প্রতিদিন এভাবেই যুদ্ধ করে পথ চলতে হয় মধ্যবিত্তকে। ছবিটি রাজধানীর ফার্মগেট এলাকা থেকে তোলা। ছবি : কালের কণ্ঠ
১১ জুন ২০১৭, রবিবার, ১১:২১

মধ্যবিত্তের পকেট কাটে গণপরিবহন মালিকরা

ঢাকা মহানগরীতে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের দৈনন্দিন চলাচলের বড় অবলম্বন গণপরিবহন। বাস-মিনিবাস, অটোরিকশা ও হিউম্যান হলার ঘিরে এ ব্যবস্থা।

অথচ এই গণপরিবহন চক্রে বাস ও মিনিবাসের সংখ্যা ১ শতাংশেরও কম। অটোরিকশা আছে প্রায় ১৩ হাজার। আর গণপরিবহনের এ সংকটকে পুঁজি করে বাস-মিনিবাসের মালিকরা দেদার যাত্রীদের পকেট কেটে চলেছেন।
জাবালে নূর পরিবহনের সিটিং বাসটি দুলতে দুলতে চলছে। দরজা বন্ধ। তবে যানজটে থামলেই দরজা খুলে যাত্রী তোলা হচ্ছে। আগারগাঁও থেকে কুড়িল পর্যন্ত প্রায় ১৪ কিলোমিটার পথ। মিরপুর ১০ নম্বর থেকে মিরপুর-১২ পর্যন্ত রাস্তার এক পাশ বেশির ভাগ অংশেই বন্ধ। আগারগাঁও থেকে শেওড়াপাড়া, মিরপুর-১০, মিরপুর-১১ থেকে ১২ পর্যন্ত স্থানে স্থানে ভিড়। যানজটে গাড়ি থামলেই দরজা খুলে দেওয়া হচ্ছে। ফলে যাত্রীরা অহরহ উঠছে, নামছে। গত মঙ্গলবার বিকেল ৩টায় বাসে এভাবে ঠাসাঠাসি করে যাত্রী তুলেও সব দূরত্বের যাত্রীর কাছ থেকে ২৫ টাকা করে ভাড়া নেওয়া হচ্ছিল। অথচ সরকার নির্ধারিত হারে ১৪ কিলোমিটার পর্যন্ত ভাড়া ২০ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়।
একজন নিয়মিত যাত্রী সাজেদা বেগমের কাছে জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘অটোরিকশায় উঠলেই ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। ট্যাক্সি মেলেই না। বাধ্য হয়েই বেশি ভাড়া দিয়ে এভাবে যেতে হচ্ছে। ’
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) রুট পারমিটে সিটিং বাস চালানোর বৈধতা নেই। তবে প্রায় দুই দশক ধরে রাজধানীতে বিশেষ সেবা দেওয়ার নামে এই সার্ভিস চলছে। আর ভাড়া আদায় করা হচ্ছে সরকারি হারের চেয়ে অনেক বেশি।
গত এপ্রিলে পরিবহন মালিকদের একটি অংশ সিটিং সার্ভিস বন্ধ করতে হঠাৎ উদ্যোগী হলে অন্য অংশ কৃত্রিম সংকট তৈরি করে ঢাকা অচল করে দেয়। সরকার বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। প্রথমে ১৫ দিনের জন্য সিটিং সার্ভিস বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত স্থগিত ও পরে তিন মাস মেয়াদি কমিটি গঠন করে পরিস্থিতি এড়িয়ে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আগামী নির্বাচনের আগে গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনার বিষয়ে সরকার কোনো সিদ্ধান্ত নিতে নারাজ। কারণ তাতে স্বাভাবিক পরিবহনব্যবস্থা ব্যাহত হতে পারে। সিটিং সার্ভিস বন্ধ হলে নতুন বাস নামাতে হবে। এ বিষয়ে ঘোষণা থাকলেও প্রস্তুতি নেই, সমন্বয়ও নেই। নগরীর গণপরিবহন-ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা প্রশ্নে বিআরটিএর পাশাপাশি ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন, ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ, বিভিন্ন পরিবহন কম্পানি ও সমিতি সংশ্লিষ্ট। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক ব্যক্তি কালের কণ্ঠকে বলেন, নির্বাচনের আগে ঢাকার সড়কে শৃঙ্খলা আনতে হলে লাখ লাখ রিকশা উচ্ছেদ করতে হবে। ভোটের জন্য সেগুলো উচ্ছেদ করা যাবে না।
ঢাকায় সিটিং সার্ভিস বাস চলবে কি না সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে বিআরটিএর পরিচালক (সড়ক নিরাপত্তা) মাহবুব-ই-রব্বানীকে প্রধান করে আট সদস্যের কমিটি করা হয়েছে। গত ১৯ এপ্রিল অনুষ্ঠিত বৈঠকে ১৫ দিন সিটিং সার্ভিস চলতে কোনো বাধা না দেওয়ার সিদ্ধান্তের পাশপাশি এসব বাসে সরকার নির্ধারিত হারের অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা যাবে না বলেও জানানো হয়েছিল। কিন্তু সিদ্ধান্তের পর থেকে সিটিং সার্ভিসে ভাড়া-সন্ত্রাস যেন আরো বেড়েছে। এমনকি কমিটির প্রধান মাহবুব-ই-রব্বানী নিজেই যাত্রীদের অভিযোগ আমলে নিচ্ছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে।
গুলিস্তান থেকে মেয়র হানিফ উড়াল সড়ক হয়ে নারায়ণগঞ্জ, সাইনবোর্ড, আদমজীসহ বিভিন্ন রুটে সিটিং সার্ভিসে ভাড়া-সন্ত্রাস চলছে। গুলিস্তান থেকে আদমজী পর্যন্ত সরকারি হারে যাত্রীপ্রতি এসব বাসে ভাড়া ২২ টাকা। অথচ আদায় করা হচ্ছে ৩৫ টাকা। গুলিস্তান থেকে সাইনবোর্ড পর্যন্ত যাত্রীপ্রতি ভাড়া ১৩ টাকা, আদায় করা হচ্ছে ২৫ টাকা।
কোমল মিনিবাস সার্ভিসের বাসে গুলিস্তান থেকে সাইনবোর্ড রুটের নিয়মিত যাত্রী মোজাম্মেল হক চৌধুরী কালের কণ্ঠকে চলমান ভাড়া-সন্ত্রাসের বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘বিআরটিএর মাহবুব-ই-রব্বানীর কাছে কোমল মিনিবাসের ভাড়া-সন্ত্রাসের প্রমাণ হিসেবে টিকিট ও অভিযোগ জমা দিয়েছিলাম। কোনো প্রতিকার হয়নি। ’
রমজান মাসের শুরু থেকেই গণপরিবহন সংকট ও অতিরিক্ত ভাড়ার কারণে যাত্রীদের দুঃসহ ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, নগরীর ৮৮ শতাংশ সিটিং বাসই দরজা বন্ধ রাখছে। ৯৮ শতাংশ অটোরিকশাই ‘বখশিশ’ দাবি করছে। তাতে যাত্রীদের ভোগান্তি চরমে উঠেছে।
সংস্থার উপকমিটির তিনটি দল গত ৩ ও ৪ জুন নগরীতে রমজান মাসে যাত্রী ভোগান্তি ও ভাড়া-নৈরাজ্য পর্যবেক্ষণ করে। তারা ৩১৩টি বাস ও ৩৮৬ জন বাসযাত্রী, ১৬০টি অটোরিকশা ও ৫৬ জন অটোরিকশার যাত্রী, ৮৮ জন ট্যাক্সিক্যাব যাত্রীর সঙ্গে কথা বলে। পর্যবেক্ষণকালে ৭৬ শতাংশ যাত্রী প্রচলিত গণপরিবহন-ব্যবস্থায় তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করে। ৮৮ শতাংশ যাত্রী প্রতিদিন যাতায়াতে দুর্ভোগের মুখোমুখি হয় বলে জানায়। ৯২ শতাংশ যাত্রী অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের শিকার হয় বলে জানায়। হয়রানির শিকার হলেও অভিযোগ কোথায় করতে হয় জানে না ৯০ শতাংশ যাত্রী।
যাত্রীকল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে, রমজানের শুরু থেকে পরিবর্তিত অফিস সময় অনুযায়ী যাতায়াতে নগরীর যাত্রীসাধারণ চরম ভোগান্তিতে পড়ছে। সকাল ৭টা থেকে সকাল ১১টা ও দুপুর ২টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত নগরীতে চলাচলকারী বাস-মিনিবাসের প্রায় ৮৮ শতাংশ সিটিং সার্ভিসের নামে দরজা বন্ধ করে যাতায়াত করে। এতে মাঝপথের যাত্রীরা চরম ভোগান্তিতে পড়ছে। এসব বাস সরকার নির্ধারিত ভাড়ার পরিবর্তে কম্পানি নির্ধারিত অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে।
এদিকে যাত্রাবাড়ী, পোস্তগোলা, শাহবাগ, ফার্মগেট, মহাখালী, আগারগাঁও, ধানমণ্ডি, বনানী, বারিধারাসহ নগরীর অনেক গুরুত্বপূর্ণ এলাকার রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও ট্যাক্সিক্যাবের দেখা মিলছে না। যাত্রীসাধারণের অফিস যাত্রা এবং অফিস ছুটি শেষে ইফতার ও তারাবিকে টার্গেট করে নগরীতে চলাচলকারী বেসরকারি বাসের প্রায় সবই রাতারাতি সিটিং সার্ভিস হয়ে গেছে।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/upset-middleclass/2017/06/11/507434