হবে না; সংবাদকর্মী থেকে শুরু করে ছাপাখানার শ্রমিক, ঢাকার রাস্তা থেকে গ্রামের বাজার পর্যন্ত পত্রিকা বিক্রি করা হকাররাও হুমকির মুখে পড়বে।
বাংলাদেশে সংবাদপত্রে বিনিয়োগ, বিকাশ ও কর্মসংস্থান রক্ষায় সরকারের কোনো ভূমিকা না থাকলেও ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়নের সঙ্গে সরকারি বিজ্ঞাপনের বর্ধিত হার পাওয়ার যোগসূত্র ছিল। ক্ষুদ্র ও মাঝারি মানের অনেক সংবাদপত্র শুধু সরকারি বিজ্ঞাপনের ওপর ভর করেই টিকে থাকত। তবে বিশ্বব্যাংকের পরামর্শে সরকার ই-টেন্ডারিং ও ই-জিপি (ইলেকট্রনিক গভর্নমেন্ট পারচেজ) শুরু করায় সংবাদপত্রের আয়ের অন্যতম বড় খাতটি সংকুচিত হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশের সংবাদপত্রে ব্যবহৃত নিউজপ্রিন্ট আমদানির ওপর ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক-কর পরিশোধ করতে হয়। সিঙ্গাপুরে নিউজপ্রিন্ট আমদানিতে শুল্ক নেই, ভ্যাট রয়েছে ৭ শতাংশ; কাতারে শুধু শুল্ক রয়েছে ৫ শতাংশ। চীনে ৭.৫ শতাংশ শুল্ক আছে নিউজপ্রিন্ট আমদানিতে।
পাশের দেশ ভারতে নিউজপ্রিন্ট আমদানির ওপর কোনো শুল্ক নেই। তা সত্ত্বেও সে দেশে সংবাদপত্রশিল্পে দুর্দশা চলছে। গত সরকারের দেওয়া ওয়েজবোর্ডে ভারতের সংবাদপত্র অফিসে কর্মরতদের বেতন বেড়েছে ৪৫ থেকে ৫০ শতাংশ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক গোলাম রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, বাংলাদেশে সংবাদপত্রশিল্প এমনিতেই খুব দুর্বল। ১৬ কোটি মানুষের দেশে মাত্র ২০ থেকে ২৫ লাখ সংবাদপত্র বিক্রি হচ্ছে। সংবাদপত্রের বহুল প্রচারের জন্য এ শিল্প ও তার উপকরণগুলোকে সম্পূর্ণভাবে ভ্যাট, শুল্ক ও কর থেকে অব্যাহতি দেওয়া প্রয়োজন। তা না করে উল্টো অগ্রিম কর, ভ্যাট ও শুল্ক আরোপের কথা বলা হয়েছে, যা খুবই হতাশাজনক। বাড়তি শুল্ক-কর আরোপে সংবাদপত্রের উৎপাদন খরচ আরো বাড়বে, তখন পত্রিকার দামও বাড়বে। সার্কুলেশন আরো কমবে। অনেক ছোট ও মাঝারি পত্রিকা বন্ধ হতে পারে, কর্মী ছাঁটাই হবে মূলধারার পত্রিকাগুলোতেও।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পন্থা হিসেবে দুনিয়ার সব দেশেই সংবাদপত্রশিল্প অন্য শিল্পের তুলনায় বাড়তি সুবিধা পায়। এ খাতের ওপর কর-ভ্যাট সব সময়ই কম রাখে সব দেশ। যুক্তরাষ্ট্র পোস্টাল আইনের মাধ্যমে ১৭৯২ সাল থেকে সংবাদপত্র সরবরাহে ট্যারিফ ছাড় দিয়েছে, যা দুনিয়ার সব দেশই অনুসরণ করে, যাতে পত্রিকা পাঠাতে খরচ কম হয়।
অধ্যাপক গোলাম রহমান আরো বলেন, সংবাদপত্র শুধু একটি পণ্য নয়, এটিকে সমাজ বিকাশের হাতিয়ার হিসেবে দেখা হয়। সংবাদপত্রশিল্প চাপে পড়লে সমাজের তথ্যপ্রবাহও বাধাগ্রস্ত হবে। এতে গণতন্ত্রের বিকাশও হুমকির মুখে পড়বে।
দৈনিক মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, সরকার ই-টেন্ডার, ই-জিপি ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছে। সরকারি বিজ্ঞাপন থেকে সংবাদপত্রগুলোর আয় কমে গেছে। এরপর প্রস্তাবিত বাজেটে যেভাবে বিভিন্ন উপকরণে শুল্ক ও ভ্যাট বসানোর প্রস্তাব করা হয়েছে, তাতে দেশের সংবাদপত্রশিল্পে বিপর্যয় নেমে আসবে। এটি কেবল সাংবাদিকতার জন্যই নয়, পুরো জাতির জন্যই দুর্ভাগ্যজনক।
তিনি বলেন, সংবাদপত্রে ব্যবহৃত নিউজপ্রিন্ট আমদানিতে ২৫ শতাংশ শুল্ক-কর পরিশোধ করতে হয়। ভারতে এ ক্ষেত্রে কোনো শুল্ক নেই। পাকিস্তানেও অনেক কম। বাড়তি খরচ এমন সময় চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যখন সরকারি বিজ্ঞাপনের মতোই বেসরকারি খাতের বিজ্ঞাপনও কমে গেছে। আগে সংবাদপত্রের আয়ের বড় উৎস ছিল মোবাইল ফোন অপারেটর কম্পানিগুলোর বিজ্ঞাপন। তারাও এখন বিজ্ঞাপন কমিয়ে দিয়েছে। অনেক মাল্টিন্যাশনাল কম্পানি বাংলাদেশের সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেওয়ার বদলে পাশের দেশের টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন প্রচার করছে। ফলে চারদিক থেকে সংবাদপত্র এমনিতেই অনেক চাপের মধ্যে রয়েছে। এই সময়ে বাড়তি কর ও ভ্যাটের চাপ বহনের সামর্থ্য এই শিল্পের নেই।
তিনি আরো বলেন, প্রতিবার বাজেট প্রণয়নের আগে সংবাদপত্র মালিকদের সংগঠন নোয়াবের সঙ্গে অর্থমন্ত্রী, এনবিআর চেয়ারম্যান বৈঠক করেন; এ শিল্পের দাবিদাওয়া ও দুর্দশার কথা শোনেন। কিন্তু এবার বাজেটে তিনি তার কিছুই রাখেননি, উল্টো আগে থেকে বহাল থাকা সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এবার ভ্যাট যেভাবে আরোপ করা হচ্ছে, তাতে পুরো খাতেই অস্থিরতা দেখা দেবে।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/06/15/509087