১১ জুন ২০১৭, রবিবার, ১১:৩০

বাংলাদেশে চালের দাম সবচেয়ে বেশি

সরকারের মজুদ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ছে। এতে করে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সরকার। প্রতি দিনই মোটা কিংবা চিকন সব ধরনের চালের দাম বাড়ছে। এরই মধ্যে চালের দাম বৃদ্ধিতে নতুন রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। বিশ্ব বাজারের চেয়ে প্রতি কেজি চাল ক্রয়ে সাড়ে ১২ টাকা বেশি দিতে হচ্ছে বাংলাদেশের একজন ভোক্তাকে। এদিকে সরকারি হিসেবেই গত এক বছরে কেজিপ্রতি চালের দাম বেড়েছে ৪২ শতাংশ। এজন্য সরকারের মজুদ ব্যবস্থাকে দায়ী করছেন ভোক্তা-ব্যবসায়ীসহ সংশ্লিষ্ট সকলে। অন্যদিকে মজুদ তলানিতে থাকায় বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না সরকার।
বাংলাদেশে প্রতি কেজি মোটা চালের দাম ৪৮ টাকা। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে বিশ^ বাজারের তুলনায় সব চেয়ে বেশি মোটা চালের দাম বাংলাদেশে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বিশ্ববাজার থেকে আমদানি করলে দেশের বাজারে প্রতি কেজি চালের দাম পড়ে ৩৪ থেকে সর্বোচ্চ ৩৯ টাকা। যেখানে বাংলাদেশে ১ কেজি মোটা চাল কিনতে ভোক্তাকে খরচ করতে হচ্ছে ৪৮ টাকা। প্রতি কেজি চালে এক জন ভোক্তাকে অতিরিক্ত ১২ টাকা দিতে হচ্ছে। ৪ জনের একটি পরিবারের জন্য প্রতি মাসে চালের প্রয়োজন হয় ৪০ কেজি চাল। সে হিসেবে এক মাসে শুধু চালে অতিরিক্ত খরচ হয় ৪৮০ টাকা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক বস্তা চালের দাম বেড়েছে ৩০০ টাকা। গত সপ্তাহে যে মিনিকেট চালের দাম ছিল (বস্তা ৫০ কেজি) ২ হাজার ৩০০ টাকা। তা এখন কিনতে হচ্ছে ২ হাজার ৬০০ টাকায়। এ হিসেবে ১ কেজি চালের দাম পড়ে ৫২ টাকা। এক সপ্তাহে প্রতি কেজিতে দাম বেড়েছে ছয় টাকা।
সরকারি হিসাবেই চালের দাম বৃদ্ধিতে রেকর্ড গড়েছে বাংলাদেশ। সরকারি বিপণণ সংস্থা টিসিবি ও কৃষি বিপণণ অধিদপ্তরের হিসাবে ১ কেজি মোটা চাল কিনতে এখন খরচ করতে হচ্ছে ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা। এক বছর আগেও যার দাম ছিল ৩০ থেকে ৩৪ টাকা। অর্থাৎ বছর ব্যবধানে দাম বেড়েছে ৪২ শতাংশ। চালের দাম নিয়ে নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে খাদ্য মন্ত্রণালয়। যেখানে দেখা যায়, গত বছর সরকারি ভাবে আমদানি করা হয় ১ হাজার ২৮ মেট্রিক টন চাল। এবছর যা একেবারেই শূন্য। বেসরকারিভাবেও যেটুকু আমদানি হয়েছে তাও আগের বছরের অর্ধেকেরও কম। পাইকারি ব্যবসায়ী ও আড়তদাররা বলছেন, মিলাররা চাল পাঠায় কম। নির্দিষ্ট কোন দর নেই। চাহিদার তুলনায় আসছে সামান্য। দাম কম বেশি তো পরের হিসাব। চাহিদা অনুযায়ী চালের টাকা আগ্রিম দিয়েও পাচ্ছি না। এ কারণে দাম বাড়িয়ে বিক্রি করতে হচ্ছে।
তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে চাল ও গমের মজুদ। সর্বশেষ ৬ জুন খাদ্যশস্য পরিস্থিতি প্রতিবেদন অনুযায়ী চালের মজুদ ১ লাখ ৯৮ হাজার মেট্রিক টন ও গমের মজুদ দুই লাখ ৭৫ হাজার টন। সব মিলিয়ে চার লাখ ৭৩ হাজার মেট্রিক টন খাদ্যশস্য সরকারি গুদামে মজুদ রয়েছে।
সরকারের এ বছর বোরো মওসুমে ৭ লাখ মেট্রিক টন ধান আর ৮ লাখ মেট্রিক টন চাল সংগ্রহ করার কথা ছিল। কিন্তু পুরো মওসুমে তারা ধান-চাল ক্রয় করতে পেরেছে মাত্র ১১ হাজার মেট্রিক টন। এ বছর খোলা বাজার থেকে আর ধান-চাল সংগ্রহ করা কোনভাবেই সম্ভব হবে না। আর এ কারণেই সরকার চাল আমদানির পরিকল্পনা করছে। জানা গেছে, এসময় সরকারের গুদামে ধান-চাল থাকার কথা ছিল তিন গুন অর্থাৎ ৬ লাখ মেট্রিক টন চাল। আর তার মজুদের রয়েছে মাত্র ১ লাখ ৯৮ হাজার মেট্রিক টন। প্রয়োজনীয় মজুদ না থাকার কারনেই সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছে। আর নিজেদের মজুদ শেষ হওয়াতে ব্যবসায়ীদের তেমন চাপও সৃষ্টি করতে পারছে না। ব্যবসায়ীরা বলছেন বাজারে ধান-চাল নেই। তাই সরকার যেমন সংগ্রহ করতে পারেনি। আমরাও ধান-চাল সংগ্রহ করতে পারিনি। তবে বেসরকারি মিল মালিকদের নিকট কি পরিমান ধান মজুদ রয়েছে তার কোন হিসেব নেই সরকারের কাছে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষনা পরিষদের সাবেক পরিচালক ড.আসাদুজ্জামান বলেন, সরকারের মজুদ শেষ করে এখন চাল কিনতে দেশে দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন খাদ্যমন্ত্রী। অবস্থা এমন যে তিনি চাল কিনে মাথায় করেই নিয়ে আসবে। সরকারের উচিৎ ছিল গত ডিসেম্বর মাসে চাল আমদানি করা। এখনও সরকার একবার বলছেন চাল আমদানি হবে সাড়ে তিন লাখ টন, আবার বলেন তিন লাখ, কখনও বলেন আড়াই লাখ। আসলে সরকার চাল কিনবেন কিনা তা বুঝা যায় না। তবে সরকারের মজুদ ব্যবস্থা ভেঙ্গের পড়ার কারনেই চালের দাম বাড়ছে।
কুষ্টিয়া এবং নওগাঁ চালের মিলগুলোতে খোজ নিয়ে জানা গেছে,মওসুম হিসেবে মিলগুলোতে মোটা চাল যেমন থাকার কথা ছিল তার অর্ধেকও নেই। কারন হিসেবে মিল মালিকরা বলছেন,বন্যার কারনেই এমনটা হয়েছে। এছাড়াও ভারত থেকে চাল আমদানিতে শুল্ক বৃদ্ধির কারণেই বাজার বাড়ছে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন,সরকার যদি এখনই চাল আমদানিতে শুল্ক প্রত্যাহার না করে তাহলে দাম আরও বাড়বে। বিদেশে চালের দাম অনেক কম। এখনও চাল আমদানি করতে পারলে দাম কমবে।
জানা গেছে, সরকার বাজার নিয়ন্ত্রনে চাল আমদানির ওপর আরোপিত শুল্ক প্রত্যাহার করতে চায়। কিন্তু শুল্ক মুক্ত করে দেয়া হলে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর এ কারণেই সরকার চাল আমদানি করে মিল মালিক এবং ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করতে চায়। এতে করে বাজার বেশি নিয়ন্ত্রনে থাকবে বলে মনে করছে সরকার। কিন্তু সরকার নিজে চাল আমদানি করতে গিয়ে আর্ন্তজাতিক টেন্ডার আহবান করেও সময় মত তা পায়নি। এতে করে আমদানি বিলম্ব হয়ে যাচ্ছে। আর এ সুয়োগ নিচ্ছে দেশের অসাধু ব্যবসায়ীরা।
এমন অবস্থার মধ্যেই ৫০ হাজার টন নন- বাসমতি আতপ ও ৫০ হাজার টন নন-বাসমতি সিদ্ধ চাল কেনা হচ্ছে। এর মধ্যে প্রতি কেজি ৩৫ দশমিকত ৫১ টাকায় সিদ্ধ চাল ও ৩৩ দশমিক ৭৩ টাকায় আতপ চাল কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে খাদ্য অধিদপ্তর। ৫০ হাজার টন সিদ্ধ চাল কিনতে লাগছে ১৭৭ কোটি ৫৫ লাখ ৭৭ হাজার পাঁচশ’ টাকা এবং ৫০ হাজার টন আতপ চাল কিনতে লাগছে ১৬৮ কোটি ৬৮ লাখ ৯২ হাজার টাকা। সব মিলিয়ে এক লাখ টন চাল কিনতে প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা লাগছে। এ ব্যাপারে খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বদরুল হাসান বলেন, আন্তর্জাতিক কোটেশনের মাধ্যমে এক লাখ টন চাল কেনা হচ্ছে। চাল কেনার দরপত্র প্রস্তাব সুপারিশ আকারে খাদ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, খাদ্য অধিদপ্তরের কাছ থেকে এক লাখ টন চাল কেনার প্রস্তাব পেয়েছে তারা। গত ৩০ মে সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদনের জন্য দুটি আলাদা সার সংক্ষেপ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। সারসংক্ষেপে ৫০ হাজার টন আতপ ও ৫০ হাজার টন সিদ্ধ চাল কেনার অনুমোদন চেয়ে বলা হয়েছে, খাদ্যমন্ত্রী সারসংক্ষেপটি দেখেছেন, অনুমোদন করেছেন এবং সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদনের জন্য উপস্থাপনে সম্মতি দিয়েছেন।

http://www.dailysangram.com/post/287583-