১৪ জুন ২০১৭, বুধবার, ১২:০০

শুল্ক ও ভ্যাটের চাপ

সংবাদপত্র শিল্পে অশনিসংকেত

আগামী অর্থবছরে বাস্তবায়ন হতে যাওয়া নতুন ভ্যাট আইনের মারপ্যাঁচে পথে বসবে সংবাদপত্র শিল্প। অতি প্রয়োজনীয় হিসেবে ভ্যাট অব্যাহতিপ্রাপ্ত পণ্যের তালিকায় সংবাদপত্রকে রাখা হলেও আইনি জটিলতায় কড়ায়-গণ্ডায় হিসাব কষে রাজস্ব খাতে বড় অঙ্কের অর্থ সরকারি কোষাগারে দিতে হবে সংশ্লিষ্টদের।
অথচ অনেক ক্ষেত্রে রেয়াত নেওয়ার সুযোগটুকুও থাকছে না।
আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত রাজস্ব বাজেট বাস্তবায়ন হলে ১ জুলাই থেকে সংবাদপত্র ছাপানোর কালি, ব্যবহূত প্লেট, নিউজপ্রিন্টসহ অন্যান্য খাতে রাজস্ব পরিশোধ করতে হবে। আবার সংবাদপত্রের নামমাত্র আয়ের রাস্তাটাও সংকীর্ণ করে দিতে যাচ্ছে ভ্যাট আইন-২০১২। বিজ্ঞাপনের ওপর পড়ছে রাজস্বের খড়্গ।
নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব)-এর হিসাবে দেখা গেছে, নিউজপ্রিন্ট আমদানিতে ৫ শতাংশ শুল্ক ছাড়াও ১৫ শতাংশ ভ্যাট রয়েছে। এ ছাড়া ভ্যাট-শুল্ক মিলিয়ে ছাপাখানায় ব্যবহূত কালিতে ৬২ শতাংশ কর আছে। প্লেটের আমদানি শুল্ক ১ শতাংশ থাকলেও অন্য সব কর-শুল্ক মিলিয়ে সাড়ে ৭, প্রিন্টিং কেমিক্যালে ৫ শতাংশ শুল্কসহ মোট কর ৩৫ শতাংশ বিদ্যমান রয়েছে। ১৯৯১ সালের ভ্যাট আইনের দ্বিতীয় তফসিলে সেবা খাত হিসেবে সংবাদপত্র শিল্পকে ভ্যাটের আওতামুক্ত রাখা হলেও এতে ব্যবহার হওয়া উপকরণের জন্য আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট দিয়ে যেতে হচ্ছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে সংবাদপত্র সরবরাহ বা বিক্রির ওপর ভ্যাট নেই। তবে উত্পাদন বা ছাপাখানা পর্যায়ে ভ্যাট আছে। অর্থাত্ ছাপাখানা পর্যায়ে সংবাদপত্রকে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হবে। ফলে পত্রিকা প্রকাশনার খরচ বাড়বে।
তা ছাড়া বিজ্ঞাপনদাতারা বিল পরিশোধের সময়ই ৪ শতাংশ হারে অগ্রিম আয়কর কেটে রাখেন, যা রসিদ না পাওয়ার কারণে পরবর্তী সময়ে সমন্বয় হয় না। ফলে শেষ পর্যন্ত এটি সংবাদপত্রের প্রকৃত আয় থেকে বাদ পড়ে। এবারের বাজেটে বিজ্ঞাপনের বিলের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব দেখে প্রমাদ গুনছে সংবাদপত্র শিল্প।
একটি মিডিয়া গ্রুপের হিসাবরক্ষণ বিভাগ থেকে জানা যায়, নিউজপ্রিন্ট আমদানিতে প্রতি মাসে গড়ে তাদের শুল্ক-কর বাবদ খরচ পড়ে এক কোটি টাকার মতো। আর বিজ্ঞাপনের ওপর ভ্যাট বসলে তাদের এ বাবদ গুনতে হবে প্রতি মাসে অন্তত ৬০ লাখ টাকা। আর নানা ধরনের প্রিন্টিং কেমিক্যালের ওপর প্রস্তাবিত শুল্ককর হিসাব করে দেখা গেছে, এতে পত্রিকার প্রকাশনা খরচ প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাবে।
‘অনলাইন ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক। বিজ্ঞাপনের বিলের কাগজ পাওয়ার পর দু-এক দিনের মধ্যেই ভ্যাট পরিশোধ করতে হবে। অথচ বিল হাতে পেতে কয়েক মাস লেগে যায়। সরকারি বিজ্ঞাপনের টাকা পেতে বছর গড়িয়ে যায়। তবু ভ্যাটের টাকা পরিশোধ করতে হবে বিজ্ঞাপন ছাপা হওয়ার দু-এক দিনের মধ্যেই’, জানালেন এক ঊর্ধ্বতন হিসাব কর্মকর্তা।
শিল্প খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সমাজের দর্পণ সংবাদপত্র। এত দিন কোনো রকমে টিকে থাকলেও ভ্যাট আইনের কারণে আগামী অর্থবছর থেকে ক্রমাগত লোকসানে সংবাদপত্র বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবেন অনেকে। এ শিল্পের ওপর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল অনেক মানুষ বেকার হয়ে যাবে। তাই সরকারের উচিত চূড়ান্ত বাজেটে আইনি মারপ্যাঁচ থেকে এ শিল্পকে বাঁচাতে রাজস্ব ছাড় দেওয়া।
এনবিআর ভ্যাট অনলাইন প্রকল্পের উপপরিচালক জাকির হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, সংবাদপত্র শিল্পকে ভ্যাট অব্যাহতির তালিকায় রাখা হয়েছে। সংবাদপত্র বিক্রি করে অর্জিত আয়ের ওপর ভ্যাট আদায় করা হবে না। তবে বিজ্ঞাপনকে আলাদা একটি শিল্প হিসেবে বিবেচনা করা হবে। তার থেকে ভ্যাটসহ অন্যান্য রাজস্ব আদায় করা হবে।
এনবিআর সূত্র জানায়, আগামী অর্থবছরে প্রায় এক হাজারের বেশি পণ্য ও সেবা খাত ভ্যাট অব্যাহতিপ্রাপ্ত হিসেবে রাখা হয়েছে। ভ্যাট আইনের শর্ত হিসেবে অব্যাহতিপ্রাপ্ত পণ্য ও খাত থেকে ভ্যাট আদায় করা যাবে না। ভ্যাট আইন ২০১২ অনুসারে যেসব খাত বা পণ্যকে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে সংবাদপত্র সংশ্লিষ্ট বেশির ভাগ পণ্য ও সেবার জায়গা হয়নি।
আগামী অর্থবছরে সংবাদপত্রে ব্যবহূত নিউজপ্রিন্ট আমদানি পর্যায়ে ১৫ শতাংশ রাজস্ব পরিশোধ করতে হবে। আবার চলতি বছরের তুলনায় আগামী অর্থবছরে ধার্যকৃত বাড়তি শুল্ক পরিশোধ করেই প্লেট আমদানি করতে হবে। অথচ এসব পণ্য কিনতে সরকারের কোষাগারে কোটি কোটি টাকা জমা দিলেও তার এক পয়সাও রেয়াত বা মাফ পাওয়া যাবে না।
এত দিন সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপনদাতারাই ভ্যাট পরিশোধ করত। সংবাদপত্র কর্তৃপক্ষকে বিজ্ঞাপন খাতে অর্থ দেওয়ার আগে তাদের সরকারি কোষাগারে ভ্যাটের অর্থ জমা দিতে হতো। কিন্তু আগামী অর্থবছর থেকে বিজ্ঞাপন খাতের এ হিসাব পাল্টে যাবে। আমাদের দেশে সাধারণত সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন ছাপানোর দুই মাস, ছয় মাস বা তারও বেশি সময় পর অর্থ পাওয়া যায়। অনেক সময় বিজ্ঞাপন ছাপানোর পরও কোটি কোটি টাকা বকেয়া রয়ে যায়। কারণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চুক্তি হয় মৌখিকভাবে। এসব কারণে বাংলাদেশের অনেক সংবাদপত্র বন্ধ হয়ে যাওয়ার অনেক নজির রয়েছে।
আগামী অর্থবছর থেকে বিজ্ঞাপন ছাপানোর পর চুক্তি অনুসারে অর্থ আদায় হোক বা না হোক কাগজে-কলমে ওই সংবাদপত্রকে বিজ্ঞাপন ছাপাতে যে অর্থ দিতে চেয়েছে তা আয় হিসেবে দেখাতে হবে। এরপর বিজ্ঞাপন ছাপানোর জন্য যে অর্থ সংবাদপত্র কর্তৃপক্ষের পাওয়ার কথা, তা আদায় হোক বা না হোক নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সে অর্থের ১৫ শতাংশ রাজস্ব এনবিআরে জমা দিতে হবে।
অন্যদিকে সংবাদপত্রের কোন পাতায় কতটুকু জায়গায় বিজ্ঞাপন ছাপালে কী পরিমাণ অর্থ সংবাদপত্র পাবে তার দরও নির্ধারণ করা আছে। আগামী অর্থবছর থেকে বিজ্ঞাপন খাতে ধার্যকৃত রাজস্ব ধরেই যিনি বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন তিনি মূল্য পরিশোধ করবেন। সংবাদপত্র কর্তৃপক্ষকে বিজ্ঞাপন খাতে পরিশোধিত অর্থ থেকেই ভ্যাট দিতে হবে। সংবাদপত্র বিজ্ঞাপনের মূল্য কমাতে পারলেও বাড়ানোর স্বাধীনতা পায় না। ফলে বিজ্ঞাপন খাতে সংবাদপত্র কর্তৃপক্ষের প্রকৃত আয় কমে যাবে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়োজ্জেম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যেসব পণ্য ভ্যাট অব্যাহতি পাবে তা উত্পাদনে ব্যবহূত পণ্যকে কিভাবে রাজস্ব সুবিধা দেওয়া হবে বা তা না দেওয়া হলে কিভাবে উত্পাদনকারী টিকে থাকবে, সে বিষয়টি অবশ্যই পরিষ্কার করা উচিত।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/06/14/508734