১০ জুন ২০১৭, শনিবার, ৮:৪১

সর্বসাধারণের সার্বভৌমত্ব চাই

আত্মপক্ষ

|| এবনে গোলাম সামাদ ||

আমি কখনো আইন পড়িনি। তবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করার সময় আইন বিভাগের একজন অধ্যাপকের সঙ্গে আমার সখ্য গড়ে উঠেছিল। তিনি আমাকে আইনের দার্শনিক ভিত্তি নিয়ে অনেক কিছু বলেছিলেন। ফলে আইনের দার্শনিক দিক সম্পর্কে আমার মনে একটা ‘কাজ চলা’ ধারণা গড়ে ওঠা সম্ভব হতে পেরেছিল। আমার সেই বন্ধু এখন আর বেঁচে নেই। মাঝে মাঝে আমি তার অভাববোধ করি নানা কারণে। কেবল আইন সম্পর্কিত বিষয়ে জানার কারণে নয়, তিনি দেশ নিয়েও যথেষ্ট ভাবতেন। তার সাথে তাই দেশের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ নিয়েও কথা বলে উপকৃত হতাম। তিনি আমাকে একটি বই পড়তে দিয়েছিলেন। বইটির নাম The Law of the Constitution| লেখক A. V. Dicey| বইটি প্রথম প্রকাশ হয়েছিল ১৯১৫ সালে লন্ডন থেকে। বইটি ছিল ছেঁড়া ছেঁড়া। পড়তে আমার কষ্ট হয়েছিল। কিন্তু পড়েছিলাম যথেষ্ট মনোযোগ দিয়ে। বইটিতে ডাইসি বলেছেন, আইনের সার্বভৌমত্ব সব কথা নয়, মানুষ নিয়ে রাষ্ট্র। মানুষ যদি বিদ্রোহী হয়ে ওঠে, তবে আইন অচল হয়ে পড়ে। আদালত এমন কিছু করতে পারে না, যাতে গণবিদ্রোহ দেখা দিতে পরে। আইনের সার্বভৌমত্বকে মাথা নত করতে হয় গণসার্বভৌমত্বের কাছে। আইনের শেষ ভিত্তি হলো একটা দেশের সর্বসাধারণের সাধারণ সম্মতি। তাদের সম্মতিকে বাদ দিলে আইনের শাসন অচল হয়ে পড়ে। ডাইসির নিজের কথায়, Behind the sovereign which the lawyer recognises, there is another sovereign to whom the legal sovereign must bow. ডাইসির মতে এই সার্বভৌম শক্তি হলো, রাজনৈতিক শক্তি, যা শেষ পর্যন্ত আইনের সৃষ্টি করে লোকায়ত রাষ্ট্রে। বাংলাদেশে আজ বিতর্ক চলেছে আইনের সার্বভৌমত্ব ও রাজনৈতিক সার্বভৌমত্ব, কোনটা বড় সে প্রসঙ্গে। আমরা যদি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র চাই, তবে অবশ্যই সর্বসাধারণের সার্বভৌমত্বকে গুরুত্ব দিতে হবে। নতুবা গণতন্ত্র হয়ে পড়বে অর্থহীন। কিন্তু আমাদের বিচার বিভাগ দাবি করছে এতটা স্বাধীনতা যে, তা কখনো গণতন্ত্রে সম্ভব নয়। কেননা, গণতন্ত্রে শেষ সার্বভৌমত্ব থাকতে বাধ্য নির্বাচকমণ্ডলীর হাতে।
বাংলাদেশে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি যা বলছেন, তা গণতন্ত্রের মূল চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তিনি যা বলছেন, তাতে বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের মধ্যে হয়ে উঠবে ‘আর একটি রাষ্ট্র’। তা মূল রাষ্ট্রব্যবস্থাকে করে তুলবে অচল। কিন্তু মনে রাখা ভালো, নির্বাহী বিভাগের হাতে থাকে রাষ্ট্রের মূল ক্ষমতা। তার নির্দেশে চলে পুলিশ, সেনাবাহিনী ও সিভিল সার্ভিস। তার সহযোগিতা ব্যতিরেকে বিচার বিভাগের কোনো হুকুম শেষ পর্যন্ত কার্যকর হতে পারে না। আইনের পেছনে থাকতে হয় রাষ্ট্রিক শক্তির সমর্থন। আর রাষ্ট্রের মূল বিভাগ বিচার বিভাগ নয়; নির্বাহী বিভাগ। কেননা তার হাতে থাকে রাষ্ট্রযন্ত্র।
আমাদের সংবিধান অনুসারে, বিচার বিভাগ সংবিধানের ব্যাখ্যাকর্তা। কিন্তু সংবিধানের রচয়িতা সে নয়। সংবিধানে পরিবর্তন আনতে হলে সেটা করতে পারে কেবল আইন পরিষদ। আইন পরিষদ ১৯৮৮ সালের ৭ জুন ইসলামকে করেছিল রাষ্ট্রধর্ম, অষ্টম সংশোধনী বিলের মাধ্যমে। রাষ্ট্রধর্ম অনেক দেশেরই আছে। যেমন ইংল্যান্ডের রাষ্ট্রধর্ম হলো অ্যাংলিকান খ্রিষ্টান ধর্ম। ইংল্যান্ডের রাজা-রানীকে হতে হয় অ্যাংলিকান। বিলাতের রাজা-রানী কোনো ক্যাথলিক খ্রিষ্টান হতে পারেন না। সুইডেন একটি অতি উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। সুইডেনের রাষ্ট্রধর্ম হলো লুথেরান খ্রিষ্টান ধর্ম। সুইডেনের রাজা-রানীকে হতে হয় লুথেরান খ্রিষ্টান। আমাদের কাছের রাষ্ট্র মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রধর্ম হচ্ছে ইসলাম। কিন্তু আমাদের প্রধান বিচারপতি বলছেন রাষ্ট্রধর্ম বলে নাকি কিছু হতে পারে না। প্রধান বিচারপতি হয়ে তিনি কী করে সংবিধানের পরিপন্থী কথা বলতে পারছেন, সেটা নিয়ে দেখা দিয়েছে প্রশ্ন। তিনি বলছেন, রাষ্ট্র কোনো মানুষ নয়, তাই রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকতে পারে না। অথচ যেকোনো রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বই-ই বলবে, রাষ্ট্রের উপাদান হলো তিনটি : জনসমাজ (Population), নির্দিষ্ট ভূভাগ (Territory) এবং সার্বভৌম সরকার (Government)। জানি না, প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কোনো অভিধানের সঙ্গে আদৌ পরিচিত কি না। কেননা, যেকোনো প্রাথমিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বইতে রাষ্ট্রের যে সংজ্ঞা দেয়া হয়, তাতে থাকতে দেখা যায় এই তিনটি উপাদানের উল্লেখ। আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে ১৯৫২ সালে প্রবর্তন করা হয় হিন্দু কোড বিল। হিন্দু বলতে বোঝায় তাদের, যারা মুসলমান নয়, খ্রিষ্টান নয়, পারসিক নয়, ইহুদি নয়। ভারত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। কিন্তু সব ধর্মসম্প্রদায়ের লোকের জন্য এক রকম উত্তরাধিকার আইন করা যায়নি। যেমন মুসলমানদের উত্তরাধিকার আইন এখনো নিয়ন্ত্রিত হয়ে চলেছে শরিয়াহ আইন অনুসারে। তাই অনেকের মনেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে আমাদের প্রধান বিচারপতির রাষ্ট্র সম্পর্কিত বক্তব্য সম্পর্কে। তিনি ১৯৭৪ সালে আইনে বিএল ডিগ্রি নেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। আইনে তার এর চেয়ে উচ্চ কোনো ডিগ্রি আছে কি না, সে বিষয়ে আমরা জ্ঞাত নই। তিনি ধর্মে বৈষ্ণব হিন্দু। তিনি নৃজাতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাঙালিও নন। তিনি হলেন মনিপুরী। তারা একসময় মনিপুর থেকে এসে শ্রীহট্ট (সিলেট) বিভাগের মৌলভীবাজার জেলায় উপনিবিষ্ট হন। তাদের মাতৃভাষা বাংলা নয়, মনিপুরী বা মেইতেই, যা বৃহৎ চীনা পরিবারভুক্ত। তার পক্ষে বাংলাদেশের মুসলিম মনমানসিকতাকে ভুল বোঝা অসম্ভব নয়। সম্ভবত সেটাই ঘটছে। সর্বোপরি, যেটা বোঝা সম্ভব হচ্ছে না, তা হলো, তার কাছে কেউ সংবিধানের ব্যাখা চায়নি। কিন্তু তিনি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সংবিধান সম্পর্কে বলছেন কথা। এটা কোনো বিচারপতির কাছ থেকেই বাঞ্ছিত নয়।
যুক্তরাষ্ট্র একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। কিন্তু সে দেশেও ধর্ম (খ্রিষ্টান) সম্পর্কে এমন কিছু বলা যায় না, যাতে শান্তি ভঙ্গ হতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আছে ব্লাসফেমি আইন। কোনো ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে ধর্ম নিয়ে যা খুশি তাই মন্তব্য করা চলে না। কিন্তু আমাদের দেশে করা হচ্ছে। প্রধান বিচারপতি কেবল ধর্ম নিয়ে মন্তব্যই করছেন না, তার সময়ে স্থাপন করা হয়েছে গ্রিক দেবী থেমিসের মূর্তি সুপ্রিম কোর্টের অঙ্গনে। তা এ দেশের মুসলিম মানসে প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। মনে হচ্ছে, এ দেশে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে, যাতে দেশ এগিয়ে যায় মারাত্মক সঙ্ঘাতের পথে। অনেকে করছেন তার সমালোচনা। আর মনে হয় এই সমালোচনা কেবলই কোনো আক্রোশবশত কারণে হচ্ছে না, তার আচরণ ও বক্তব্যই তাকে করে তুলেছে সমালোচনার সম্মুখীন। কেবল আইনের জোরে এই সমালোচনার কণ্ঠ রোধ করা সম্ভব হবে বলে মনে করলে ভুল করা হবে। কেননা আইনের সার্বভৌমত্বের চেয়ে জনমতের সার্বভৌমত্বকে ছোট করে দেখলে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিরাট ভুল করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফেডারেল কোর্টে কোনো বিচারপতি অসদাচরণ করলে মার্কিন কংগ্রেস তাকে অপসারণের ক্ষমতা রাখে। হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভ একজন ফেডারেল বিচারপতির বিপক্ষে অভিযোগ উত্থাপন করলে তার বিচার করে সিনেট। সিনেটের মোট সদস্যের অন্তত দুই-তৃতীয়াংশ যদি বলেন, ওই বিচারপতি অসাধু আচরণ করেছেন, তবে তাকে বিদায় নিতে হয়। আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে যদি লোকসভার এবং রাজ্যসভায় প্রত্যেকে কোনে বিচারপতিকে কম করে দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে অসাধু আচরণের জন্য দায়ী করে, তবে তাকে চলে যেতে হয়। তিনি আর বিচারপতি থাকতে পারেন না। কিন্তু বাংলাদেশে যখন আইন পাস করা হচ্ছে, আইন পরিষদ কম করে হলেও দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে কোনো বিচারপতিকে বরখাস্ত করতে পারবে, তখন বিচার বিভাগের পক্ষ থেকে করা হচ্ছে এর বিরোধিতা। প্রশ্ন উঠছে, আমাদের সংবিধান বিচার বিভাগকে এরকম বিরোধিতা করার অধিকার দিয়েছে কি না, তা নিয়ে। কে করবেন এই প্রশ্নের সমাধান? ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়, একমাত্র জনপ্রতিনিধিরাই এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। রাষ্ট্রের অন্য কোনো অঙ্গ তা নিতে পারে না; যদি বাংলাদেশ প্রকৃত গণতন্ত্রের চর্চা করতে চায়।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/227128