জ্যামে আটকা আছে শত শত গাড়ি। এর মধ্যেই উল্টো পথে ‘ভিআইপি’ গাড়ি। গত শনিবার বিকেলে বাংলামোটর এলাকার দৃশ্য। ছবি : কালের কণ্ঠ
১২ জুন ২০১৭, সোমবার, ১১:১৩

প্রভাবশালীরা আইন মানেন না!

উল্টো পথে মন্ত্রী-এমপিদের গাড়ি

আইনে শাস্তির বিধান, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রীর সতর্কবাণী, পুলিশের অভিযানের পরও রাজধানীতে অধিকাংশ মন্ত্রী-এমপিসহ অন্যান্য প্রভাবশালীর গাড়ি উল্টো পথেই চলছে। উল্টো চলা ঠেকাতে মন্ত্রীপাড়ার পথে বসানো হয়েছিল গাড়ির চাকা ফুটো করে দেওয়ার কাঁটা লাগানো সুচালো ডিভাইস।
তবে মন্ত্রী-এমপিদের চাপে সেই কাঁটা লাগানো যন্ত্র অন্যত্র সরিয়েছে পুলিশ। একপর্যায়ে সেই যন্ত্র অকেজো করে ফেলা হয়েছে। সংসদ সদস্যরা গাড়িতে অবৈধভাবে পতাকার স্ট্যান্ড লাগিয়ে, হর্ন বাড়িয়ে উল্টো পথে চলছেন। আর বাঁশি বাজিয়ে পুলিশ তাঁদের বহনকারী গাড়ি চলতে সহযোগিতা করছে।
উল্টো পথে গাড়ি চলায় যানজট ও দুর্ঘটনা বাড়ছে। প্রভাবশালীদের গাড়ির উল্টো চলাচলের কারণে রোজা শুরুর পর রাজধানীর মিন্টো রোড, শাহবাগ, বাংলামোটর, মৎস্য ভবন, বিজয় সরণি, উড়োজাহাজ মোড়সহ বিভিন্ন স্থানে ভুক্তভোগী অন্যান্য গাড়ির যাত্রী, চালক ও পথচারীদের অভিযোগ বাড়ছেই।
দেখা গেছে, সড়কে মন্ত্রী-এমপি ও বিশেষ পরিচিতদের বহনকারী গাড়ি উল্টো পথে চলতে পুলিশই সহযোগিতা করছে। ক্ষমতাবানদের দেখাদেখি আইন রক্ষাকারী পুলিশ সদস্যরাও উল্টো পথে গাড়ি চালাচ্ছেন। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্যানুসারে, রাজধানীতে নিবন্ধিত বিভিন্ন ধরনের গাড়ির মধ্যে ৪১ শতাংশই মোটরসাইকেল। ব্যাপক হারে বেড়ে যাওয়া এ বাহনের চালকদের বেশির ভাগই উল্টো ও বেপরোয়া চলাচল করছেন। এ ছাড়া উন্নয়নকাজের জন্য চলাচলের নির্দিষ্ট লেন বন্ধ থাকায় ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে মূল সড়ক ও অলিগলিতে চালকরা বাধ্য হয়ে উল্টো পথে চলাচল করছেন।
এখন অবস্থা এমন যে ঢাকা মহানগর পুলিশ বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে কোনো কোনো দিন পাঁচ শতাধিক গাড়ির চালকের বিরুদ্ধেও মামলা করছে উল্টো পথে চলাচলের দায়ে। কর্মঘণ্টা শুরু ও শেষে মন্ত্রী-সচিবসহ অন্যান্য আমলা ও সংসদ সদস্যদের বহনকারী গাড়ি উল্টো পথে চললে সেগুলোর চালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না ট্রাফিক পুলিশ সার্জেন্টদের।
গতকাল রবিবার সপ্তাহের প্রথম দিন অফিস ছুটির পর দেখা গেল, প্রায় আধাঘণ্টার মধ্যে সচিবালয় থেকে হেয়ার রোড, মিন্টো রোড হয়ে বিশেষ বিশেষ মন্ত্রীর গাড়ি উল্টো পথে চলাচল করছে। দেখা গেছে, জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংসদের স্টিকার লাগানো গাড়ি উল্টো পথে চলতে পুলিশ সদস্যরাই আগে থেকে অন্যান্য গাড়ি সরিয়ে দেন। কিন্তু ভিআইপি বলে তাঁদের গাড়িচালকদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। গতকাল দুপুরে রূপসী বাংলা হোটেলের সামনে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, হেয়ার রোডের কাঁটা লাগানো যন্ত্র সরানো হয়েছিল বিশেষ মন্ত্রীদের চাপে। ভিআইপিদের গাড়ি চলাচলের জন্য রূপসী বাংলা মোড় থেকে শাহবাগ পর্যন্ত অংশে ছিল তীব্র যানজট। সেখানে আধাঘণ্টা ধরে দাঁড়ানো বঙ্গবন্ধু এয়ারপোর্ট রোড পরিবহনের চালক মো. বজলু বলেন, ‘রং সাইডের গাড়ি জন্যই খাড়াইয়া থাকতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভিআইপিদের গাড়ির উল্টো চলা ঠেকাতে ২০১৪ সালে হেয়ার রোডে ও পরের বছর ঢাকা মহানগর পুলিশ সদর দপ্তরের সামনে কাঁটাযুক্ত স্বয়ংক্রিয় ডিভাইস বসানো হয়েছিল। তবে সেগুলো কিছুদিনের মধ্যেই নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়। ডিভাইসের ধারালো কাঁটাগুলো রাস্তার সমতল থেকে তিন ইঞ্চি উঁচু হয়ে থাকত। সোজা দিক থেকে আসা গাড়ির চাকা ডিভাইসের ওপর চাপ পড়ে সঙ্গে সঙ্গে নিচু হয়ে যেত। তবে উল্টোপথে আসা গাড়ির চাকায় বিঁধে যেত এসব সুচালো ডগা। ৪৫ মিলিমিটার পর পর বসানো ডিভাইসের ডগাগুলোর বেশির ভাগ ভেঙে দেওয়া হয়েছিল।
ঢাকা মহানগর পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, হেয়ার রোডের রমনা পার্কের অরুণোদয় গেটের উল্টো দিকে ২০১৪ সালের ২৩ মে ডিভাইস বসানো হয়েছিল। ওই কাঁটার ওপর দিয়েই চলাচল করত মন্ত্রী-এমপির গাড়ি। ডিভাইস বসানোর কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ডিভাইসের বেশির ভাগ কাঁটা নষ্ট হয়ে যায়। ঢাকা দক্ষিণ ট্রাফিক পুলিশের একজন কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, হেয়ার রোডে তিন সপ্তাহ থাকার পর সেটি ঢাকা মহানগর পুলিশ সদর দপ্তরের সামনে স্থাপন করা হয়েছিল। সেটিও পরে অকার্যকর হয়ে পড়ে।
মোটরযান অধ্যাদেশ-১৯৮৩-এর ৪০(২) ধারা অনুযায়ী, রাস্তার উল্টো পাশ দিয়ে গাড়ি চালানো শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ঢাকা মহানগর পুলিশ, বিআরটিএ, জেলা প্রশাসন মাঝেমধ্যে অভিযান চালালে এ অপরাধে জরিমানা আদায় করা হয়ে থাকে। ঢাকা মহানগর পুলিশ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে এ অভিযান চালাচ্ছে নিয়মিত। তবে অভিযানে মন্ত্রী, এমপি ও বিশেষভাবে পরিচিতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। ঢাকা ট্রাফিক পুলিশের একাধিক সদস্য জানান, এ অপরাধে সাধারণত ৫০০ টাকা জরিমানা আদায় করা হয়ে থাকে। তাঁরা জানান, ভিআইপি, পদস্থ কর্মকর্তা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বহনকারী গাড়িও উল্টো পথে চলাচল করে।
গত ১৭ এপ্রিল দিনভর ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন সড়কে অভিযান চালায় ঢাকা মহানগর ট্রাফিক পুলিশ। ওই দিন পৌনে চার হাজার মামলা হয়। জরিমানা আদায় করা হয় প্রায় ২২ লাখ টাকা। এর মধ্যে উল্টো পথে গাড়ি চালানোর অভিযোগেও জরিমানা আদায় করা হয়। এর আগে গত ৩১ ডিসেম্বর ঢাকা মহানগর ট্রাফিক পুলিশ রাজধানীর বিভিন্ন রাস্তায় উল্টো পথে গাড়ি চালানোর অপরাধে ৫৩৩টি গাড়ির বিরুদ্ধে মামলা করে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ এসব মামলা করে। এভাবে মামলা ও জরিমানা আদায় হলেও উল্টো পথে গাড়ি চালানো কমছে না।
ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড লাগিয়ে সুযোগ নেন সবাই : সংসদ সদস্যরা গাড়িতে জাতীয় পতাকা লাগাতে পারেন না। কিন্তু রাস্তায় দেখা যায়, প্রায় সব গাড়িতে ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড রয়েছে। এগুলো ব্যবহার করে অনেকে ঢাকার সড়কে উল্টো পথে গাড়ি চালায়। গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে একটি উপকমিটি তাদের প্রতিবেদনে সুপারিশ করেছিল, যাদের গাড়িতে পতাকা ও স্টিকার ব্যবহারের প্রাধিকার রয়েছে সেগুলো বাদে সব গাড়ি থেকে ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড, স্টিকার ও ভিআইপি হর্ন সরিয়ে ফেলার। শুধু জেলা প্রশাসনের একটি গাড়ি ছাড়া অন্য সব গাড়ি থেকে ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড নামিয়ে ফেলার সুপারিশ করা হয়েছিল। ঢাকা শহরের যানজট সমস্যার কারণ ও প্রতিকারের উপায় অনুসন্ধানে ২০১৫ সালের ৫ আগস্ট ওই উপকমিটি গঠন করেছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। কমিটির সদস্য আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপনকে আহ্বায়ক করা হয়েছিল উপকমিটির।
উপকমিটি স্থায়ী কমিটির কাছে দেওয়া প্রতিবেদনে ঢাকার মিরপুর রোড, বিমানবন্দর রোড, সাতরাস্তা, প্রগতি সরণি, সাত মসজিদ রোডসহ বিভিন্ন সড়কে সকাল ৭টা থেকে ১০টা ও বিকেল ৫টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত বাসের জন্য নির্দিষ্ট লেন চালুর সুপারিশ করেছিল। ওই নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট লেনে বাস ছাড়া অন্য গাড়ি চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আনার সুপারিশ করা হয়েছিল।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড, স্টিকার ও ভিআইপি হর্ন ব্যবহার করে অনেক সংসদ সদস্য রাস্তায় চলাচলে বিশেষ সুবিধা নিয়ে থাকেন। উল্টো পথে গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে অনেকে এগুলো ব্যবহার করছেন। এ ছাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ গাড়িতে ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড ব্যবহার করেন। সড়কের আইন অমান্য করে চলার লক্ষ্যে এটি ব্যবহার করা হয়। আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেছি। গত সপ্তাহেও মূল কমিটির সভায় বিষয়টির অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ’
সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যাঁরা আইন প্রণয়ন করেন তাঁদের আইন ভঙ্গ করা ঠিক নয়। সংসদ সদস্যরা মানুষের দুর্ভোগ সৃষ্টি হয় এমন কাজ কেন করবেন? একজন দোষ করলে সবার বদনাম হয়। কাজেই একজনও যাতে এমনটি না করেন তা-ই আমরা চাই। ’
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, উল্টো পথে গাড়ি চালানোর জন্য মন্ত্রী-এমপিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া দরকার।


 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2017/06/12/507939