১৪ জুন ২০১৭, বুধবার, ১২:০৬

বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধ রাজধানী

দুই হাজার কোটি টাকা খরচেও এই পরিণতি!

অধিকাংশ খাল ও ড্রেনই ভরাট, বন্ধ হয়নি খোঁড়াখুঁড়িও * সমন্বিতভাবে কাজ না করাতেই টেকসই ফল মিলছে না * এবার বর্ষায় ভয়াবহ জলাবদ্ধতার শঙ্কা * সচেতনতা বৃদ্ধিতে কোনো উদ্যোগ নেই

সামান্য বৃষ্টিতেই তলিয়ে যাচ্ছে ঢাকা শহরের রাস্তাঘাট। এতে সীমাহীন ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে ঢাকাবাসীকে। দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো প্রতিবছর এ কাজে বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। এ বছরে বর্ষা মৌসুম শুরুর আগে একদিনের বৃষ্টিতেই ভয়াবহ জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ায় নগরবাসীকে আতঙ্ক তাড়া করে ফিরছে। তাদের শঙ্কা, পুরোমাত্রায় বর্ষা শুরু হলে নগরজীবনে ভোগান্তির অন্ত থাকবে না।


ঢাকা শহরের পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনায় ঢাকা ওয়াসা ড্রেনেজ বিভাগের মাধ্যমে দুই যুগে বছরে প্রায় এক হাজার কোটি টাকার সংস্কার ও উন্নয়নকাজ করেছে। আর ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন বিগত পাঁচ বছরেই পানি নিষ্কাশন কার্যক্রম চালাতে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে। এর বাইরেও এ সময়ে ড্রেনেজ উন্নয়নের ব্যাপক কার্যক্রম চলছে। তারপরও রাজধানীর ২৬টি খাল, তিন হাজার কিলোমিটার ড্রেন ও জলাশয়গুলো ভরাট থাকছে আবর্জনায়। বেদখল হচ্ছে। আর বৃষ্টি হলেই সড়কে-গলিতে জমছে হাঁটু থেকে কোমর পানি।

সোমবারের দিনভর বৃষ্টি তার তাজা উদাহরণ। মাঝারি ধরনের এ বৃষ্টিতেই ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোড, আলাউদ্দিন রোড, রাজারবাগ, শান্তিনগর, মালিবাগ, মৌচাক এলাকায় সড়ক ও অলিগলি পানির নিচে তলিয়ে ছিল। একই অবস্থা লক্ষ্য করা গেছে, ব্যস্ততম কারওয়ান বাজার, মিরপুর, কালশি, বাড্ডা, যাত্রাবাড়ী, জুরাইন, হাজারীবাগ, ধানমণ্ডি, মধুবাগ এলাকাতেও। নগরীর অন্য এলাকার অলিগলিতেও জলাবদ্ধতায় নাকাল হয়েছে মানুষ।

সাম্প্রতিক সময়ে কয়েক বারের বৃষ্টিতেও মালিবাগ, মৌচাক, শান্তিনগর, রাজারবাগ, মিরপুর, প্রগতি সরণি, বনশ্রী, রামপুরা, কমলাপুর, গোলাপবাগ, শ্যামলী, ধানমণ্ডি, গুলশান-১ ও গুলশান-২, বনানী, আজিমপুর, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, পরীবাগ, কারওয়ান বাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। বর্ষার মৌসুম আসন্ন হলেও এখনও ঢাকা শহরের ব্যস্ততম এলাকায় উন্নয়ন কাজের খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। ভরা বর্ষায় এই অবস্থা বিরাজমান থাকলে জলাবদ্ধতা কী ভয়াবহ রূপ নেবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

এবারের বর্ষায় রাজধানীর জলাবদ্ধতা অনেকাংশে কমিয়ে আনার আশ্বাস দিয়ে ঢাকার দুই মেয়র ও ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিভিন্ন সভা-সেমিনারে বক্তৃতা করেছেন। খাল দখলমুক্ত অভিযানও চালাতে দেখা গেছে। কিন্তু কার্যত টেকসই নিরসন হয়নি। বিশ্লেষকরা বলছেন, এর মূল কারণ দীর্ঘমেয়াদি ও সমন্বিত পরিকল্পনা ছাড়াই এসব কাজ করা হয়েছে, হচ্ছে। খালের অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ অভিযানসহ অন্যান্য কার্যক্রম কার্যত লোকদেখানো কাজে পরিণত হয়েছে।

খোঁজখবর নিয়ে জানা যায়, রাজধানীর পানি নিষ্কাশন পথগুলো আবর্জনায় ভরাট হয়ে রয়েছে। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন, ঢাকা ওয়াসা প্রতি বছর কযেকশ’ কোটি টাকা খরচ করে এসব আবর্জনা পরিষ্কার, ড্রেনেজ ব্যবস্থার সংস্কার ও উন্নয়ন করলেও জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি মিলছে না ঢাকাবাসীর।

সংশ্লিষ্টদের মতে, ঢাকা ওয়াসা ও ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের সমন্বয়হীনতা, অপরিকল্পিত, অদূরদর্শী কার্যক্রম এবং নগরবাসীর অসচেতনতার কারণে এত খরচের সুফল মিলছে না। জনসচেতনতার ঘাটতি বড় সমস্যা হলেও এ বিষয়ে ঢাকা ওয়াসা ও ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম নেই।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সোশ্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক ইনহ্যান্সমেন্ট প্রোগ্রাম (সিপ) ‘দুর্যোগ সহনশীল ঢাকা’ কর্মসূচির আওতায় এ নিয়ে মিরপুর এলাকায় বিভিন্ন কার্যক্রম চালাচ্ছে। ওই এলাকার জলাবদ্ধতার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে কর্মসূচির প্রকল্প সমন্বয়কারী সাইফুন নাহার যুগান্তরকে বলেন, কালশি সাংবাদিক কলোনি এলাকার পানি নিষ্কাশন ড্রেনগুলো সড়কের চেয়ে উঁচু হয়ে গেছে। স্লুইস গেট বন্ধ করে রাখা হয়। এছাড়া সাংবাদিক কলোনি খাল বেদখল এবং আবর্জনায় ভরাট। এসব কারণে এ এলাকায় জলাবদ্ধতা হচ্ছে। এজন্য ঢাকা ওয়াসা ও ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনকে একযোগে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।

কুড়িল থেকে রামপুরা ব্রিজ পর্যন্ত সড়কের দৈর্ঘ্য ৮ কিলোমিটার। এই সড়কের দুই পাশে পানি নিষ্কাশন ড্রেন রয়েছে। প্রতি বছর এই ড্রেন পরিষ্কার করা হয়। তারপরও বর্ষার মৌসুমে এই ড্রেন দিয়ে যথাযথ নিয়মে পানি নিষ্কাশন হয় না। কারণ ড্রেনের দুই পাশের বসবাসকারী, দোকানদার, পথচারী সরাসরি এই ড্রেনে ফেলছে গৃহস্থালি বর্জ্য, নির্মাণ বর্জ্য, প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন আবর্জনা।

মিরপুর, ক্যান্টনমেন্ট, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, নাখালপাড়া, শাহীনবাগ, আরজত পাড়া, মহাখালী, রসুলবাগসহ আশপাশের এলাকার ময়লাপানি নিষ্কাশন করা হয় মহাখালী খাল দিয়ে। সরেজমিন দেখা গেছে, খালটি আবর্জনায় ভরাট হয়ে গেছে। এ কারণে পানি নিষ্কাশন কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৫১ নম্বর ওয়ার্ডের মুন্সীবাড়িসহ ওই ওয়ার্ডের বেশিরভাগ সড়কেই সাম্প্রতিক বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। এলাকার বাসিন্দারা বর্ষায় ভয়াবহ জলাবদ্ধতার আতঙ্কে ভুগছেন। এলাকাবাসী জানায়, বর্ষা মৌসুমে ওই এলাকার আশপাশের নর্দমার ময়লা পানি অধিকাংশ আবাসিক বাসার নিচতলায় ঢুকে পড়ে। এলাকার বেশির ভাগ অংশে জলাবদ্ধতা লেগে থাকে।

মিরপুর দিয়ে প্রবাহিত ইব্রাহিমপুর খাল সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, কাগজ-কলমে ৬০ ফুট খালের ৩০ ফুটই বেদখল। অসাধু ব্যক্তিরা খাল দখল করে দোকানপাট, পাকা ভবনসহ বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা গড়ে তুলেছে। আর খালের অবশিষ্টাংশ বিভিন্ন ধরনের আবর্জনায় ভরাট হয়ে আছে। এর ফলে ওই এলাকার পানি নিষ্কাশন কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বর্ষার মৌসুমে এ এলাকার বাসিন্দাদেরও ভোগান্তির অন্ত থাকে না।

রামচন্দ্রপুর, হাজারীবাগ, বছিলা, কল্যাণপুর, কুতুবখালী, নন্দীপাড়া, বাড্ডা, বোয়ালিয়া খালেরও বেহাল দশা। আবর্জনায় ভরাট এসব খাল দিয়ে পানি নিষ্কাশন কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে খালসংলগ্ন আশপাশের এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে নগর বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক যুগান্তরকে বলেন, বিদ্যমান অবস্থায় টেকসই ড্রেনেজ সিস্টেম গড়ে তোলার পাশাপাশি খালগুলো দখল ও ভরাটমুক্ত রাখতে হবে। দায়িত্বপ্রাপ্ত সেবা সংস্থাগুলোকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। তবেই জনগণের খরচ করা অর্থ কাজে লাগবে। এ বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, আমাদের কাজের সুফল পাওয়া যাচ্ছে। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার জলাবদ্ধতা কম হচ্ছে। বর্ষা মৌসুমেও জলাবদ্ধতা কম হবে। তিনি বলেন, সোমবারের বৃষ্টিতে শান্তিনগরে কোনো জলাবদ্ধতা ছিল না। তবে রাজারবাগ, আলাউদ্দিন রোড ও নাজিম উদ্দিন রোড এলাকার জলাবদ্ধতা হয়েছে। এটা ওয়াসার সমস্যা। ঢাকা ওয়াসার সঙ্গে সমন্বয় করে সেই সমস্যার সমাধান করা হচ্ছে।

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ কুদরত উল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, ঢাকা উত্তরের মিরপুর, কালশি, বাড্ডা ও কারওয়ান বাজার এলাকায় জলাবদ্ধতা হয়েছে। এসব এলাকার সিটি কর্পোরেশনের ড্রেনেজ সিস্টেমগুলো আরও সক্রিয় করা হবে এবং ঢাকা ওয়াসার সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করা হবে। এ ব্যাপারে ঢাকা ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী কামরুল হাসান বলেন, ঢাকা ওয়াসা রুটিন কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ড্রেন ও খাল সংস্কার করে যাচ্ছে। সমস্যাকবলিত এলাকাগুলোর বিষয়ে বিশেষ কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।

http://www.jugantor.com/last-page/2017/06/14/132418/