১১ জুন ২০১৭, রবিবার, ১১:২৯

বেতনভাতা ও সুদ পরিশোধে করের অর্ধেকই ব্যয় হবে

বাজেট ২০১৭-১৮

আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটের জনগণের করের অর্ধেকই ব্যয় হবে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন, অবসর ভাতা ও সরকারি ঋণের সুদ ব্যয় পরিশোধে। আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে এ তিন খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ১৮ হাজার ২৩০ কোটি টাকা। কিন্তু এনবিআর থেকে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ৪৮ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে ইতোমধ্যেই সংশয় প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকেরা। এ হিসেবে জনগণের করের প্রায় অর্ধেকই চলে যাবে অনুন্নয়ন খাতে।
বাজেট বিশ্লেষকদের মতে, সরকারের প্রতিটি দফতরে শূন্য পদে লোকবল নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। একই সাথে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনভাতা বাড়ানো হয়েছে। ফলে সামগ্রিকভাবে বেতনভাতা ব্যয় বেড়ে গেছে। আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনভাতা ব্যয় প্রায় ৩৫ শতাংশ বেড়ে গেছে। আর অবসর ভাতা ও আনুতোষিক ব্যয় বেড়েছে ১১৫ শতাংশ। ফলে সামগ্রিকভাবে এ খাতে ব্যয় বেড়ে গেছে।
বাজেট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনভাতার জন্য ব্যয় হয়েছিল ৩৯ হাজার ৯৬১ কোটি টাকা। সেখানে মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে এ ব্যয় বেড়ে হয়েছে ৫৩ হাজার ৮৩৩ কোটি টাকা। মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে এ খাতে ব্যয় বেড়েছে ৩৪ দশমিক ৭১ শতাংশ। এর মধ্যে কর্মকর্তাদের বেতন দুই বছর আগে ছিল ৫ হাজার ৫২৯ কোটি টাকা, যেখানে আগামী অর্থবছরের জন্য এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৭ হাজার ৩৬১ কোটি টাকা। কর্মচারীদের পেছনে দুই বছর আগে বেতন বাবদ ব্যয় হয়েছিল ১৭ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা। সেখানে আগামী অর্থবছরের জন্য এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২১ হাজার ৭৫৪ কোটি টাকা। আর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ভাতাদি বাবদ ব্যয় হয়েছিল দুই বছর আগে ১৬ হাজার ৬৫২ কোটি টাকা, সেখানে আগামী অর্থবছরে ব্যয় হবে ২৪ হাজার ৭১৮ কোটি টাকা।
এ দিকে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনভাতাদির পাশাপাশি অবসর ভাতা ও আনুতোষিক ব্যয়ও বেড়ে গেছে। দেখা যায়, বেতনভাতাদির চেয়ে অবসর ভাতা ও আনুতোষিক ব্যয় বেড়েছে বেশি। আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে অবসর ভাতা ও আনুতোষিক খাতে ব্যয় হয়েছিল ১০ হাজার ৬৩২ কোটি টাকা। সেখানে আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে এ খাতে ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা, যা শতকরা ১১৫ ভাগ বেশি। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মুক্তিযোদ্ধাসহ বিভিন্ন সময় চাকরির বয়স বাড়ানো হয়েছিল। ফলে পূর্বনির্ধারিত সময়ে তারা অবসরে যাননি। এতে অবসর ভাতাও পরিশোধ করতে হয়নি। কিন্তু বর্ধিত সময় পার হওয়ার পর স্বাভাবিক অবসরের পাশাপাশি পুরনোদেরও অবসর ভাতা যোগ হওয়ায় এ খাতে ব্যয় অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে।
এ দিকে বাজেটের আকার বড় হচ্ছে। বাড়ছে সরকারের ব্যয়। কিন্তু ব্যয় অনুযায়ী আয় হচ্ছে না। ফলে বাড়ছে ঘাটতি বাজেট। আর এ ঘাটতি মেটাতে নিতে হচ্ছে ঋণ। এতে প্রতি বছরই ঋণ বাড়ছে। সেই সাথে বাড়ছে ঋণের সুদ। আগামী অর্থবছরের (২০১৭-১৮) জন্য প্রস্তাবিত বাজেটের ৪১ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকাই বরাদ্দ রাখা হয়েছে সুদ পরিশোধের জন্য; যা কিনা অনুন্নয়ন বাজেটের (২ লাখ ৪৫ হাজার ১৪ কোটি টাকা) একক খাত হিসেবে সর্বোচ্চ ১৬ দশমিক ৯ শতাংশ। আর মোট বাজেটের (৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকা) ১০ দশমিক ৪ শতাংশ।
এ দিকে সরকারের ব্যয়ের অঙ্ক বাড়লেও সামগ্রিভাবে আয় বাড়ছে না। চলতি অর্থবছরের এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ২ লাখ ৩ হাজার ১৫২ কোটি টাকা। কিন্তু কাক্সিক্ষত হারে রাজস্ব আদায় না হওয়ায় রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা কাটছাঁট করে ১ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়েছে। আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২ লাখ ৪৮ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। ব্যবসায় বাণিজ্য স্থবিরতাসহ নানা কারণে রাজস্ব আদায়ের এ লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়ন হওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকেরা। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বেতনভাতা ও সুদ ব্যয় কমবে না, বরং বেড়ে যাবে। ফলে জনগণের করের বেশির ভাগ চলে যাবেই এ অনুন্নয়ন খাতে। বিশ্লেষকেরা জানান, সরকারের ভুল নীতির কারণে এ সুদ ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে ঘাটতি মেটানো হচ্ছে। অথচ নীতি পরিবর্তন করলে অপেক্ষাকৃত কম সুদে ঘাটতি বাজেটের অর্থায়ন করা যেত। এটি অব্যাহত থাকলে সামনে সরকারি কর্মচারীদের বেতনভাতা ও সুদ পরিশোধেই বাজেটের সব অর্থ ব্যয় করতে হবে। সঙ্কুচিত হয়ে যাবে উন্নয়ন বাজেটও।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/227509