১২ জুন ২০১৭, সোমবার, ১১:২৪

৫ বছরে সড়ক উন্নয়ন বরাদ্দের ২৭ হাজার ২১৭ কোটি টাকা গেলো কোথায়?

* অধিকাংশ সড়কই চলাচলের অনুপযোগী
* চরম দুর্ভোগে নাকাল মানুষ, আসন্ন ঈদে দুর্ভোগ বাড়বে
* পাঁচ বছরে সড়ক-মহাসড়কের দৈর্ঘ বাড়েনি

২০১২ সালে দেশের বেহাল সড়ক ছিল ৩৮ শতাংশ। তখন সড়ক উন্নয়নে বরাদ্দ ছিল ৩ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। আর চলতি অর্থবছর সড়ক উন্নয়নে বরাদ্দ বেড়ে দাঁড়ায় ৯ হাজার ৪০ কোটি টাকা। অথচ সওজের এইচডিএম সার্কেলের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৩৭ শতাংশ সড়ক-মহাসড়ক ভাঙাচোরা অবস্থায় রয়েছে। পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে দেশের সড়ক উন্নয়নে একদিকে বরাদ্দ বাড়াছে বিপরীতে সড়কের কোনো উন্নয়ন হচ্ছে না। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সড়ক উন্নয়নের জন্য বরাদ্দের হাজার হাজার কোটি টাকা যাচ্ছে কোথায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের প্রধান প্রধান মহাসড়ক যেমন তেমন জেলা এবং আঞ্চলিক সড়কগুলো বেশির ভাগাই নাজুক অবস্থায় রয়েছে। ইট বালু সুরকী উঠে গিয়ে প্রায় সড়কে যানবাহন চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এছাড়া এলজিইডির অধীনন্থ সড়কের আরো নাজুক অবস্থা। এতে করে চরম দুর্ভোগে পড়েছে মানুষ। আসন্ন ঈদে বেহাল সড়কের কারণে মানুষের দুর্ভোগ আরো বেড়ে যাবে কয়েকগুণ।
সূত্র জানায়, সড়ক-মহাসড়ক উন্নয়নে প্রতিবছর প্রচুর অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে। গত পাঁচ বছরে এ খাতে ২৭ হাজার ২১৭ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-ময়মনসিংহ চার লেন বাদ দিলেও এ বরাদ্দ দাঁড়ায় সাড়ে ২১ হাজার কোটি টাকার বেশি। যদিও পাঁচ বছরে দেশে সড়ক-মহাসড়কের দৈর্ঘ বাড়েনি। আর চলতি অর্থবছর রেকর্ড ৯ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা বরাদ্দ দিলেও এক কিলোমিটারও সড়ক যোগ হয়নি।
সূত্র জানায়, গত অর্থবছর সংজ্ঞা পরিবর্তনের কারণে ২৬৯ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক যুক্ত হয়। আঞ্চলিক সড়কই এক্ষেত্রে জাতীয় মহাসড়কে উন্নীত হয়েছে। আর সমপরিমাণ আঞ্চলিক মহাসড়ক কমেছে। এতে মোট সড়কের দৈর্ঘ বাড়েনি। এ ছাড়া উন্নত হয়নি বিদ্যমান সড়কের গুণগত মান। তাই সড়ক খাতের এ বরাদ্দ যাচ্ছে কোথায়, সে প্রশ্ন উঠছে।
জানা গেছে, সড়ক-মহাসড়ক নির্মাণে চলতি অর্থবছর সংশোধিত বরাদ্দ রয়েছে ৯ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ছয় হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। তার আগে ২০১৪-১৫ অর্থবছর এ খাতে বরাদ্দ ছিল চার হাজার ৭৭ কোটি, ২০১৩-১৪ অর্থবছর তিন হাজার ৬২৫ কোটি ও ২০১২-১৩ অর্থবছর তিন হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। যদিও এ সময় সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদফতরের সড়কের দৈর্ঘ না বেড়ে উল্টো ১৫২ কিলোমিটার কমেছে। এরপরও আগামী অর্থবছর সড়ক খাতে ১৬ হাজার ৮২০ কোটি টাকা উন্নয়ন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, চলমান প্রকল্পগুলোর মধ্যে চলতি অর্থবছর ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-ময়মনসিংহ চার লেন প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা। এ দুই প্রকল্পে চার বছরে ব্যয় করা হয়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে সাড়ে ২১ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে চলমান ও শেষ হওয়া অন্যান্য প্রকল্পে। এ সময় সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতে প্রায় আট হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। তবে সড়কের গুণগত মানোন্নয়ন হয়নি।
সড়ক বিভাগের তথ্যমতে, বর্তমানে সারা দেশে জাতীয় মহাসড়ক রয়েছে তিন হাজার ৮১৩ কিলোমিটার। গত বছরও এর পরিমাণ একই ছিল। গত অর্থবছরে যুক্ত হয়েছে ২৬৯ কিলোমিটার। মূলত কিছু আঞ্চলিক মহাসড়ক ও জেলা সড়ককে জাতীয় মহাসড়কে উন্নীত করা হয়েছে। নতুন কোনো সড়ক যুক্ত হয়নি। ২০১৪-১৫ অর্থবছরও ছয় কিলোমিটার সড়ককে মহাসড়কে উন্নীত করা হয়। আর ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৩১ কিলোমিটার আঞ্চলিক মহাসড়ক কমেছে। এর আগের তিন বছর তা অপরিবর্তিতই ছিল। চলতি অর্থবছর জেলা সড়ক কমে দাঁড়িয়েছে ১৩ হাজার ২৪২ কিলোমিটার, ২০১২-১৩ অর্থবছর যা ছিল ১৩ হাজার ৬৩৮ কিলোমিটার।
গত কয়েক বছরে ভাঙাচোরা সড়কের পরিমাণও খুব একটা কমেনি। সওজের এইচডিএম সার্কেলের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৩৭ শতাংশ সড়ক-মহাসড়ক ভাঙাচোরা অবস্থায় রয়েছে। বাকি সড়কের মধ্যে ২৪ শতাংশ মোটামুটি চলনসই। ভালো অবস্থায় রয়েছে মাত্র ৩৯ শতাংশ সড়ক। আর ২০১২ সালে ভাঙাচোরা সড়ক-মহাসড়ক ছিল ৩৮ শতাংশ।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল হক বলেন, সড়ক অবকাঠামো খাতে প্রতিবছর প্রচুর বিনিয়োগ হলেও তার গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সড়ক শুধু প্রশস্ত করলেই চলবে না তার ব্যবহার সময় কমছে কি না সেটাও দেখা জরুরি। এমনকি বিনিয়োগের পরিকল্পিত ব্যবহার নিয়েও নানা প্রশ্ন রয়েছে। কারণ অনেকটা এডহক ভিত্তিতে এখন বিভিন্ন প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে কি ধরনের প্রকল্প নেওয়া দরকার, তা অনেক ক্ষেত্রেই যাচাই করা হয় না। ফলে বিনিয়োগের কোনো সুফল আসলে মেলেনি।
তবে মহাসড়কের অবস্থা আগের চেয়ে ভালো হলেও জেলা সড়কের অবস্থা খারাপ বলে স্বীকার করেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, মহাসড়কের অবস্থা এখন অনেক ভালো। কোনো মহাসড়কেই কোনো সমস্যা নেই। তবে জেলা সড়কগুলো এখনও মেরামত করা যায়নি। চলতি অর্থবছর তা ঠিক করা সম্ভব নয়। আগামী অর্থবছর বরাদ্দ পাওয়ার পর কাজ শুরু করতে হবে। এতে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের আগে কাজ শুরু করা সম্ভব নয়।
মন্ত্রী বলেন, আগামী দুই-তিন বছরের মধ্যে সারা দেশের সড়ক-মহাসড়কের চেহারা বদলে যাবে। আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মহাসড়ক এ সময় চার লেন করা হবে। পাশাপাশি শুরু করা হবে ঢাকা-চট্টগ্রাম এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ। এ ছাড়া মহাসড়কের দুর্ঘটনার ঝুঁকিপূর্ণ বাঁকগুলো প্রশস্তকরা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত এক দশকে সড়ক খাতে দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি। ২০০৬-০৭ অর্থবছরে সওজের অধীন সড়ক ছিল ২১ হাজার ৫৭১ কিলোমিটার। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২১ হাজার ৩০২ কিলোমিটারে। অর্থাৎ ১০ বছরে সড়ক কমেছে ২৬৯ কিলোমিটার। এগুলো মূলত স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের (এলজিইডি) কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
দৈর্ঘ্যে কমার পাশাপাশি গুণগত মানেরও উন্নয়ন হয়নি এ সময় দেশের বেশিরভাগ সড়কের। এখনও দেশের অধিকাংশ সড়কই দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেনীর।প্রথম শ্রেণির সড়ক রয়েছে মাত্র চার শতাংশ। ইউএন-এসকাপের ‘এশিয়ান হাইওয়ে ডাটাবেজ’-এ বলা হয়, বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে এশিয়ান হাইওয়ের তিনটি রুট গেছে। এগুলোর দৈর্ঘ এক হাজার ৭৪১ কিলোমিটার, যার প্রায় পুরোটাই নি¤œমানের। এক কিলোমিটার সড়কও নেই এশিয়ান হাইওয়ে মানের।
দক্ষিণ এশিয়া উপ-আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা বা সাসেক রোড করিডোরের তিনটি রুটও গেছে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে। এগুলোর দৈর্ঘ এক হাজার ৪৮১ কিলোমিটার। এর মধ্যে এক হাজার ৩১৮ কিলোমিটার বা ৮৯ শতাংশ সড়কই দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির। এসব সড়ক উপআঞ্চলিক সড়ক নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠায় উপযুক্ত নয়।
বিশ্বব্যাংকের ডুয়িং বিজনেস রিপোর্ট ২০১৫ বলছে, ইনফ্রাস্ট্রাকচার কোয়ালিটিতে ১৮৯ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৯ আর এশিয়ার মধ্যে সবার নিচে। সড়ক অবকাঠামো সূচকে ১০-এর মধ্যে বাংলাদেশের স্কোর দুই দশমিক ৯। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের স্কোর তিন দশমিক আট। এ ছাড়া সূচকে চীনের স্কোর চার দশমিক ছয়, কম্বোডিয়ার তিন দশমিক চার, পাকিস্তানের তিন দশমিক আট, শ্রীলংকার পাঁচ দশমিক এক ও থাইল্যান্ডের চার দশমিক পাঁচ।


http://www.dailysangram.com/post/287786-