৯ জুন ২০১৭, শুক্রবার, ১১:১১

নতুন ভ্যাটে বাড়বে এলপি গ্যাসের দাম

নতুন মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আইন কার্যকর হলে বাড়বে এলপি গ্যাসের দাম। ট্যারিফ মূল্যের পরিবর্তে বিক্রয়মূল্যের ভিত্তিতে হিসাব শুরু হলে এ খাতে ভ্যাটের পরিমাণ সিলিন্ডারের আকারভেদে এক হাজার ২৮ শতাংশ থেকে এক হাজার ৫৮৯ শতাংশ হারে বাড়বে।

ফলে এলপি গ্যাস ব্যবহারকারীদের সিলিন্ডারভেদে ৫৪ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বেশি দিতে হবে। এ অবস্থায় অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিবেচনায় এলপি গ্যাসের ওপর থেকে ভ্যাট অব্যাহতি চায় ব্যবহারকারী ও উদ্যোক্তারা।
পাইপলাইনে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহারের ওপর চাপ কমাতে ১৯৯১ সালের ভ্যাট আইনে এলপি গ্যাসের ট্যারিফ মূল্যের ওপর ভ্যাট আরোপ করা হয়। বর্তমানে এ খাতে ভ্যাট ১৫ শতাংশ। এতে মূল্য সহনীয় থাকায় এলপির ব্যবহার বাড়ছে। কিন্তু নতুন (২০১২ সালের ভ্যাট আইন) আইনে ট্যারিফ মূল্যভিত্তিক পদ্ধতি প্রত্যাহার করে সর্বজনীন ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে।
নতুন আইনের ধারা-২৬ এর আওতায় প্রথম তফসিলে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ও সেবা বিবেচনায় বেশ কিছু পণ্যকে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কৃষি, মত্স্য, গবাদি পশু, স্থাবর সম্পত্তি, দাতব্য প্রতিষ্ঠান, সংস্কৃতিসংক্রান্ত পণ্য ও সেবা। তবে এ তালিকায় জ্বালানিসংশ্লিষ্ট পণ্য বা সেবা বিশেষ করে এলপি গ্যাসকে রাখা হয়নি। ১ জুলাই থেকে সর্বজনীন ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আদায় শুরু হলে বাসাবাড়ি ও ক্ষুদ্র ব্যবসায় ব্যবহৃত এলপি গ্যাসের দাম বাড়বে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে বসুন্ধরা এলপি গ্যাস লিমিটেডের অর্থ ও হিসাব বিভাগের প্রধান মাহবুব আলম বলেন, সরকার এলপি গ্যাস ব্যবহারের মাধ্যমে প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর থেকে চাপ কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু ভ্যাট বাড়ানো হলে এ প্রক্রিয়া স্থবির হয়ে যাবে।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ভ্যাট নির্ধারণে বিদ্যমান পদ্ধতিতে ৫ থেকে ১০ কেজি আকারের সিলিন্ডারের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট বাবদ আদায় করা হয় ৫ টাকা ২৫ পয়সা। ভ্যাট ছাড়া এই আকারের প্রতি সিলিন্ডার গ্যাসের বিক্রয়মূল্য ৩৯৭ টাকা ৭৫ পয়সা। ভ্যাটসহ নেওয়া হয় ৪০০ টাকা। একইভাবে বর্তমানে ১১ থেকে ৩০ কেজি আকারের সিলিন্ডারের ৯ টাকা ভ্যাটসহ সরবরাহ মূল্য ৮৯৭ টাকা, ৩১ থেকে ৪৫ কেজির সিলিন্ডারের ১৮ টাকা ৭৫ পয়সা ভ্যাটসহ সরবরাহ মূল্য দাঁড়ায় দুই হাজার ১৩০ টাকা।
অন্যদিকে নতুন পদ্ধতিতে বিক্রয়মূল্যের ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপের ফলে ৫ থেকে ১০ কেজি আকারের সিলিন্ডারের দাম পড়বে ৪৫৪ টাকা, যা বর্তমানের তুলনায় ৫৪ টাকা বেশি। একইভাবে ১১ থেকে ৩০ কেজি আকারের সিলিন্ডারের সরবরাহ মূল্য এক হাজার ২১ টাকা ২০ পয়সায় দাঁড়াবে, যা বর্তমানের তুলনায় ১২৪ টাকা বেশি। ৩১ থেকে ৪৫ কেজি আকারের সিলিন্ডারের দাম পড়বে দুই হাজার ৪২৭ টাকা ৯৪ পয়সা, যা আগের তুলনায় ৩০০ টাকা বেশি।
প্রাকৃতিক গ্যাসের পর্যাপ্ত সরবরাহ না থাকায় দেশের জেলা শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত গৃহস্থালি ও হোটেল-রেস্তোরাঁয় রান্নার কাজে এলপি গ্যাস ব্যবহার করা হয়। গত কয়েক বছরে রাজধানীসহ বড় শহরগুলোতেও রান্নার কাজে এলপিজির ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়েছে।
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের হিসাব অনুযায়ী দেশে বর্তমানে এলপি গ্যাসের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ১০ লাখ টন। এর বিপরীতে ব্যবহৃত হচ্ছে পাঁচ লাখ টন। এলপির সরবরাহ বাড়াতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগে এলপিজি বোতলীকরণ প্লান্ট স্থাপন প্রক্রিয়া সহজ করা হয়েছে। এ খাতে বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে সরকার বিভিন্ন উপকরণ আমদানিতে কর অব্যাহতি ও রেয়াতি হারে শুল্ক সুবিধা দিয়েছে। ফলে বিপিসির পাশাপাশি দেশি-বিদেশি ১০টির মতো প্রতিষ্ঠান এলপিজি প্লান্ট স্থাপন করে উৎপাদন শুরু করেছে। কিন্তু বর্তমানে এসব প্রতিষ্ঠান তাদের উৎপাদন ক্ষমতার মাত্র ৪০ শতাংশ কাজে লাগাতে পারছে।
ব্যাপক চাহিদা থাকলেও গ্যাস ও সিলিন্ডারের অতিরিক্ত মূল্যের কারণে সাধারণ মানুষের পক্ষে এলপি গ্যাস ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে বাধ্য হয়েই তারা রান্নার কাজে কেরোসিন ও কাঠ ব্যবহার করছে। এতে একদিকে জ্বালানি খাতে সরকারকে অতিরিক্ত ভর্তুকি দিতে হচ্ছে, অন্যদিকে বাড়ছে পরিবেশ দূষণ। এ অবস্থায় ভ্যাটের নতুন নিয়ম কার্যকর হলে এলপি গ্যাসের ব্যবহার নিরুৎসাহিত হবে।
জ্বালানি খাত সংশ্লিষ্টরা জানায়, দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ কমে যাওয়ায় আবাসিক খাতে নতুন সংযোগ দেওয়া বন্ধ রাখা হয়েছে। শিল্প খাতেও গ্যাসের সংযোগ সীমিত করা হয়েছে। পরিবহন খাতেও সিএনজির (রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস) ব্যবহার নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। এ অবস্থায় বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে এলপি গ্যাস। ২০১৯ সালের মধ্যে গৃহস্থালির কাজে চাহিদার ৭০ শতাংশ এলপি গ্যাস দিয়ে মেটানোর পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। কিন্তু দাম সহনীয় রাখতে না পারলে সাধারণ মানুষের কাছে এ গ্যাসের ব্যবহার জনপ্রিয় হবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
জানা গেছে, শুধু রান্নার কাজেই নয়, বর্তমানে গাড়ি চালানো, ক্ষুদ্রশিল্পের জ্বালানি এবং রাসায়নিক ও প্রসেসিং কারখানার কাঁচামাল হিসেবেও এলপি ব্যবহৃত হচ্ছে। এমনকি অনেক বড় ও মাঝারি শিল্প-কারখানাও এ গ্যাসে চলছে। কিন্তু পাইপলাইনের গ্যাসের চেয়ে দাম বেশি হওয়ায় আবাসিক ও বাণিজ্যিক খাতে এলপির ব্যবহার প্রত্যাশা মতো বাড়ছে না।
এ বিষয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ‘সরকার আবাসিক খাতে পাইপলাইনের গ্যাস সরবরাহ থেকে সরে আসছে। রান্নার কাজে গ্যাসের ব্যবহার পুরোপুরি এলপিজিনির্ভর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ কারণে এলপি গ্যাস সহজলভ্য করার চেষ্টা চলছে। ’
বর্তমানে প্রায় ২০ লাখ পরিবার রান্নার কাজে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহার করেন, যা দেশের মোট পরিবারের মাত্র ৭ শতাংশ। বাকি ৯৩ শতাংশ পরিবার এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে এলপি গ্যাসের আওতায় আনতে সরকারের নীতি ও কর ব্যবস্থা সহনীয় করা উচিত। ভারতে দীর্ঘদিন ধরেই এলপিজিতে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। পাকিস্তান ও নেপালে গৃহস্থালির কাজে ব্যবহারের জন্য এলপি গ্যাসে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। বিকল্প জ্বালানি হিসেবে অগ্রাধিকার খাত বিবেচনায় বাংলাদেশেও এ খাতে ভর্তুকিসহ বিভিন্ন প্রণোদনা দেওয়া উচিত। তা না করে উল্টো ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ জ্বালানি খাতে সরকারের সামগ্রিক উদ্যোগের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কারণ বাজেটে অত্যাবশ্যকীয় অনেক পণ্য ও সেবা খাতে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হলেও এলপি গ্যাস ব্যবহারকারীরা এ সুবিধা পাচ্ছে না। নতুন ভ্যাটের কারণে দাম বাড়লে সামগ্রিকভাবে এ খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
এ বিষয়ে অর্থনীতির বিশ্লেষক আকতার হোসেন সান্নামাত বলেন, দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ একেবারেই অপ্রতুল। বিদ্যুৎ ও সার উৎপাদনের জন্য এই গ্যাস প্রয়োজন। সরকার বাসাবাড়ি, হোটেল-রেস্তোরাঁ, ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন খাতে পাইপলাইনে গ্যাসের নতুন সংযোগ আর দিচ্ছে না। এসব কাজে এলপি গ্যাসের ব্যবহার উৎসাহিত করা হচ্ছে। পাশাপাশি শিল্প খাতেও এ গ্যাস কাজে লাগানোর চেষ্টা চলছে। কিন্তু বাড়তি ভ্যাটের কারণে দাম বাড়লে এলপির ব্যবহার নিরুৎসাহিত হয়ে পড়বে। এতে প্রাকৃতিক গ্যাসের বিকল্প হিসেবে এলপির ব্যবহার বাড়াতে সরকারের চেষ্টা ব্যাহত হবে। এলপি নিয়ে সরকারের উদ্যোগ সফল করতে এ খাতে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া প্রয়োজন। কারণ পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহের মাধ্যমে যে ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে, এলপিজির ব্যবহার বাড়লে সরকারের সে খরচ সাশ্রয় হবে। ভোক্তা ও প্রান্তিক মানুষের পাশাপাশি দেশের বৃহত্তর স্বার্থ বিবেচনায় সরকার বাজেট পাসের সময় ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2017/06/09/506746