১২ জুন ২০১৭, সোমবার, ১১:২৫

দেশে এত প্রবৃদ্ধি হলে কর্মসংস্থান নেই কেন?

সরকারি হিসেবে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হলেও বাস্তবে এর কোন মিল খুঁজে পাচ্ছেন না অর্থনীতিবিদ ও গবেষকরা। তারা বলছেন প্রবৃদ্ধি অর্জনের সরকারি দাবি সত্যি হলে দেশে বেকারত্বের হার এভাবে বাড়তো না। কর্ম সংস্থানের অভাবে লাখ লাখ শিক্ষিত তরুণ যেমন হতাশায় ভুগছেন তেমনি জাতীয় অর্থনীতি ও আইন শৃংখলার ক্ষেত্রে এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। প্রবৃদ্ধির হার ছয় থেকে সাতে পৌঁছালেও দুই বছরে কর্মসংস্থান বেড়েছে সামান্যই। শিল্পখাতে প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়ে যাওয়াই কর্মসংস্থান কমার কারণ, বলছেন উদ্যোক্তারা। তবে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি)’র প্রবৃদ্ধি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছে সিপিডি। প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য অর্জন নিয়ে এবারও সংশয় প্রকাশ করেছে বিশ^ ব্যাংক এবং আইএমএফ।
জানা গেছে, নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশে তৈরি পোশাক খাতে যাত্রা শুরু করে। দিনে দিনে বেড়েছে এর পরিধি। তবে সে তুলনায় বাড়েনি কর্মসংস্থান।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একজন শিক্ষিক যুবককে মাস্টার্স পাস করেও ৮-১০ হাজার টাকা বেতনে কোন দোকানে কিংবা গার্মেন্টেস চাকুরি করতে হচ্ছে। এটাকেও সরকার কর্মসংস্থান হিসেবে দেখছে। তিনি তো আসলে এখনও বেকার।
২০১২ সালে ক্ল্যাসিক নামক একটি তৈরি পোশাক কারখানায় কর্মরত ছিলেন ৩ হাজারের বেশি শ্রমিক এবং কর্মকর্তা। তবে পাঁচ বছরে তা নেমেছে ২ হাজার ২শতে। শ্রমের জায়গায় প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় কর্মচারির সংখ্যা কমেছে।
রানা প্লাজা বিপর্যয়ের পর ক্ল্যাসিক গ্রুপের মতো তৈরি পোশাক খাতের অনেক প্রতিষ্ঠানেই কমে গেছে কর্মসংস্থান। বিজিএমইএর হিসেবে, ২০১১-১২ সালে তৈরি পোশাক খাতে ৪০ লাখ শ্রমিক কর্মরত ছিল। গেল পাঁচ বছরে এই সংখ্যা বেড়েছে মাত্র ৪ লাখ। পোশাক খাতে নতুন বিনিয়োগ কমে যাওয়াই কারণ, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
পরিসংখ্যান ব্যুরোর সবশেষ হিসেবে দেখা গেছে, ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালে দেশে ১৪ লাখ কর্মসংস্থান হয়েছে। এর আগের দুই বছরে এই সংখ্যা ছিলো ২১ লাখ। কিন্তু প্রতি বছর গড়ে সাড়ে ৬ শতাংশ জিডিপি বাড়লেও কর্ম সংস্থান সে হারে বাড়ছে না। গত চার বছরে দেশে কর্মসংস্থান হয়েছে ৩৫ লাখ। এসময় কর্মসংস্থান হওয়ার কথা ছিল প্রায় ৫০ লাখ। কিন্তু না হওয়াতে জিডিপির প্রবৃদ্ধি নিয়ে নানা সংশয় দেখা গেছে।
এব্যাপারে পরিকল্পনা মন্ত্রনালয়ের সিনিয়র সচিব অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন,কর্মমুখী ও প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থা না হওয়ার কারনেই কর্মসংস্থার বাড়ছে ধীর গতিতে। একইভাবে অন উৎপাদনশীল খাতকে উৎপাদনশীল খাতে আনা গেলেই দেশের বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান উভয়ই বাড়বে। এজন্য সরকার কাজ করে যাচ্ছে। রপ্তানি খাতকে বহুমুখী করা না গেলে কর্মসংস্থান বাড়ানো কঠিন বলছেন পরিকল্পনাবিদরা। এছাড়া অনানুষ্ঠানিক খাতকে অর্থনীতির মুল ধারায় আনার পরামর্শও দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষনা পরিষদের(বিআইডিএিস) রিসার্চ ফেলো ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, বিনিয়োগের নতুন ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে না। এতে করে দেশের বিনিয়োগ যেমন কম হচ্ছে তেমনি কর্মসংস্থানও কম হচ্ছে। এ অবস্থা কাটিয়ে উঠতে হলে বিনিয়োগ অবকাঠামো নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে জিডিপি প্রবৃদ্ধির কোন সুফল পাবে না দেশের মানুষ।
জিডিপির প্রবৃদ্ধি নিয়ে সরকার বলছে,সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি হবে কৃষি খাতে। কিন্তু এ বছর আগাম বন্যার অজুহাত দেখিয়ে প্রতি নিয়তই চালের দাম বাড়ছে। সারা দেশের ব্যাপক হারে ফসলের হানি হচ্ছে। তাহলে কিভাবে এ খাতে জিডিপির প্রবৃদ্ধি বাড়ছে তার হিসাব মিলছে না।
হিসাব মিলছে না শিল্পখাতেও। প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, এ বছর বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়বে গেলো বছরের তুলনায়। কিন্ত কিছুটা বেড়েছে সরকারি বিনিয়োগ। সব মিলিয়ে প্রথমবারের মতো যা ছাড়িয়ে যাবে জিডিপির ৩০ শতাংশ। তাহলে কেন শিল্পখাতে প্রবৃদ্ধি কমছে। ১১ শতাংশ থেকে বছর ব্যবধানে যা নেমে আসবে ১০ দশমিক ৫০ শতাংশ। প্রশ্ন হলো, বিনিয়োগ বাড়ার পরও, কেনো কমবে প্রবৃদ্ধি?এমন প্রশ্নের কোন সঠিক উত্তর নেই।
একই অবস্থা দেখা গেছে,দেশের নির্মান খাতেও। গত কয়েক বছর ধরেই এ খাতে নিম্মমুখী প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। আবাসন খাতেও অবস্থা আরও খারাপ। এখানেও প্রবৃদ্ধি কমছে। তাহলে সরকার কোন খাতের উপর নির্ভর করে জিডিপির প্রবৃদ্ধির বাড়ছে এমন প্রাক্কলন করছে বিবিএস।
চলতি অর্থবছরে প্রবাসী আয় কমে যাওয়া এবং লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রপ্তানি প্রবৃদ্ধি না হওয়ার পরও প্রবৃদ্ধি কীভাবে লক্ষ্য ছাড়াবে জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, প্রবাসী আয় আসলে কমেনি। ২০১৬ সালে বিকাশসহ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ১৪ দশমিক ৩১ ভাগ প্রবাসী আয় দেশে এসেছে।
এ ব্যাখ্যায় পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপের বরাত দিয়ে মন্ত্রী বলেন, ২০১৩ সালে ৬৭ দশমিক ৩২ শতাংশ প্রবাসী আয় ‘ব্যাংকিং চ্যানেলে’, আর ৩২ দশমিক ৬৮ শতাংশ আয় ‘নন ব্যাংকিং চ্যানেলে’ দেশে আসত।
কিন্তু ২০১৬ সালের পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে আসছে ৫০ দশমিক ৭২ শতাংশ, আর নন ব্যাংকিং চ্যানেলে বাকি ৪৯ দশমিক ২৮ শতাংশ । অর্থাৎ মোবাইল ব্যাংকিং শুরু হওয়ার পর সাধারণ ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসী আয় কমে গেছে।
মাথাপিছু আয়ের পরিমাণ নিয়েও সন্দেহ নানা মহলে। কেননা, মাত্র এক বছরের ব্যবধানে কিভাবে ১৩৭ ডলার বা ১১ হাজার ২৩৪ টাকা বাড়তি আয় সম্ভব-সেই প্রশ্ন সামনে এসেছে বড় আকারে। কারো কারো মতে, নির্বাচনের আগে পরিসংখ্যানের বৃত্তে জনগণকে তুষ্ট করার প্রবণতা রয়েছে সরকারের।
চলতি অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়ে ১ হাজার ৬০২ ডলার হবে বলে প্রাক্কলন করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো। যা গত বছর ছিল ১৪৬৫ ডলার। হিসেবে মনে গত এক বছর তেমন কোন নতুন কর্মসংস্থা হয়নি। বেড়েছে বেকারত্বের সংখ্যাও। নতুন বিনিযোগ না থাকার কারনেই নতুন করে কোন কর্মসংস্থান হচ্ছে না। তাহলে কিভাবে মাথা পিছু এত আয় বাড়লো।
চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রথম দশ মাসের (জুলাই-এপ্রিল) তথ্য বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো মাথাপিছু আয় ও প্রবৃদ্ধির এই হিসাব করেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর চূড়ান্ত হিসাবে গত অর্থবছর জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৭ দশমিক ১১ শতাংশ। প্রায় এক দশক ৬ শতাংশের বৃত্তে ‘আটকে’ থাকার পর গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের ‘ঘর’ অতিক্রম করে। এরপর গত জুনে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে ৭ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ঠিক করা হয়।
চলতি অর্থবছরে দেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। মোট বিনিয়োগ হয়েছে জিডিপির ৩০ দশমিক ২৭ শতাংশ। এর মধ্যে বেসরকারি বিনিয়োগ ২৩ দশমিক ০১ শতাংশ, আর সরকারি বিনিয়োগ ৭ দশমিক ২৬ শতাংশ।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বলছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছর বাংলাদেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধি সর্বোচ্চ ৬ দশমিক ৮ শতাংশ হবে। সরকারের ৭ দশমিক ২ লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক এই সংস্থাটি। কারণ, প্রবৃদ্ধি অর্জনের যেসব খাতের ওপর নির্ভর করছে, সেগুলোর অবস্থা আশানুরূপ নয়। যেমন রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয় নিম্নমুখী, বেসরকারি বিনিয়োগ ও কৃষিতে প্রবৃদ্ধি কমেছে। আর ২০১৭-১৮ অর্থবছরেও একই প্রবৃদ্ধি অপরিবর্তিত থাকবে। ২০১৫-১৬ অর্থবছর প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৭ দশমিক ১ শতাংশ। অতীতের ও চলতি পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে এই পূর্বাভাস দিয়েছে সং¯’াটি। তবে মধ্য আয়ের দেশ থেকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হলে উৎপাদনশীলতা ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করাই বড় চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশের জন্য বলে এডিবি জানায়।
সেবা খাতে ২০১৭ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি হবে ৬ শতাংশ ২০১৮ সালে অপরিবর্তিত থাকবে। আমদানি প্রবৃদ্ধি প্রথম ছয় মাসে ৯ শতাংশ হয়েছে। আগামী অর্থবছর এই প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশে দাঁড়াবে।
এদিকে এডিবির মতো বিশ্বব্যাংকও প্রবৃদ্ধি অর্জনের ব্যাপারে সরকারের প্রত্যাশার সঙ্গে পুরোপুরি একমত নয়। গত রোববার বিশ্বব্যাংক তাদের প্রতিবেদনে ৬ দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দেয়। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের কারণে বেসরকারি বিনিয়োগ কমে যাওয়াকে প্রবৃদ্ধি হ্রাসের প্রধান কারণ হিসেবে মনে করছে বিশ্বব্যাংক। তাদের পর্যবেক্ষণ, বেসরকারি বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখতে সরকারি বিনিয়োগ বাড়ানো হয়েছে। মূলত অবকাঠামো খাত ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাড়িয়ে সরকার প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখার চেষ্টা করছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, এ অবস্থায় বেসরকারি ও বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হলে নিরাপত্তাব্যবস্থার উন্নতি করতে হবে।
এব্যাপারে পিআরআই’র নিবার্হী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন,নির্বাচনের আগের পরিসংখ্যায় ধাঁধা নতুন কিছু নয়। এর মাধ্যমে জনগণকে আকৃষ্ট করার সুযোগ রয়েছে। তবে আয় নিয়ে সরকারের যে পরিসংখ্যান তা সন্দেহের উদ্ধে নয়। কর্মসংস্থান না হলে কিভাবে এত টাকা আয় হতে পারে তা বুঝে আসে না।

http://www.dailysangram.com/post/287772-