৯ জুন ২০১৭, শুক্রবার, ১১:০৭

ব্যাংক লুটপাট ও অর্থপাচারের বিষয় যখন সংসদে

|| মোহাম্মদ আলী আজম খান ||

২০১০ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি টিম সোনালী ব্যাংক থেকে হলমার্ক গ্রুপ অবৈধভাবে প্রায় চার হাজার কোটি টাকার ঋণ নেয়ার জালিয়াতি শনাক্ত করে। এরপর একে একে বিসমিল্লাহ গ্রুপ, ডেসটিনি গ্রুপের ঋণজালিয়াতি এবং বেসিক ব্যাংকসহ দেশের অনেক রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংকে ঋণ জালিয়াতি ও জনগণের অর্থ লোপাটের লোমহর্ষক খবর দেশের গণমাধ্যমে প্রকাশিত হতে থাকে। এ নিয়ে দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষত বড় দল বিএনপিকে তেমন প্রতিবাদমুখর হতে কখনো দেখা যায়নি। কোনো রাজনৈতিক দলকে এই অর্থ কেলেঙ্কারির কোনো একটা ইস্যু নিয়ে দেশের কোথায়ও বিক্ষোভ-সমাবেশ করতে দেখা যায়নি।
চলতি বছর মে মাসের শেষের দিকে জাতীয় পার্টি প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ ব্যাংক খাতের সীমাহীন দুর্নীতি ও নৈরাজ্যের বিষয় অত্যন্ত ক্ষোভ ও আবেগ নিয়ে প্রথমবার সংসদে ব্যক্ত করলেন। তার বক্তব্যে তিনি উল্লেখ করেছেন, দেশে কোথাও সুশাসন নেই; সুশাসন থাকলে সর্বক্ষেত্রে এই অরাজকতা চলতো না। তিনি আরো বলেছেন, ব্যাংকে লুটপাট সরকারের পাশের লোক না হলে কেউ করতে পারে না। এতদিন পর ফিরোজ রশীদ কেন সংসদে এই ব্যাপারে সরব হলেন, তা যেমন প্রশংসিত হওয়ার দাবি রাখে, তেমনি কৌতূহলজনক এই অর্থে যে সংসদে নামমাত্র বিরোধীদলীয় একজন সদস্যের খোলস ছেড়ে তিনি হঠাৎ কেন সত্যিকার বিরোধীদলীয় একজন সদস্যের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। যা হোক, এখন দেখা যাক সংসদে এ নিয়ে কি আলোচনা হয় এবং আলোচনা হলে তার ফলাফল কী দাঁড়ায়।
রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে ঋণ জালিয়াতি এবং অর্থ লোপাটসংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত দেশের পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন-নিবন্ধে প্রায়ই উল্লেখ করা হয়। অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের অজানা থাকার কথা নয় যে, খেলাপি ঋণের পরিমাণ বর্তমানে ৭৩ হাজার কোটি টাকা? নাকি এর কম বা বেশি? গত ১০ বছরে বিদেশে পাচার করা ৬ লাখ কোটি টাকার মধ্যে কত টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে এবং কত টাকা অনুমোদন ছাড়া পাচার হয়েছে; ক’টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে মূলধন বলতে কিছুই অবশিষ্ট নেই এবং ক’টি ব্যাংকে কত টাকার ঘাটতি রয়েছে? এ ছাড়া খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন ঘাটতি রাখতে ব্যর্থ হয়েছে কোন্ কোন্ ব্যাংক, সেই হিসাবও সরকারের জানার কথা। প্রসঙ্গত, দুই দুই বার শেয়ারবাজার ধ্বংসযজ্ঞের সাথে যারা জড়িত, তারা কি দেশের বাইরে, নাকি দেশেই বহাল তবিয়তে অবস্থান করছে, সেই খবরও সরকারের অজানা থাকার কথা নয়।
বলা বাহুল্য, এই অর্থ লোপাট ও অর্থ পাচারের কোনো ঘটনার বিরুদ্ধে আইনানুগ কোনো ব্যবস্থা আজো নেয়া হয়নি, যা রীতিমতো বিস্ময়ের ব্যাপার। তবে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর ১৬ হাজার ৯৮ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতি পূরণের জন্য বিশেষ কিছু ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বা হচ্ছে বলে জানা যায়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে রয়েছে সরাসরি নগদ মূলধন সরবরাহ, শেয়ার ইস্যু, বোনাস শেয়ার ইস্যু এবং বন্ড ইস্যু। দেশের ইসলামি ব্যাংকগুলোর উদ্বৃত্ত অর্থ দিয়েও সমস্যাসঙ্কুল রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে অর্থায়ন করা হয় বলে জানা যায়। এই ধরনের ‘লাইফ সাপোর্ট’ দিয়ে বারবার সরকারি ব্যাংকগুলোর প্রাণসঞ্চার করা কি আদৌ অর্থবহ? যেই দুষ্টক্ষতের যন্ত্রণায় ব্যাংকিং খাতের মুমূর্ষুদশা, তা নিরাময়ের ব্যবস্থা কেন নেয়া হচ্ছে না, সেটাই প্রশ্ন।
ঋণগ্রহীতা ও ঋণদাতা ব্যাংকার সবাই আজ বেপরোয়া। ঋণের জন্য আবেদনকারীরা ভালো করেই জানে তদবির করে, ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে, জামানতের ঘাটতি থাকলে, এমনকি জামানত ছাড়াই ঋণ মঞ্জুর করানো যায় এবং এরপর সেই ঋণ খেলাপ করে পারও পাওয়া যায়। আর দুর্নীতিবাজ ব্যাংক কর্মকর্তারা জানে, নিয়ম-বিধিকে পাশ কাটিয়ে বা লঙ্ঘন করে, এমনকি পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন ছাড়াই কাউকে ঋণ পাইয়ে দিলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি কোনো ব্যবস্থা নেয়া হবে না। সর্বোপরি রয়েছে, কোনো খেলাপি ঋণকে আদায়ের অযোগ্য বা কুঋণ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা, ঋণ পরিশোধের সুবিধার্থে পুনঃতফসিল করা, সুদ মওকুফ, এমনকি পুরো ঋণের পরিমাণ অবলোপন ইত্যাদি অদ্ভুত ধরনের নিয়মগুলো। অতএব, ঋণখেলাপি ও অসাধু ব্যাংক কর্মকর্তাদের আর পায় কে! দেশটাই তাদের জন্য একটা স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে।
এখন ব্যাংক পরিচালকদের হবে পোয়াবারো। সম্প্রতি সরকার ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ সংশোধনের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এই সংশোধনী মন্ত্রিসভায় অনুমোদিত হয়েছে। যথারীতি এটি সংসদে পাস হয়ে আইনে পরিণত হলে, একজন পরিচালক ছয় বছরের জায়গায় একনাগাড়ে ৯ বছর পরিচালক পদে থাকতে পারবেন। এ ছাড়া বোর্ডে পরিবার পিছু দুইজনের স্থলে চারজন পরিচালক থাকতে পারবেন। বোঝাই যায়, এই সংশোধনীর সুবাদে একটি ব্যাংকের এক বা একাধিক পরিচালকের পরিবারের কর্তৃত্ব এবং সুযোগ-সুবিধা লাভের ক্ষেত্র বিস্তৃত ও অনেকাংশে পাকাপোক্ত হবে। সার্বিক পরিস্থিতি এই বার্তা বহন করে যে, জনগণের কষ্টার্জিত টাকা ঋণ দেয়ার নামে কতক অসাধু ব্যাংক কর্মকর্তার যথেচ্ছা প্রক্রিয়ায় ও তাদের সহায়তায় বেশ কিছু ব্যক্তিবিশেষের মালিকানায় চলে যাওয়া, বিদেশে লাগামহীন অর্থপাচার এবং সম্প্রতি পরিচালকদের ক্ষমতার পরিধি বাড়ার কারণে ব্যাংক খাতে একটা টালমাটাল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য ব্যবস্থা নেয়া দূরে থাক, সরকার যে এই অবস্থাকে মোটেও গুরুত্ব দিচ্ছে না, তার প্রতিফলন ঘটে অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবিত বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে। সেখানে তিনি বলেছেন, ব্যাংকে চুরিচামারি হয়, জালিয়াতি হয়, অন্য দেশেও হয়। অন্যান্য দেশে এরূপ ভয়াবহ কাণ্ড হয় কি না তা যাচাই না করেই তিনি স্বীয় দেশের জালিয়াতি জায়েজ করে দিলেন।
আসলে এই পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে কি সরকারের অন্য কোনো উদ্দেশ্য কাজ করছে? এটা কি হতে পারে, সরকারি মদদে সম্ভাব্য যেকোনো উপায়ে সরকারের অনুরাগভাজন ও দৃঢ় সমর্থক এমন একটা বিত্তশালী ও ধনবান এলিট শ্রেণীর বিকাশ হচ্ছে, যারা দেশে ব্যবসা-বাণিজ্যে আধিপত্য বিস্তার এবং প্রকারান্তরে তা নিয়ন্ত্রণ করবে! এরা বিদেশেও ব্যবসা বিনিয়োগ করে এবং ফ্যাট-বাড়ি কিনে সেখানেও তাদের শক্ত সামাজিক অবস্থান গড়ে তুলবে। এরা প্রয়োজনে সরকারের বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে বিদেশে সরকারি ও বেসরকারি মহলে সরকারের পক্ষে লবি করতে সক্ষম হবে। এরা দেশে তাদের পছন্দের দল অর্থাৎ আওয়ামী লীগকে বারবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসানোর জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগসহ পর্যাপ্ত অর্থকড়ি জোগান দেয়ার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হবে।
উপরোল্লিখিত ধারণা যেন সত্যি না হয়, এটাই কাম্য। তবে বাস্তব সত্য এই যে, জনগণের অর্থে পরিচালিত ব্যাংকগুলোতে এখন জনগণের স্বার্থ রক্ষা করা হয় না। উল্লেখ্য, মেয়াদি আমানতের সুদ বা লভ্যাংশ কমতে কমতে এখন গড়ে ৫ শতাশে দাঁড়িয়েছে। তাই মধ্যবিত্ত, নি¤œ মধ্যবিত্ত ও সীমিত আয়ের মানুষ যারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মেয়াদি আমানতের ওপর নির্ভরশীল, তারা সংসারের খরচ চালাতে এখন হিমশিম খাচ্ছে। অনেকে বাধ্য হয়ে মেয়াদপূর্তির আগেই মেয়াদি আমানত বা ফিক্সড ডিপোজিট ভেঙে ফেলছে। এইভাবে আমানতের প্রবাহ কমে গেলে ব্যাংকে নগদ টাকার সঙ্কট দেখা দেবে, যার প্রভাবে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের বিপর্যয় রোধ করা যাবে না। এই নাজুক পরিস্থিতিতেই চলতি বছরের বাজেট প্রস্তাবনায় এক লাখ টাকা ও তদূর্ধ্ব পরিমাণ অর্থ ব্যাংকে জমা ও উত্তোলনের ক্ষেত্রে আবগারি শুল্ক আগের চেয়ে বেশ বাড়ানো হয়েছে। তবে এ নিয়ে দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় বইছে। এই শুল্ক আরোপের বিষয় সংসদে পাস হোক বা না হোক, এতে রাজস্ব খাতে সরকারের দীনতাই প্রকাশ পেয়েছে।
নির্বিচারে ব্যাংকের অর্থ লোপাট এবং বিদেশে ঢালাও অর্থ পাচারের পরিণতিতে দেশের অর্থনীতির আজ যেই দৈন্যদশা, তা সামাল দেয়ার নিমিত্তে অর্থমন্ত্রী জনগণ থেকে সম্ভাব্য যেকোনো উপায়ে রজাস্ব আদায়ের সংস্থান রেখে এবং বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান লাভের স্বপ্নজাল বুনে এক উচ্চমাত্রার বিলাসী বাজেট প্রণয়নে নেতৃত্ব দিয়েছেন। কথায় বলে, অন্ধ হলেই প্রলয় বন্ধ হয় না। আর বধির হলেই বজ্রনাদ থেমে থাকে না। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই, ব্যাংক খাত এখন খাদের কিনারে, নয়তো খাদের কিনারার অতি নিকটে।
লেখক : সাবেক সরকারি কর্মকর্তা ও সাবেক অধ্যক্ষ, মেরিন ফিশারিজ অ্যাকাডেমি, চট্টগ্রাম
maakbd@gmail.com

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/226932