১৪ জুন ২০১৭, বুধবার, ১২:০৬

আবগারি শুল্ক বৃদ্ধি ও সুদ কম

ব্যাংকের আমানত যাচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ খাতে

আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়ন হলে ব্যাংকে লাখ টাকা রাখলেই নানা সার্ভিস চার্জ ছাড়াও ৮০০ টাকা আবগারি শুল্ক দিতে হবে। পাশাপাশি টিআইএন না থাকলে মুনাফার ওপর ১৫ শতাংশ আর টিআইএন থাকলে ১০ শতাংশ হারে কর তো আছেই। এ দিকে বিনিয়োগ স্থবিরতার কারণে আমানতের সুদ হার চার শতাংশে নেমে গেছে। এভাবে এখন কেউ ব্যাংকে ১০০ টাকা আমানত রাখলে বছর শেষে মূলধন টিকে রাখাই দায় হয়ে পড়েছে। এমনি পরিস্থিতিতে ব্যাংকের আমানত পুঁজিবাজারসহ ঝুঁকিপূর্ণ খাতে চলে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।
ব্যাংকারা জানিয়েছেন, এক দিকে ব্যবসায়-বাণিজ্যে স্থবিরতার কারণে ঋণ আদায় বাড়ছে না। বেশিরভাগ বড় গ্রহীতা ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। এতে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়ে গেছে। মার্চ শেষে এ খেলাপি ঋণ অবলোপনসহ প্রায় সোয়া লাখ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় ব্যাংকের তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। কারণ, যে ঋণ আটকে যাচ্ছে তার বিপরীতে আমানতকারীদের অর্থ মুনাফাসহ ঠিকই ফেরত দিতে হচ্ছে। কিন্তু ঋণ আদায় না হওয়ায় ব্যাংকের ভর্তুকি বেড়ে গেছে। এ ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে ব্যাংকের মুনাফা থেকে। অপর দিকে, যে আমানত পাওয়া যাচ্ছে বিনিয়োগ স্থবিরতার কারণে তা পুরোপুরি বিনিয়োগ করা যাচ্ছে না। অর্থাৎ অলস অর্থ বেড়ে যাচ্ছে। এখানেও ব্যাংকের পরিচালন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। এ কারণে তারা আমানতের সুদ হার কমিয়ে দিচ্ছে।
এদিকে, প্রস্তাবিত বাজেটে আবগারি শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। অর্থাৎ ব্যাংকে এক লাখ টাকা আমানত রাখলে মূল টাকা থেকে ৮০০ টাকা আবগারি শুল্ক কেটে রাখা হবে। অপর দিকে কোনো আমানতকারীর কর শনাক্তকারী নম্বর (টিআইএন) না থাকলে মুনাফার ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। অ্যাকাউন্ট পরিচালন ফি ও নানা সার্ভিস চার্জ কেটে রাখা হয় আমানতকারীর হিসাব থেকে।
এর পাশাপাশি মার্চ শেষে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৩৯ শতাংশ। অথচ এপ্রিলে আমানতের সুদহার কমে নেমেছে ৪ দশমিক ৭৯ শতাংশ। অথচ এক বছর আগে একই সময়ে তা ছিল ৫ দশমিক ৭৭ শতাংশ। ২০১৫ সালের একই সময়ে ছিল ৭ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিলে ব্যাংকে ১০০ টাকা আমানত রাখলে বছর শেষে মুনাফার পরিবর্তে লোকসানের সম্মুখীন হতে হবে।
এমনি পরিস্থিতিতে আমানতকারীরা নিরুপায় হয়ে পড়েছেন। এক দিকে মুনাফা কমছে অপরদিকে শুল্ক, ভ্যাট, সার্ভিস চার্জসহ নানা ব্যয়ের বোঝায় প্রকৃত মুনাফা কমে গেছে। এ পরিস্থিতিতে আমানতকারীরা অধিক মুনাফার আশায় ব্যাংক থেকে টাকা তুলে অন্যত্র বিনিয়োগ করছে। কেউ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করছেন, কেউ বা পুঁজিবাজারসহ ঝুঁকিপূর্ণ খাতে। এর বড় প্রমাণ ব্যাংকে প্রতিনিয়তই আমানত কমে যাচ্ছে। সঞ্চয়পত্রে রেকর্ড বিনিয়োগ হচ্ছে।
অর্থনীতির সর্বশেষ সূচক দিয়ে তৈরি বাংলাদেশ ব্যাংকের মাসিক পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে চলতি আমানতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ঋণাত্মক ৪ দশমিক ৫৭ ভাগ। অথচ আগের বছরে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৯ দশমিক ৭০ ভাগ। একই সাথে মেয়াদি আমানতও কমে নেমেছে ৬ দশমিক ৯৪ ভাগে। যেখানে আগের বছরের একই সময়ে এ হার ছিল ১২ দশমিক ৪৩ ভাগ। এদিকে, সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার এখনো ডাবল ডিজিটে রয়েছে। এ কারণে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে সঞ্চয়পত্রের ঋণ। চলতি অর্থবছরে সরকার বাজেট ঘাটতি অর্থায়নে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল ১৯ হাজার ৬১০ কোটি টাকা। কিন্তু ২ মাস বাকি থাকতেই অর্থাৎ ১০ মাসে তা দ্বিগুণেরও বেশি হয়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ হাজার ৯৮ কোটি টাকায়।
ব্যাংক বিশ্লেষকরা জানান, আমানত কমা মোটেও ভালো লক্ষণ নয়। কারণ, এখন বিনিয়োগ চাহিদা নেই বলে এর তেমন কোনো প্রভাব পড়ছে না। কিন্তু ভবিষ্যতে বিনিয়োগ চাহিদা বাড়লে বিনিয়োগ করার মতো তহবিল ব্যাংকগুলোর হাতে থাকবে না। এটাই দুশ্চিন্তার বড় কারণ।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/228304