৩০ জুন ২০২৪, রবিবার, ১০:৫৮

আইনের আশ্রয় নেন না ৮৮ শতাংশ ভুক্তভোগী

দেশে বেড়েছে সাইবার অপরাধ। অপরাধের শিকার অধিকাংশ শিক্ষিত মানুষ হলেও মাত্র ১২ শতাংশ ভুক্তভোগী সাইবার অপরাধের শিকার হয়ে আইনগত পদক্ষেপ নেন। বাকি ৮৮ শতাংশ ভুক্তভোগী আক্রান্ত হলেও তা লুকিয়ে রাখেন। আইনের আশ্রয় নেন না। তার চেয়েও হতাশাজনক যারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে অভিযোগ করেন তাদের ৮৭ দশমিক ৫০ শতাংশই আবার কোনো সুফল পাননি। সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের (সিক্যাফ) উদ্যোগে পরিচালিত এক জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ‘বাংলাদেশে সাইবার অপরাধপ্রবণতা ২০২৪’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়।

সাইবার অপরাধের শিকার ১৩২ জন ভুক্তভোগীর স্বপ্রণোদিত তথ্য বিশ্লেষণ করে এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে সিক্যাফ। সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও ন্যায়বিচার নিশ্চিতে প্রতিবেদনে কয়েকটি সুপারিশও তুলে ধরেছে সংগঠনটি। গবেষণা প্রতিবেদন তুলে ধরেন সিক্যাফের গবেষণা দলের প্রধান ইনডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের প্রভাষক ওবায়দুল্লাহ আল মারজুক।

প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি ৭৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ সাইবার অপরাধের শিকার হয়েছেন ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সের মানুষ। আর ১৮ বছরের কম অর্থাৎ শিশুদের আক্রান্তের হার ১৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ।

বাকি ৭ শতাংশ ভুক্তভোগী ৩১ বছর ও তার চেয়ে বেশি বয়সের। মোট আক্রান্তদের মধ্যে ৫৯ শতাংশই নারী। এদিকে অপরাধের ধরনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অ্যাকাউন্ট হ্যাকিং। এ হ্যাকিংয়ের শিকার হয়েছেন ২১ দশমিক ৬৫ শতাংশ। পর্নোগ্রাফি অপরাধ প্রবণতাও আশঙ্কাজনক। এ ধরনের অপরাধের হার ১১ দশমিক ৩৫ শতাংশ।

সাইবার অপরাধের শিকার হওয়া ভুক্তভোগীরা বেশির ভাগই সামাজিক মর্যাদাহানির কথা বলেছেন। ৪৭ দশমিক ৭২ শতাংশ ভুক্তভোগী বলেছেন, তারা সাইবার ক্রাইমের শিকার হয়ে সামাজিক যে মার্যাদা ছিল তা হারিয়েছেন। এ ছাড়া ৪০ দশমিক ১৫ শতাংশ আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন। এ অপরাধের শিকার সবাই মানসিকভাবে কাতর ও চরম অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন।

অন্যদিকে, সাইবার অপরাধে আক্রান্তদের অধিকাংশই শিক্ষিত হলেও আইনের আশ্রয় নেয়ার হার খুবই কম। মাত্র ১২ শতাংশ ভুক্তভোগী আইনগত পদক্ষেপ নিয়েছেন। তাদের মধ্যে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন মাত্র ৮১ দশমিক ২৫ শতাংশ আর লিখিত অভিযোগ করেছেন ১৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ। তবে হতাশাজনক তথ্য হলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে অভিযোগ করেও কোনো ধরনের সুফল পাননি ৮৭ দশমিক ৫০ শতাংশ ভুক্তভোগী। বাকি ১২ দশমিক ৫০ শতাংশ ভুক্তভোগী বিচার বা সুফল পাওয়া নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি। তাদের মধ্যে অনেকের বিচারিক প্রক্রিয়া চলমান। জরিপের তথ্যানুযায়ী, সাইবার অপরাধে ভুক্তভোগীদের মধ্যে এইচএসসি পাস ৪০ দশমিক ৯০ শতাংশ। এ ছাড়া ২১ দশমিক ২১ শতাংশ স্নাতক ডিগ্রিধারী। আর কমপক্ষে এসএসসি পাস ১৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ। বাকি ১২ দশমিক ৮৭ শতাংশ মাধ্যমিক স্তর পেরুতে পারেননি।

প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়েছে, প্রযুক্তির উদ্ভাবনে গুরুত্ব দিতে হবে। এজন্য সরকারি পর্যায়ে বিনিয়োগ বাড়ানো এবং উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা দেয়া দরকার। উৎকর্ষতা অর্জনে পারস্পরিক সহযোগিতা করতে হবে। আমদানিনির্ভর হওয়ার পরিবর্তে সাইবার সুরক্ষায় ব্যবহৃত সফটওয়্যার ও অ্যাপ্লিকেশন তৈরিতে মনোযোগী হতে হবে। প্রতিবেদন প্রকাশের পর জরিপের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে আলোচনা করা হয় সেমিনারে। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিক্যাফ উপদেষ্টা প্রকৌশলী মো. মুশফিকুর রহমান। তিনি বলেন, উদীয়মান প্রযুক্তির সামাজিক সুবিধাগুলো বাড়াতে বহুমুখী পদ্ধতি প্রয়োগ করা দরকার। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো নাগরিকদের অধিকার ও গোপনীয়তা রক্ষার নীতি ও বিধিমালা তৈরি করা। এ ছাড়া দেশীয় গবেষণা শিল্প ক্ষেত্রে উদ্ভাবন স্থানীয় সফটওয়্যার ডেভেলপ ও সমাধানের প্রক্রিয়াকে উৎসাহিত করতে হবে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার নাজমুস সালেহীন বলেন, অনলাইন গ্যাম্বিলিংয়ের আড়ালে মানিলন্ডারিংয়ের মতো অপরাধ রয়েছে। খুঁজে পাওয়া অত্যন্ত কঠিন। তাছাড়া কোর ব্যাংকিং খাতেও সহসাই বিপদ ঘটতে পারে। এ নিয়ে সতর্কতা ও জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে। অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (সিটিটিসি) ইশতিয়াক আহমেদ বলেন, চারটি ধারা ছাড়া সাইবার অপরাধ আইন ২০১৩-এর সব ধারা হ্যাকিংয়ের আওতায় থাকলেও তা জামিনযোগ্য। এতে অনেক অপরাধীকে শাস্তির আওতায় আনতে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। ভুক্তভোগীরা দেরিতে অভিযোগ করাটাও বড় একটি সমস্যা। এতে আইনের সুরক্ষা দেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এ ছাড়া দেশে শিশু পর্নোগ্রাফি বাড়ছে। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে তা ছড়িয়ে পড়ছে। এটা রুখতে সবার সচেতনতা জরুরি।

আইডিয়া ফাউন্ডেশনের প্রধান সমন্বয়ক হুসেইন সামাদ বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশের এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি হয়েছে। এখন এর দক্ষ ব্যবহার দরকার। দেশে ৭০ শতাংশ সাইবার আক্রমণ হচ্ছে মানুষের ভুলে। সবার সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই। সিক্যাফ সভাপতি কাজী মুস্তাফিজের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সাধারণ সম্পাদক নুরুন আশরাফী। সেমিনারে প্যানেল আলোচক হিসেবে আরও অংশ নেন বিটিআরসির মহাপরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড অপারেশন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী মুস্তাফিজুর রহমান, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি গ্লোবাল স্টাডিজ অ্যান্ড গভর্নেন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ এ হুসেইন প্রমুখ। অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সিক্যাফ সহ-সভাপতি এস এম ইমদাদুল হক, প্রশিক্ষণ ও গবেষণা সম্পাদক আব্দুল মুনয়েম সৈকত প্রমুখ।

https://mzamin.com/news.php?news=116414