৮ জুন ২০১৭, বৃহস্পতিবার, ১১:১১

ঈশানের মেঘ ও রাখালের গল্প

|| জয়নুল আবেদীন ||


‘ঈশানের পুঞ্জমেঘ অন্ধবেগে ধেয়ে চলে আসে।’ কয়েক যুগ আগেও পূর্বপ্রস্তুতির জন্য ঈশানের পুঞ্জমেঘই ছিল একমাত্র ভরসা। ঈশানকোণে কালো মেঘ জমতে শুরু করলে কলিজায় পানি থাকে না। ঈশানের কালো মেঘ থেকে নিষ্কৃতি নেই বলে প্রলয়ের দেবতার নামও ‘ঈশান’। শৈশবে দেখতাম, ঈশানকোণে মেঘ জমতে শুরু করলে সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়ত। আতঙ্কিত মানুষ দড়ি নিয়ে ঘরের কোণে টানা দিত, গবাদিপশু ঘরে তুলে যানবাহন নিরাপদ আশ্রয়ে রাখার জন্য ছোটাছুটি করত।
বাংলাদেশের ব্যতিক্রমী ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বারবার ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ছে। বঙ্গোপসাগরের উত্তর দিক ডিমের আকৃতির। ফলে যখনই ঘূর্ণিঝড় বাস্তবে রূপ নেয় তখনই জলোচ্ছ্বাসসহ ভূমিধস শুরু হয়। নিজের দেখা ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়ের অন্যতম ১৯৭০ সাল। তখন প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে আক্রান্ত হয়েছিল বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) সমগ্র উপকূলীয় অঞ্চল। ৩০ ফুট জলোচ্ছ্বাসসহ বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল প্রতি ঘণ্টায় ২২২ কিলোমিটার। বিপুল সহায়-সম্পদ ধ্বংস এবং গবাদিপশুর প্রাণহানি ছাড়াও শুধু মানুষ প্রাণ হারিয়েছে পাঁচ লক্ষাধিক।
ঝড়ের পূর্বাভাস জানার জন্য বাংলাদেশের নিজস্ব কোনো উপগ্রহ নেই। নাসা ও নোয়া এ দুই উপগ্রহ থেকে প্রাপ্ত উপাত্তের ভিত্তিতে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রিত আবহাওয়া অধিদফতর ঝড়ের পূর্বাভাস দিয়ে থাকে। ১৯৯১ সালে প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড়ের অভিজ্ঞতা থেকে ঝড় প্রতিরোধ ও প্রস্তুতির জন্য একটি বিস্তারিত কর্মসূচির রূপরেখা সরকারের পক্ষ থেকে নেয়া হয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির যৌথ পরিকল্পনা ও পরিচালনায় প্রশিক্ষিত ৩২ হাজার স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে সাইকোন প্রিপেয়ার্ডনেস প্রোগ্রাম (সিপিপি) গঠন করা হয়।
খেয়ালি প্রকৃতির হেঁয়ালি আচরণে শীত-বর্ষা হারিয়ে গেছে কবেই। এখন বিনামেঘে অশনিপাত, এই বন্যা ও এই খরার দুর্বিষহ তাপদাহে যখন প্রাণ ওষ্ঠাগত, ঠিক তখনই ‘মোরা’ নামের ঘূর্ণিঝড় ধেয়ে আসার সংবাদ প্রচার শুরু। ২৯ মে থেকে টেলিভিশনের সব চ্যানেলে বিশেষ সংবাদ বুলেটিনসহ ব্রেকিং নিউজ এবং জাতীয় পত্রপত্রিকায় ‘চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ও কক্সবাজার উপকূলে ১০ নম্বর মহাবিপদ সঙ্কেত, মংলা ও পায়রাবন্দরে ৮ নম্বর মহাবিপদ সঙ্কেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী ও চাঁদপুর ১০ নম্বর মহাবিপদ সঙ্কেতের আওতায় পড়বে। ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা ৮ নম্বর মহাবিপদ সঙ্কেতের আওতায় পড়বে।’ রয়ে রয়ে এর প্রচার শুরু হয়। সেই সাথে, উপকূলীয় নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর, ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা প্রভৃতি জেলার অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলোতে স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে পাঁচ ফুটের অধিক উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাসের শঙ্কার কথা শোনা গেল। উপকূলবাসীকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যেতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং করে অনুরোধ করা হচ্ছিল। চট্টগ্রাম বন্দরনগর ও জেলার ৪৭৯টি আশ্রয়কেন্দ্রে সাড়ে চার লাখ লোকের নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ১০ নম্বর মহাবিপদ সঙ্কেত ঘোষণার পর লোকজন আস্তে আস্তে আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিতে শুরু করেছিল। ২৮ তারিখ বিকেলেই ঢাকার সদরঘাট থেকে দেশের ৩৭টি রুটে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। রেড ক্রিসেন্ট, ফায়ার সার্ভিসসহ স্বেচ্ছাসেবক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রস্তুত থাকাসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছিল।
আঁধারের মতো ভয়ঙ্করেরও একটি রূপ রয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের সময় ভয়ঙ্করের রূপ দেখেছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। লেখক সমুদ্রপথে রেঙ্গুন যাওয়ার কালে ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলা করতে হয়েছিল। ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলা করতে জাহাজ কর্তৃপক্ষ সাধারণ যাত্রীদের সবাইকে জাহাজের খোলের ভেতর প্রবেশ করতে বাধ্য করলেও প্রাণের মায়া ত্যাগ করে লেখক মুরগির খাঁচায় নিজকে লুকিয়ে রাখেন। রশি দিয়ে মুরগির খাঁচা ও খুঁটির সাথে নিজেকে শক্ত করে বেঁধে নয়নভরে দেখেন ঘূর্ণিঝড়ের রূপ। এর পর বলেছিলেন, ‘ভগবান, এই চোখ দুটো তুমি দিয়েছিলে, আজ তুমিই সার্থক করলে’ (সমুদ্রে সাইকোন)। ঘূর্ণিঝড়ের ভয়ঙ্কর রূপ দেখার জন্য সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারীদের অনেকেই সেদিন অফিসে না গিয়ে টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রেখেছিলেন।
মেঘনা কম্পিউটারের স্বত্বাধিকারী আবুল হোসেন বই বিক্রির কাজে ২৮ মে রাতে চট্টগ্রাম পৌঁছেন। ওঠেন লালদীঘি হোটেলে। চট্টগ্রাম নগরীর আন্দরকিল্লার কাছেই। ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ভয়াবহতা সম্পর্কে তাকে রাতেই সতর্ক করেছিলাম। তখন বলেছিলেন, ‘আমি এখন টিভির সামনে। টিভির দিকে তাকিয়ে যত ভয়ঙ্কর মনে হয়, বাইরের দিকে তাকিয়ে তত ভয়ঙ্কর মনে হয় না। বাইরে মানুষের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক মনে হচ্ছে।’ ৩০ তারিখ সকাল ৯টায় ফোন করে জানান, ‘আমি এখন হোটেলের তৃতীয়তলায় ১৩০ নম্বর রুমে। জানালার পাশেই বসে আছি। বাইরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি, দমকা হাওয়া, বিদ্যুৎহীন গুমোট পরিবেশ। রাস্তায় লোক চলাচল কম। মহাবিপদের কিছুই চোখে পড়ছে না।’
নোয়াখালীর হাতিয়া থেকে কয়েক কিলোমিটার দক্ষিণে ঘূর্ণিঝড়ের তোপের মুখে নিঝুমদ্বীপ। ২০০৯ সালের মে মাসে আইলার ৮-১০ ফুট জলোচ্ছ্বাস সম্পূর্ণ ধুয়ে-মুছে দিয়ে যায় ২৫ হাজার জনসংখ্যার নিঝুমদ্বীপকে। আইলার পরপর অবস্থা এমনই ভয়াবহ ছিল যে, গৃহহীন জীবিত মানুষের কাছে ত্রাণকর্মীরাও পৌঁছতে পারতেন না। হরিণের রাজ্য বলে পরিচিত নিঝুমদ্বীপ দেখতে গিয়েছিলাম গত ডিসেম্বরে। উঠেছিলাম নিঝুম রিসোর্টে। ৩০ মে ভোর ৫টার দিকে ফোন করি এর ম্যানেজার সবুজকে। জানতে চাই ‘মোরা’র ভয়াবহতা সম্পর্কে। আবুল হোসেনের মতো একই উত্তর দেয় সবুজ। আমার এক আত্মীয়, বাড়ি বরিশাল লঞ্চ টার্মিনালের কাছে। ৩০ মে সকালে ফোন করতেই ‘ঘূর্ণিঝড় কোথায়! গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিসহ দমকা হাওয়া ছাড়া কিছুই তো চোখে পড়ছে না।’
১৯৭০ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের স্থায়িত্বকাল ছিল কয়েক দিন। আওতায় বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) উপকূলীয় অঞ্চল। বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল প্রতি ঘণ্টায় ২২২ কিলোমিটার। জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ১০.৬০ মিটার। বিপুল সহায়-সম্পদ ধ্বংস এবং গবাদিপশু ছাড়াও শুধু মানুষ মৃত্যুর সংখ্যা পাঁচ লক্ষাধিক।
২০০৭ সালে আঘাত হেনেছিল সিডর। স্থায়িত্বকাল ১০ ঘণ্টা। ব্যাসার্ধ ৪৮০ কিলোমিটার। বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল প্রতি ঘণ্টায় ২৬০ থেকে ৩০৫ কিলোমিটার। জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ২৫ থেকে ৩০ ফুট। বিপুল সহায়-সম্পদ ধ্বংস এবং গবাদিপশু ছাড়াও প্রাণহানি এক হাজার ১০০ জন। বিপদ সঙ্কেত ১০ নম্বর।
২০০৯ সালে আঘাত হেনেছিল আইলা। স্থায়িত্বকাল ৯ ঘণ্টা। ব্যাসার্ধ ৩০০ কিলোমিটার। বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ১৩০ কিলোমিটার। জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ১০ থেকে ১২ ফুট। বিপুল সহায়-সম্পদ ধ্বংস এবং গবাদিপশু ছাড়াও হতাহতসহ নিখোঁজ আট হাজার। বিপদ সঙ্কেত ৮ নম্বর।
২০১৭ সালের ৩০ মে কুতুবদিয়া ও সেন্টমার্টিনে আঘাত হানে মোরা। স্থায়িত্বকাল ৫ ঘণ্টা। ব্যাসার্ধ ২০০ কিলোমিটার। বাতাসের গতিবেগ ৮৯ থেকে ১১৭ কিলোমিটার। পাঁচ-সাত ফুট জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কার কথা বলা হলেও ভাটার কারণে ভয়াবহ হয়নি। বিপদ সঙ্কেত ১০ নম্বর।
৩১ মে প্রথম আলোর সম্পাদকীয়, “মঙ্গলবার সকালের দিকের ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ যে শক্তি নিয়ে বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত হেনেছিল, সে তুলনায় ক্ষতি কমই হয়েছে। ১০ নম্বর মহাবিপদ সঙ্কেত ঘোষণা ও পরিস্থিতি মোকাবেলায় নেয়া প্রস্তুতি বেশ কার্যকর ছিল। বিশেষ করে স্থানীয় প্রশাসন ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো থেকে লোকজনকে যথাসময়ে আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নেয়ায় মানুষের জীবন রক্ষা পেয়েছে, যদিও সম্পদের ক্ষতি হয়েছে অনেক। এটাও স্বস্তিদায়ক যে, ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত হেনেছে ভাটার সময়।”
আবহাওয়া বার্তাতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সতর্ক সঙ্কেতের কথা বলা হয়ে থাকে। আমাদের জানা দরকার কেন ১১ নম্বর বিপদ সঙ্কেত অধিক চিন্তার কারণ, আর কেন ১ নম্বর কম ভয়ের কারণ। সিগন্যাল ১০ খুব বিপজ্জনক সতর্কবার্তা। এর মানে, খুবই তীব্র ঘূর্ণিঝড় হবে, যা অত্র এলাকা কিংবা নিকটবর্তী বন্দর দিয়ে অতিক্রম করতে পারে। বাতাসের গতিবেগ প্রতি ঘণ্টায় ১২০-২২০ কিলোমিটার, অথবা ব্যাপক আকার ধারণ করলে ২২০ কিলোমিটারও অতিক্রম করতে পারে। সিগন্যাল ১১-এর মানে, All communication have failed with cyclone warning office.
এই নিবন্ধ পাঠ করে অনেকে সংক্ষুব্ধ হয়ে বলতেই পারেন, ‘তবে কি আপনি দুই চোখ সার্থক করার জন্য ১৯৭০-এর ভয়াবহতা দেখতে চেয়েছিলেন? ‘না, কেউ ১৯৭০-এর ভয়াবহতা দেখতে চায় না। আমরা চাই, সঠিক সতর্কবার্তা। ‘দুর্যোগ পূর্বাভাস কখনো কখনো মিথ্যাবাদী রাখালের গল্পের মতো হয়ে যায়। বাঘ আসার মিথ্যা গল্প বলার পর যেবার সত্যি সত্যি বাঘ এলো, সেবার আর গ্রামবাসী রাখালকে বিশ্বাস করল না। ‘মোরা’ অল্পের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়ায় বহু প্রচলিত কথাটি বলেছিলেন বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের দুর্যোগ-ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু পরিবর্তন কর্মসূচির পরিচালক নাইম গওহর ওয়ারা। তার ভাষায়Ñ সিডরের আগে দু’বার দু’টি ঝড়ের সময় ১০ নম্বর মহাবিপদ সঙ্কেত দেয়া হয়েছিল। কিন্তু দু’বারই তেমন কিছু হয়নি। তৃতীয়বার যখন ১০ নম্বর সঙ্কেত দেয়া হলো, আগের দু’বারের মতোই অল্পের ওপর দিয়ে যাবে, এই ধারণা থেকে অনেকেই আর আশ্রয়কেন্দ্রে গেল না। এর ফল কত ভয়াবহ হয়েছিল, তা আমরা জানি।
লেখক : আইনজীবী

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/226560