৮ জুন ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১১:২১

গার্মেন্ট খাতে অশনিসংকেত

ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)-এর সাম্প্রতিক দুই বার্তা দেশের পোশাক খাতের জন্য অশনিসংকেত হিসেবে দেখা দিয়েছে। এ খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নানা প্রতিযোগিতা উতরে টিকে থাকা দেশের পোশাক খাত নতুন করে সংকটে পড়তে পারে। সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশ থেকে পণ্য পরিবহনে বাড়তি স্ক্যানিংয়ের শর্ত দিয়েছে। এ ছাড়া শ্রমিক অধিকার সুরক্ষা হয়নি এমন অজুহাতে জিএসপি সুবিধা স্থগিত হতে পারে বার্তা দিয়ে চিঠি দেয়া হয়েছে ইইউ’র পক্ষ থেকে।

ইইউ’র নতুন শর্ত অনুযায়ী আকাশ ও নৌ পথে পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে তৃতীয় কোনো দেশে স্ক্যানিং (নিরাপত্তা তল্লাশি) করতে হবে। সরাসরি ইউরোপে কার্গো পরিবহন করা যাবে না। দ্বিতীয় বার স্ক্যানিং করার কারণে সময় ও অর্থের অপচয় হবে। কারণ বাংলাদেশে শ্রমিকের খরচের চেয়ে তৃতীয় কোনো দেশের এ খরচ অনেক বেশি। এ কারণে পোশাক শিল্পের ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করছেন শিল্প মালিকরা। এ ছাড়া পদে পদে ভোগান্তি পোহাতে হতে পারে রপ্তানিকারকদের। পোশাক খাতের ঝুঁকির বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিএমইএ’র সহসভাপতি মোহাম্মদ নাছির মানবজমিনকে বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) কার্গো পরিবহনে বিধিনিষেধে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের ভাবমূর্তি ক্ষণ্ন্ন হবে। বিশ্বের কাছে নেতিবাচক বার্তা যাবে। এমনিতেই আমাদের কার্গোগুলো তৃতীয় কোনো দেশে স্ক্যানিং হয়ে ইউরোপের বাজারে প্রবেশ করে। কিন্তু আবার যদি দ্বিতীয় বার স্ক্যানিং করতে হয় তবে সময় ও অর্থের অপচয় হবে। এত দিনেও আমাদের বিমানবন্দরে কেন স্ক্যানিং মেশিন কেনা হলো না। এখানে কার গাফলতি এ বিষয়টি খতিয়ে দেখা উচিত। বিজেএমইএ নেতা নাছির বলেন, নিষেধাজ্ঞার কারণে পোশাক খাতের ওপর ঝুঁকিটা পড়বে। কারণ বাংলাদেশের রপ্তানি খাত মূলত পোশাক নির্ভর। বেশির ভাগ পণ্য রপ্তানি হয় সমুদ্র পথে। আকাশপথে রপ্তানি হয় শুধু পোশাকের নমুনা। কারণ বিমানে পাঠানো ব্যয়বহুল। তবে জরুরি ভিত্তিতে সামান্য কিছু পরিমাণ পোশাক রপ্তানি হয়। এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলোতে বিমান ও নৌ পথে সরাসরি কার্গো যে কোনো মূল্যে ঢোকাতে চায় সরকার। এজন্য ইইউ’র শর্ত মেনে কাজ করতে সিভিল এভিয়েশন অথরিটিকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। একই সঙ্গে এক্সপ্লোসিভ ডিটেনশন সিস্টেম (ইডিএস) দ্রুত আমদানি করতে সিভিল এভিয়েশনকে বলা হয়েছে। সিভিল এভিয়েশন সূত্রে জানা গেছে, গতকাল মুখ্য সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী সিভিল এভিয়েশনের কর্মকর্তাদের তার কার্যালয়ে ডেকে পাঠান। এ সময় বাংলাদেশকে ‘হাইরিস্ক’ কান্ট্রি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার কারণ সম্পর্কে সিভিল এভিয়েশন কর্মকর্তাদের কাছে জানতে চান। বিভিন্ন বিষয়ে জেনে মুখ্য সচিব ইডিএস মেশিন দ্রুত আমদানির জন্য যুক্তরাষ্ট্রে একটি প্রতিনিধি দল যাওয়ার কথা বলেন। একই সঙ্গে হাইরিস্কের কারণে নানা ঝুঁকি নিয়ে আলোচনা হয়। বিজেএমইএ সূত্রে জানা গেছে, সাম্প্রতিকালে পোশাক খাতে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা মাসভিত্তিক টার্গেট পূরণ হচ্ছে না। ফলে সার্বিক রপ্তানি খাত এখনও পিছিয়ে পড়েছে। জুন মাসে প্রকাশিত রপ্তানি আয়ের হালনাগাদ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরের জুলাই-মে মেয়াদে তৈরি পোশাক খাত থেকে রপ্তানিতে আয় হয়েছে ২ হাজার ৫৬২ কোটি ৪৭ লাখ ৭০ হাজার ডলার। এই খাতের রপ্তানি আয় আগের অর্থবছরের তুলনায় ২.১৬ শতাংশ বেশি। এর মধ্যে নিটওয়্যার খাতের পণ্য রপ্তানিতে ১ হাজার ২৫০ কোটি ৪৯ লাখ ৪০ হাজার ডলার এবং ওভেন গার্মেন্ট পণ্য রপ্তানিতে ১ হাজার ৩১১ কোটি ৯৮ লাখ ৩০ হাজার ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এদিকে চলতি অর্থবছর ৩ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। সেই হিসাবে চলতি জুন মাসে ৫২১ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করতে হবে। গত ১১ মাসের মধ্যে জানুয়ারিতে সর্বোচ্চ ৩৩১ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। সর্বশেষ গত মে মাসে রপ্তানি হয়েছে ৩০৬ কোটি ডলারের পণ্য। সেই হিসেবে এবার রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। এদিকে গতকাল শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে র্যাব, বিজিবি ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ডগ স্কোয়াড মহড়া দিয়েছে। মহড়ায় ২৫টি কুকুর অংশ নেয়। তারা ৩৫ কার্গোর পণ্য পর্যবেক্ষণ করে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নামি প্রতিষ্ঠান লুফহানসা বাংলাদেশ থেকে সরাসরি কার্গো পরিবহন করে থাকে। আগামী ১৩ই জুন তাদের একটি প্রতিনিধি দল কার্গোর নিরাপত্তা দেখতে বাংলাদেশে আসবে। সরাসরি কার্গো পরিবহনে নিরাপত্তায় কোনো ক্রটি আছে ওই বিষয়টি খতিয়ে দেখবে তারা। এরপরই লুফহানসা সরাসরি কার্গো পরিবহনের সিদ্ধান্ত নেবে। এর আগে গত সোমবার ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত পিয়েরে মায়াদুনের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল সিভিল এভিয়েশন অথরিটির চেয়ারম্যান এহসানুল গনি চৌধুরীসহ এভিয়েশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে। সেখানে ইইউ’র বিধি-নিষেধের বিষয়ে চেয়ারম্যানকে অবহিত করা হয়। এরপর থেকে বিষয়টি নিয়ে সরকারি পর্যায়ে নানা আলাপ আলোচনা চলছে। সিভিল এভিয়েশন সূত্রে জানা গেছে, সিভিল এভিয়েশনকে উচ্চ মাত্রার স্ক্যানিং মেশিন, এক্সপ্লোসিভ ডিটেনশন সিস্টেম (ইডিএস) স্থাপন ও ডগ স্কোয়াডের জন্য ৯০ কোটি টাকার বাজেট বরাদ্দ দিয়েছিল সরকার। কার্গো কমপ্লেক্সে উচ্চপর্যায়ের স্ক্যানিং মেশিন বসানোর জন্য বারবার তাগিদ দেয়া হয়। কিন্তু প্রথম দফায় প্রাক্কলিত ব্যয় ১৬ কোটি টাকা বেড়ে যাওয়ায় ওই টেন্ডার বাতিল করা হয়। প্রথম দফায় প্রাক্কলিত ব্যয় দাঁড়ায় ১০৬ কোটি টাকা। পরে দ্বিতীয় দফায় টেন্ডার করতে গিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের শর্ত অনুযায়ী যথাসময়ে এক্সপ্লোসিভ ডিটেনশন সিস্টেম (ইডিএস) কেনা সম্ভব হয়নি। এসব নানা কারণে ইইউর উচ্চপর্যায়ের টিম সরাসরি কার্গো রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। নিষেধাজ্ঞার ফলে বছরে ৩০ হাজার চার শ’ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি হুমকির মুখে পড়েছে। একই সঙ্গে দেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন হবে।
প্রত্যাহার হতে পারে জিএসপি সুবিধা: জিএসপি ইস্যুতে বাংলাদেশকে সতর্ক করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। সরকারকে লেখা এক চিঠিতে তারা বলেছে, শ্রমিক অধিকারে লক্ষণীয় অগ্রগতি দেখাতে হবে। জিএসপি সুবিধা ধরে রাখতে তা করতে হবে। অন্যথায় অস্থায়ীভাবে এ সুবিধা স্থগিত করা হবে। চিঠিতে বলা হয়েছে, এর পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট আইন সংশোধন করতে হবে। গত ৩১শে মে বাংলাদেশ সরকারকে লেখা এক চিঠিতে এসব কথা বলেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। গত ১৮ই মে ঢাকায় এ বিষয়ে তৃতীয় পর্যালোচনা বৈঠকের দু’সপ্তাহেরও কম সময়ে এই চিঠি এসেছে। এই চিঠি একই সঙ্গে পাঠানো হয়েছে পররাষ্ট্র, বাণিজ্য ও শ্রম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবদের কাছে। এর আগে ১৬ই মার্চ তারা আরো একটি চিঠি লিখেছিল বাংলাদেশকে। তার জবাব দেয়নি বাংলাদেশ। এজন্য এই চিঠিতে অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে। এ চিঠিটি স্বাক্ষর করেছেন ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ট্রেড অব দ্য ইউরোপিয়ান কমিশনের পরিচালক সান্দ্রা গ্যালিনা, ডিরেক্টরেট জেনারেল ফর এমপ্লয়মেন্ট, সোশাল অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড ইনক্লুসন অব ইউরোপিয়ান কমিশনের লেবার মবিলিটি বিষয়ক পরিচালক জারদি কুরেল, ইউরোপিয়ান এক্সটারনাল অ্যাকশন সার্ভিসের হিউম্যান রাইটস, গ্লোবাল অ্যান্ড মাল্টিলেটারেল ইস্যুজ-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক লোটে ক্লুডসেন। এতে বলা হয়েছে, ২৮ জাতির ইউরোপীয় ইউনিয়নে বাংলাদেশকে শুল্ক মুক্ত রপ্তানি সুবিধা দেয়া হয় জিএসপির অধীনে। চিঠিতে বলা হয়েছে, আগের লেখা চিঠি অনুযায়ী আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠন আইএলও’র সুপারিশকৃত শ্রম অধিকারের বিষয়ে মিটিংয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে অ্যাকশন প্লান উপস্থাপন করে নি ঢাকা। ইউরোপীয় ইউনিয়নের জিএসপি রেজুলেশনের অধীনে বাংলাদেশকে যে সুবিধা দেয়া হয়েছে তার প্রেক্ষিতে আমরা বলবো, জরুরি ভিত্তিতে বাংলাদেশকে মানবাধিকার ও শ্রম অধিকারের প্রতি সম্মান দেখাতে দৃঢ় ও টেকসই পদক্ষেপ প্রদর্শন করতে হবে। যদি তা করা না হয় তাহলে জিএসপি রেজুলেশনের অধীনে পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ মিশনের সহযোগিতা নেয়া হবে। এমন নজরদারির প্রেক্ষিতে আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু হতে পারে। এ তদন্তে অস্থায়ীভিত্তিতে বাংলাদেশকে দেয়া সুবিধা প্রত্যাহার করা হতে পারে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ইউরোপীয় ইউনিয়নে ১৮৬৮ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে ১৭১৫ কোটি ডলার এসেছে তৈরি পোশাক রপ্তানি থেকে। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে যত পোশাক বিদেশে রপ্তানি হয় তার শতকরা ৬০ ভাগের বেশি যায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=68972&cat=2/