১০ জুন ২০১৭, শনিবার, ৮:৪৪

যুক্তরাজ্যে ঝুলন্ত পার্লামেন্ট

সরকার গঠনে কনজারভেটিভরা লেবারদের আশাতীত সাফল্য

আরো মজবুত অবস্থান তৈরির লক্ষ্যে আগাম নির্বাচন দিয়ে যেন রাজনৈতিক জুয়া খেলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে। সমালোচকদের ধারণা ছিল, এ খেলায় জিতে গেলে মার্গারেট থ্যাচারের মতো আরেক লৌহমানবী হয়ে উঠবেন তিনি।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিপর্যয় সৃষ্টিকারী এক ফলে তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছেন। আগাম নির্বাচন তাঁর দলের জন্য সর্বনাশ ডেকে এনেছে। তবু নতি স্বীকার না করে তিনি একটি সংখ্যালঘু জোট সরকার গড়তে যাচ্ছেন।
যুক্তরাজ্যে গত বৃহস্পতিবার রাত ১০টায় (বাংলাদেশ সময় রাত ৩টা) ভোট শেষ হওয়ার পরপরই নাটকীয় সব ঘটনা ঘটেছে। ভোটের পরপরই যে ‘এক্সিট পোল’ (বুথফেরত ভোটারদের ওপর পরিচালিত সমীক্ষার ফল) ঘোষণা করা হয়েছে, তাতেই স্পষ্ট হয়—কনজারভেটিভরা ওয়েস্টমিনস্টারে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারাতে যাচ্ছে। নিন্দুকরা তখন বলেন, মে আত্মঘাতী গোল দিয়ে বসেছেন। তাঁর পদত্যাগ সময়ের ব্যাপার মাত্র! পদত্যাগের সম্ভাবনা বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে সনিংয়ের ফলাফল ঘোষণা মঞ্চ ছেড়ে বেরিয়ে গিয়ে জল্পনা-কল্পনা আরো বাড়ান মে। ফল দেখে উচ্ছ্বসিত লেবার নেতা জেরেমি করবিন প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগের আহ্বান জানিয়ে নিজেই সরকার গঠনের আশা প্রকাশ করেন। রাতভর টোরিদের ওয়েস্টমিনস্টারে একক আধিপত্য হারানোর শঙ্কা আর লেবারসহ বিরোধীদের বিজয়োল্লাস সত্ত্বেও গতকাল শুক্রবার দুপুর নাগাদ ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হাউস অব কমন্সের ৬৫০ আসনের নির্বাচনের যে ফলাফল দাঁড়িয়েছে তাতে কোনো দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। সরকার গঠনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর প্রয়োজন ছিল অন্তত ৩২৬টি আসনে জয়। গতকাল এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ৬৪৯টি আসনের ফল প্রকাশিত হয়েছে। তাতে কনজারভেটিভরা ৩১৮টিতে জিতেছে, যা প্রয়োজনীয় আসনের চেয়ে আটটি কম।
যে আসনের ফল প্রকাশিত হয়নি সেই পশ্চিম লন্ডনের কেনসিংটন আসনের ভোট গণনা স্থানীয় সময় শুক্রবার সন্ধ্যা (বাংলাদেশ সময় শনিবার ভোর) পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছে। ২০১৫ সালে এ আসনটিতে কনজারভেটিভরা জিতেছিল। গত বৃহস্পতিবার নির্বাচনের পর দুই দফা ভোট গণনায় খুব কাছাকাছি ফল আসায় তৃতীয় দফায় ভোট গণনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
আগের নির্বাচনে কনজারভেটিভরা ৩৩০টি আসনে জয়ী হয়ে এককভাবে সরকার গঠন করেছিল। এবার তাদের নর্দান আয়ারল্যান্ডের ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নিস্ট পার্টির (ডিইউপি) সঙ্গে জোট করে সরকার গঠনের জন্য ন্যূনতম আসনসংখ্যা পূরণ করতে হচ্ছে। ডিইউপি ১০টি আসনে বিজয়ী হয়েছে।
বিরোধী লেবার দল আগের নির্বাচনের চেয়ে এবার ২৯টি বেশি পাওয়ায় ওয়েস্টমিনস্টারে দলটির আসনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৬১টি। স্কটিশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি পেয়েছে ৩৫টি, যা তাদের আগের নির্বাচনে পাওয়া আসনের চেয়ে ২১টি কম। লিবারেল ডেমোক্রেট ১২টি, সিনফেইন সাতটি, প্লাইড ক্যামরি চারটি এবং গ্রিন পার্টি একটি আসন পেয়েছে। গত নির্বাচনে একটি মাত্র আসন পাওয়া কট্টরবাদী ইউকে ইনডিপেনডেন্ট পার্টি (ইউকেআইপি) এবার কোনো আসনেই সাফল্য না পেয়ে ধুয়ে-মুছে গেছে। তাত্ক্ষণিকভাবে ব্যর্থতার দায় নিয়ে পল নুটাল দলটির নেতৃত্ব ছেড়েছেন।
টোরিদের ফল বিপর্যয়ের মধ্যে লেবাররা গতকাল যখন সংখ্যালঘু সরকার গঠনের জন্য সম্ভাব্য জোট গড়ার হিসাব-নিকাশ করছিল, তখন টেরেসা মে বাকিংহাম প্রাসাদে ব্রিটিশ রাষ্ট্রপ্রধান রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের সঙ্গে দেখা করে জোট সরকার গঠনের আগ্রহের কথা জানান।
এর পরপরই ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে নিজ কার্যালয়ের সামনে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেন, ডিইউপির সহযোগিতা নিয়ে তিনিই সরকার গঠন করবেন। আর ওই সরকার যুক্তরাজ্যকে একটি নিশ্চিত ভবিষ্যৎ উপহার দেবে।
তিনি বলেন, এ নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া ও সবচেয়ে বেশি আসনে জয়ী হওয়া তাঁর দলই শুধু একটি বৈধ সরকার গঠন করতে পারে। সংকটময় এ সময়ে তিনিই ব্রিটেনকে নেতৃত্ব দেবেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে আসার (ব্রেক্সিট) প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে তিনি ডিইউপির বন্ধু ও মিত্রদের সঙ্গে কাজ করবেন।
পরে অবশ্য তিনি সুর কিছুটা নরম করে আসন হারানো তাঁর দলীয় সহকর্মীদের প্রতি দুঃখ প্রকাশ করেছেন। কেন তাঁরা আসন হারালেন সে বিষয়টিও তিনি খতিয়ে দেখছেন বলে জানান।
এদিকে ডিইউপি নেতা আর্লেন ফস্টার দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে সকালেই তাঁর সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন। যুক্তরাজ্যে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় তাঁর দল টোরিদের সঙ্গে কিভাবে কাজ করতে পারে সে বিষয়ে তাঁরা আলোচনা করবেন।
তবে লেবারদলীয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের চিফ অব স্টাফ জনাথন পাওয়েল বলেছেন, ডিইউপির সঙ্গে টেরেসা মের সমঝোতা বড় ভুল হবে। কারণ এটি নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডে শান্তিপ্রক্রিয়া ব্যাহত করতে পারে।
গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীরা থাকছেন নতুন মন্ত্রিসভায় : ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর গত শুক্রবার রাতে এক বিবৃতিতে বলেছে, প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে নতুন সরকারের মন্ত্রিসভার অর্থমন্ত্রী হিসেবে ফিলিপ হ্যামন্ড, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে আম্বার রুড, পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথবিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে বরিস জনসন, ব্রেক্সিটবিষয়ক মন্ত্রী ডেভিড ডেভিস এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে স্যার মাইকেল ফ্যালনের নিয়োগ নিশ্চিত করেছেন। তাঁরা সবাই গত বছর থেকেই এসব পদে দায়িত্ব পালন করছেন।
টেরেসা মের প্রধানমন্ত্রী পদে থাকা ও সরকার গঠনের ঘোষণার পরও লেবার নেতা জেরেমি করবিন মেকে পদত্যাগের আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, এ দায়িত্ব তিনিও নিতে প্রস্তুত।
লিবারেল ডেমোক্র্যাট নেতা টিম ফ্যারনও বলেন, আত্মসম্মান বোধ থাকলে এই ফলাফল দেখে টেরেসা মের লজ্জিত হয়ে পদত্যাগ করা উচিত। কারণ ভোটাররা তাঁর ব্রেক্সিট পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করেছে।
সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী আগামী মঙ্গলবার হাউস অব কমন্সের নতুন স্পিকার নির্বাচন করা হবে। এরপর সদস্যরা শপথ নেবেন। আগামী ১৯ জুন হাউস অব কমন্সের অধিবেশন বসার কথা রয়েছে। সেখানে রানি বক্তব্য দেবেন।
ইইউর প্রতিক্রিয়া : যুক্তরাজ্যে নির্বাচনের এ ফলাফলে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে ইইউতেও। কারণ তারাও চেয়েছিল যুক্তরাজ্যের একটি শক্তিশালী সরকারের সঙ্গে ব্রেক্সিট আলোচনা করতে, যাতে তা টেকসই হয়। ব্রেক্সিট ইস্যুতে ইইউর প্রধান আলোচক গাই ভেরহফস্ট্যাড্টও এ ফলকে মে’র আত্মঘাতী গোল হিসেবে অভিহিত করেছেন।
অন্যদিকে ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট জ্যাঁ ক্লদ জ্যাংকার যুক্তরাজ্যে নির্বাচনের ফলাফল যাই হোক না কেন, পূর্বনির্ধারিত ব্রেক্সিট আলোচনার তারিখ পেছানোর সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, তাঁদের সামনে দুই বছর সময় আছে। ব্রিটিশ গণতন্ত্র গত বৃহস্পতিবারের যে ফল বয়ে এনেছে তা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড টাস্ক প্রধানমন্ত্রী পুনর্নির্বাচিত হওয়ায় টেরেসা মেকে অভিনন্দন জানিয়েছেন এবং অতীতের মতো আগামীতেও তাঁর সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রাখার আশ্বাস দিয়েছেন।
উল্লেখ্য, আগামী ১৯ জুন ইইউর সঙ্গে ব্রেক্সিট ইস্যুতে যুক্তরাজ্যের আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হওয়ার কথা। ওই আলোচনার আগে ভোটের মাধ্যমে নিজেকে আরো শক্তিশালী করতে চেয়েছিলেন টেরেসা মে। এখন ঝুলন্ত পার্লামেন্টে তাঁকে বিভিন্ন আইন প্রণয়ন ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে অন্য দলগুলোর সহায়তা নিতে হবে।


http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/06/10/507135