৭ জুন ২০১৭, বুধবার, ১১:০০

লাখ টাকায় আবগারি শুল্ক হবে আত্মঘাতী

প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যাংকের আমানতের ওপর আবগারি শুল্ক বৃদ্ধিতে বিপাকে পড়েছে আমানতকারীরা। এতে আমানতকারীদের নিঃস্ব হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। কারণ ব্যাংক বিনিয়োগের বিকল্প ক্ষেত্রেগুলো এখনো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। আবারও যুবক এবং ডেসডিনির মত প্রতিষ্ঠানের জন্ম হতে পারে। সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর পদক্ষেপ ও ব্যাংকে লাখ টাকার ওপর আবগারি শুল্ক আরোপ আত্মঘাতী হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
এতে ব্যাংক বহির্ভূত মানুষকে সেবার আওতায় আনার যে প্রক্রিয়া তা বাধাগ্রস্ত হবে। আর ব্যাংকাররা মনে করছেন, এতে মানুষের নিঃস্ব হওয়ার ঝুঁকি বাড়াবে। কারণ ব্যাংক বিনিয়োগের বিকল্প ক্ষেত্রেগুলো এখনো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তাদের পরামর্শ বাজেটের আবগারি শুল্ক বাড়ানো ও সঞ্চপত্রের সুদ হার কমানোর প্রস্তাব পুনর্বিবেচনা করা উচিত।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অগ্রণী ব্যাংক। ব্যাংকটি ২০১৪ সালের জুনে ১ বছর মেয়াদি আমানতের বিপরীতে সুদ দিত ১২ শতাংশ। ২০১৬ সালের জুন শেষে তা কমে দাঁড়ায় সাড়ে ৭ শতাংশ। আর বর্তমানে তা কমে হয়েছে ৫ শতাংশ। অর্থাৎ ২০১৪ সালে একজন আমানতকারী ব্যাংকে ১০ লাখ টাকা রাখলে প্রতিমাসে পেতেন ১২ হাজার টাকা, ২০১৬ সালে তা নেমে আসে সাড়ে ৭ হাজার টাকা । আর বর্তমানে মিলছে ৫ হাজার টাকা। অর্থাৎ ৩ বছরের ব্যবধানে আমানতের সুদ হার কমেছে ৭ শতাংশ।
একইভাবে এ সময়ের মধ্যে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ বেড়েছে দ্বিগুণ হারে। তথ্য মতে ২০১৪ সালে সঞ্চয়পত্র বিক্রি ছিল ৭৫ হাজার ৮৭৫ কোটি টাকা। আর সুদের হার ছিল ১৪ শতাংশ। ২০১৬ সালে সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেড়ে দাড়িয়েছে ১ লাখ ৩৮ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা। বর্তমানে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার ৯ শতাংশ। অর্থাৎ ৩ বছরের ব্যবধানে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে বেড়েছে ৬৩ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকে সুদ হারের চেয়ে সঞ্চয়পত্রের সুদের হার এখনও বেশি ৪ শতাংশ। আর এ কারনেই সঞ্চয়পত্রের দিকে ঝুকছে সাধারন বিনিয়োগকারীরা। কারন এখানে বিনিয়োগে কোন ঝুকি নেই। আর একারণেই সরকার বাধ্য হয়ে এখন সঞ্চয়পত্রের সুদ হার কমাচ্ছে।
বাজেটোত্তর সাংবাদিক সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী আবারও সঞ্চয়পত্র এবং পেনসনের আমানতের ওপর সুদ হার কমানোর ঘোষণায় হতাশ হয়েছেন সংশ্নিষ্টরা। তার বলছেন টাকা আলমিরা আর বালিশের নিচে রেখে দেয়া ছাড়া কোন উপায় নেই। কারণ ঘরে রাখলে লাভ না পেলেও লোকসান তো আর হচ্ছে না। যদি টাকা ব্যাংকে রাখলে লাভই না হয় তাহলে কেন টাকা ব্যাংকে লাখবো। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে সরকার আবারও যুবক-ডেসটিনির মত প্রতিষ্টান গড়ে তুলতে যাচ্ছে। তা না হলে তারা আমানতকারীদের সাথে কেন এরুপ আচরন করবে।
তারপর ব্যাংক চার্জ ও আবগারি শুল্ক তো আছেই। বর্তমানের এক লাখ টাকা কেউ ব্যাংকের রাখলে বছর শেষে তার মূল টাকা থেকে আরও ৫৫ টাকা কেটে রাখা হচ্ছে। অর্থাৎ লাভ তো দুরের কথা প্রতি বছর তাকে লোকসান গুনতে হচ্ছে। আবগারি শুল্ক বৃদ্ধি ফলে বছর শেষে আমানতকারীরা লোকসান দিতে হবে ৩৫৫ টাকা।
এসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) সভাপতি নুরুল আমিন বলেন,সঞ্চয়কারীদের ব্যাংক থেকে দুরে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে। সুদ হার এত নিচে নেমেছে যে টাকা রাখলে মূলধন ঘাটতি হচ্ছে। তার সাথে নতুন করে আমানতের ওপর আবগারি শুল্ক বৃদ্ধি সঞ্চয়কারীদের নিরুসাহিত করবে। সরকার যদি আবার সঞ্চয়পত্রের ওপর সুদ হার কমায় তাহলে বিনিয়োগকারীরা বিকল্প হিসেবে মহাজনি, লগ্নি এবং মাল্টি পারপাসের দিকে বেশি ঝুঁকবে। এতে করে মুলধন হারিয়ে নিঃস্ব হওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে। সঞ্চয়কারীরা নিজেরা মিলেই বিনিয়োগের উদ্যোগ নিবে। এতে করে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
বিশ্নেষকরা মনে করেন, সঞ্চপত্রের রেট কমালে সাধারণ মানুষ বিশেষ করে পেনসনভোগীদের অবস্থা খুবই সঙ্কটাপন্ন হবে। বিকল্প বিনিয়োগখাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়তে পারেন বহু মানুষ। তার ওপর আবগারি শুল্ক আরো বাড়ানোরও প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী। এটিকে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।
এব্যাপারে পলিসি রির্চাস ইনস্টিটিউট (পিআরআই) এর নির্বাহী আহসান এইচ মনসুর বলেন,ব্যাঙকের পলিসি এমন থাকতে হয়ে যাতে মাটির নিচের অর্থও ওপরে বেরিয়ে আসে। কিন্তু সরকার ব্যাংকের আমানতের ওপর যেহারে শুল্কারোপ করছে তাতে কালো টাকার পরিমাণ আরও বাড়বে। এতে করে বিদেশে টাকা পাচারও বাড়বে। মানুষ বাধ্য হয়ে অন উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী হবে। আর এতে করে বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকি আরও বাড়বে। মানুষ সঞ্চয় হারিয়ে পথে বসবে।
সংশ্নিষ্টরা মনে করছেন, সরকার যদি তার নীতির পরিবর্তন না করে তাহলে বিনিয়োগে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাবও পড়বে। যা সরকার কাটিয়ে উঠতে পারবে না। তারা মনে করেন,সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার যে পরিকল্পনা করেছে তা পাওয়া যায কিনা তাও সন্দেহ রয়েছে। একই সাথে বেসরকারী খাতে বিনিয়োগও অনেক কমবে। কারন আমানতকারীরা ব্যাংকে সঞ্চয় না রাখলে ব্যাংকগুলো টাকা পাবে কোথায়। আর তারা বিনিয়োগই বা করবে কি করে। অবস্থায় সরকারকে নতুন করে ভাবতে হবে।
জানা গেছে বর্তমানে ব্যাংকে অলস টাকার পড়ে রয়েছে। দেশে কোন বিনিয়োগ নেই। আর এ কারণেই আমানতের সুদ হার কমানো হয়েছে। তার ওপর আবার বাজেটে আবগারি শুল্ক বাড়ানো হলো। এতে করে ব্যাংকের আমানত প্রত্যাহার করে বিকল্প খাতে বিনিয়োগ করতে পারে বিনিয়োগকারীরা। এতে করে ব্যাংকিং খাতে আবারও তারল্য সংকট দেখা দিতে পারে। ব্যাংকে আর অলস টাকা থাকবে না।
প্রস্তাবিত বাজেটে বেসরকারী বিনিয়োগের পরিমান ধরা হয়েছে জিডিপির ২৩ ভাগ। আর মোট বিনিয়েগের টার্গেট রাখা হয়েছে জিডিপির ৩০ ভাগ। সরকারের বাজেট বাস্তবায়নের লক্ষ্যমাত্রা আর কর্মসংস্থান বাড়াতে হলে বেসরকারী বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। আর এ জন্য ব্যাংক ঋণ প্রাপ্তি স্বভাবিক করতে হবে। কিন্তু সরকার যদি আমানতকারীদের সঞ্চয় না পায় তাহলে বেসরকারী বিনিয়োগ আসবে কোথায় থেকে। বেসরকারী বিনিয়োগ না হলে কর্মসংস্থা বাড়বে না। আর কর্মসংস্থান না হলে জিডিপির প্রবৃদ্ধির বাড়বে না। এ অবস্থায় সরকারকে চিন্তাভাবনা করেই এগুতে হবে। আমানতকারীদের ক্ষেপিয়ে সরকারের ঘোষিত বাজেট বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না।


http://www.dailysangram.com/post/287039-