৬ জুন ২০১৭, মঙ্গলবার, ৭:৫১

রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ

৩১ প্লটের ১৮টিই নিজেরা

রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (আরডিএ) নতুন করে বরাদ্দ দেওয়া ৩১টি প্লট হরিলুট হয়েছে। এই অনিয়মে নেতৃত্বে দিয়েছেন আরডিএর কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই।
স্থানীয় কয়েকজন রাজনৈতিক নেতাকে হাত করে কৌশলে এ কাজ করেছেন তাঁরা। বিনিময়ে ওই সব নেতাকে দেওয়া হয়েছে প্লটের ভাগ। আরডিএর চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং তাঁদের পিয়ন-ড্রাইভাররা মিলে নিয়েছেন ১৮টি প্লট। গোটা পাঁচেক প্লট সাধারণ আবেদনকারীদের মধ্যে বরাদ্দ দিয়ে বাকিগুলো দেওয়া হয়েছে স্থানীয় নেতাদের।
প্লট বরাদ্দের আবেদনের শর্তে উল্লেখ করা হয়েছিল, রাজশাহী নগরীতে যাদের বাড়ি আছে এবং এর আগে যারা আরডিএর প্লট বরাদ্দ পেয়েছে, তারা এবারের প্লটের জন্য আবেদনের যোগ্য বলে বিবেচিত হবে না। অথচ শেষ পর্যন্ত যারা প্লট বরাদ্দ পেয়েছে, তাদের বেশির ভাগেরই নগরীতে একাধিক বাড়ি ও প্লট রয়েছে।
প্লট বরাদ্দে এই অনিয়ম নিয়ে রাজশাহীর সাধারণ মানুষের মধ্যে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। স্থানীয়দের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে মৌখিকভাবে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) রাজশাহী কার্যালয়ে অভিযোগও করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ২৪ এপ্রিল আরডিএর অধীন নগরীর বনলতা বাণিজ্যিক এলাকার সম্প্রসারণ ও আবাসিক এলাকার উন্নয়নের জন্য ৩২টি প্লট বরাদ্দের বিষয়ে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। প্লট বরাদ্দের নোটিশে বলা হয়েছিল, যেসব শ্রেণির কোটা অপূর্ণ রয়েছে সেগুলোর প্রাপ্যতা অনুযায়ী প্লট বরাদ্দ দেওয়া হবে। গত ২৫ মে পর্যন্ত ৩১টি প্লটের বিপরীতে ১৫৪টি আবেদন জমা পড়ে। আবেদনকারীদের মধ্যে সরকারি কর্মকতা-কর্মচারী ছাড়াও স্বায়ত্তশাসিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীরাও রয়েছেন। নোটিশে আবেদনকারীদের উপস্থিতিতে লটারির মাধ্যমে প্লটের বরাদ্দপত্র চূড়ান্ত করার কথা বলা হলেও বাস্তবে কোনো লটারি করা হয়নি।
প্লট না পাওয়া আবেদনকারীদের অভিযোগ, আরডিএর কর্মকর্তা-কর্মচারী, তাঁদের পছন্দের লোকজন ও প্রভাবশালীদের মধ্যে প্লটগুলো ইচ্ছামতো বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বেশির ভাগ প্লট নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছেন আরডিএর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। আর কিছু প্লট নিয়ে বাণিজ্যও করেছেন কয়েকজন কর্মকর্তা।
প্লটবঞ্চিতরা জানায়, আবেদনপত্র জমার শেষ দিন ছিল গত ২৫ মে। ওই দিন আরডিএর এক নোটিশে বলা হয়েছিল, ৩১ মে সকাল সাড়ে ৯টায় লটারি করা হবে। ওই সময় আবেদনকারীদের আরডিএ ভবনে উপস্থিত থাকতেও অনুরোধ করা হয়। সে অনুযায়ী নির্ধারিত দিন সময়মতো অনেক আবেদনকারীই আরডিএ ভবন এলাকায় উপস্থিত হয়। তবে শেষ পর্যন্ত লটারি হয়নি। আরডিএর এস্টেট শাখা থেকে উপস্থিত আবেদনকারীদের
জানানো হয়, লটারি পরে করা
হবে। এখন বরাদ্দ কমিটি বৈঠক করছে।
অভিযোগ অনুযায়ী, প্লট ভাগাভাগির বিষয়টি চূড়ান্ত করতে আরডিএ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ৩১ মে দিনভর আরডিএর চেয়ারম্যান বজলুর রহমানের কক্ষে বসে নানা পরিকল্পনা করেন। কিন্তু প্লটের আয়তন কম হওয়ায় নিম্নপর্যায়ের কর্মচারীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। এ নিয়ে তাঁদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেন এস্টেট অফিসার বদরুজ্জামান। শীর্ষ কর্মকর্তারা বিশাল আয়তনের প্লট বরাদ্দ নেওয়ায় আরডিএর দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীরা প্রতিবাদ করেন। শেষ পর্যন্ত সেদিন প্লট ভাগাভাগির পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। পরের দিন আরডিএ কর্মকর্তারা বেশির ভাগ প্লট ভাগ-বাটোয়ারা করে নেন। ২ জুন আরডিএর চেয়ারম্যান ঢাকায় চলে যান।
প্লট বরাদ্দের তালিকায় দেখা যায়, আরডিএর চেয়ারম্যান ও রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি বজলুর রহমান পেয়েছেন ছয় কাঠা আয়তনের একটি কর্নার প্লট [প্লট নম্বর-১৮৯ (সি)]। প্লট বরাদ্দ কমিটির আহ্বায়ক ও আরডিএর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কমলা রঞ্জন দাস নিয়েছেন পাঁচ কাঠার একটি প্লট [প্লট নম্বর-১১৭ (এ)]। আরডিএর এস্টেট অফিসার ও প্লট বরাদ্দ কমিটির সদস্যসচিব বদরুজ্জামান নিয়েছেন ছয় কাঠার প্লট [প্লট নম্বর-১৮৯ (এ)]। আরডিএর প্রকৌশল শাখার কর্মচারী শামসুন্নাহার নুন্নী নিয়েছেন সাড়ে তিন কাঠার প্লট। আরডিএর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কমলা রঞ্জন দাসের গাড়িচালক শরিফুল ইসলামও পেয়েছেন পৌনে দুই কাঠার প্লট। চেয়ারম্যানের পিয়ন ইউনুস আলীও পেয়েছেন একই আয়তনের প্লট। আরডিএর অথরাইজড অফিসার আবুল কালাম আজাদের পিয়ন রেজাউল করিম পেয়েছেন সাড়ে তিন কাঠার একটি প্লট। এভাবে নিজেদের নামে-বেনামে অন্তত ১৮টি প্লট ভাগ-বাটোয়ারা করেছেন আরডিএর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্লটের জমির মূল্য ধরা হয়েছে কাঠাপ্রতি ৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা। সে অনুযায়ী সাড়ে তিন কাঠা আয়তনের একটি প্লটের দাম পড়ে ৩৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা। দুই কাঠার প্লটের দাম পড়ে ১৯ লাখ টাকা। তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর পক্ষে এত টাকা দিয়ে প্লট বরাদ্দ নেওয়া সম্ভব কি না তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। প্রকৃতপক্ষে আরডিএর অনেক কর্মকর্তা নিজেদের পিয়ন-ড্রাইভারের নামে প্লট বরাদ্দ নিয়েছেন পরে চড়া দামে বিক্রি করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে।
স্থানীয়রা জানায়, যে এলাকায় প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে সে এলাকায় বর্তমানে কাঠাপ্রতি জমির মূল্য ১৫-১৬ লাখ টাকা। প্লট করা হয়ে গেলে সেখানকার জমির কাঠাপ্রতি মূল্য দাঁড়াবে অন্তত ২০ লাখ টাকা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আরডিএর চেয়ারম্যান বজলুর রহমানের পাঁচতলা বাড়ি রয়েছে নগরীর তালাইমারী এলাকায়। এস্টেট অফিসার বদরুজ্জামানেরও বাড়ি রয়েছে নগরীতে। অভিযোগ রয়েছে, অথরাইজড কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ একাধিক প্লট বরাদ্দ নিয়েছেন, নগরীতে তাঁর একাধিক বাড়িও রয়েছে। এ বিষয়ে তাঁর বিরুদ্ধে দুদকে তদন্ত এখনো চলছে। তবে এবার তিনি প্লট নিয়েছেন নিজের পিয়নের নামে।
স্থানীয় নেতাদেরও দেওয়া হয়েছে প্লট। প্লট পাওয়া নেতাদের মধ্যে রয়েছেন রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা শাহরিয়ার আলমের বাবা শামসুদ্দিন, তিনি পেয়েছেন ছয় কাঠার একটি প্লট। তাঁর নিজস্ব বাড়ি রয়েছে রাজশাহী মহানগরীর বালিয়াপুকুর এলাকায়। এ ছাড়া আরডিএর বিভিন্ন আবাসিক প্রকল্পে ক্রয়সূত্রে একাধিক প্লটের মালিকও তিনি। এ ক্ষেত্রে শর্ত অনুযায়ী তিনি আবেদনই করতে পারেন না। তিনি ছাড়াও সাড়ে তিন কাঠার একটি প্লট পেয়েছেন রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল আলম বেন্টু। আজিজুল আলমেরও বাড়ি ও জমি রয়েছে নগরীতে। সাড়ে তিন কাঠার প্লট পেয়েছেন সাবেক মেয়র ও জাতীয় পার্টির রাজশাহী মহানগর শাখার সাবেক সভাপতি দুরুল হুদা। তাঁরও নগরীর একাধিক স্থানে জমি ও বাড়ি রয়েছে।
বনলতা বাণিজ্যিক এলাকার প্লট শ্রেণি ও ক্যাটাগরিভিত্তিক বরাদ্দের কথা নোটিশে বলা হলেও প্লটপ্রাপ্ত আরডিএর শীর্ষ কর্মকর্তারা কোন ক্যাটাগরিতে প্লট বরাদ্দ পেয়েছেন তা নিয়েও বিস্তর প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
প্লটবঞ্চিতরা জানান, আরডিএর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা একাধারে আরডিএর আবাসিক এলাকা পদ্মা, চন্দ্রিমা, মহানন্দা ও এর আগে বনলতার ১৯০টি প্লটে কোটার অতিরিক্ত বরাদ্দ নিয়েছিলেন। নিয়ম লঙ্ঘন করে আরডিএর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা নিয়েছেন একাধিক প্লট। এসব প্লট তাঁদের অনেকেই পরে চড়া দামে বিক্রি করেছেন। এ নিয়ে দুদকের তদন্ত চলছে। এবারও পরে চড়া দামে বিক্রি করার লক্ষ্যেই নামে-বেনামে প্লটগুলো নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। আরডিএর একাধিক সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। প্রাথমিকভাবে এ নিয়ে তারা দুদকের রাজশাহী কার্যালয়ে অভিযোগও করেছে।
এ বিষয়ে দুদক রাজশাহী কার্যালয়ের উপপরিচালক শেখ ফায়েজ আলম বলেন, ‘এ ধরনের অভিযোগ লিখিত আকারে পেলে আমরা অবশ্যই যথাযথ ব্যবস্থা নেব। প্লট নিয়ে দুর্নীতির কোনো সুযোগ কাউকে দেওয়া হবে না। ’
তবে এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আরডিএর এস্টেট অফিসার বদরুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যথাযথ নীতিমালা অনুযায়ী আমরা প্লট বরাদ্দ নিয়েছি। কোনো অনিয়ম করা হয়নি। আরডিএর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কোটা অনুযায়ী প্লটগুলো নেওয়া হয়েছে।
কত ভাগ কোটায় আপনারা এতগুলো প্লট নিজেদের মধ্যে ভাগ করলেন—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এ প্রশ্নের উত্তর আপনাকে দেব না। প্লট পাওয়ার অধিকার আমাদের লোকজনেরও আছে, তাই আমরা পেয়েছি। এর আগে সাধারণ মানুষ প্লট পেয়েছে, এবার আমরা নিয়েছি। ’ আরেক প্রশ্নের জবাবে
তিনি বলেন, রাজনৈতিক নেতারা
প্লট পেয়েছেন ব্যবসায়ী হিসেবে। তাঁরা ব্যবসা করেন বলেই পেয়েছেন।
তবে প্লট বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে কথা বলতে আরডিএর চেয়ারম্যান বজলুর রহমানকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। গতকাল সোমবার দুপুরের পর থেকে কথা বলতে চেষ্টা করলেও রাত পর্যন্ত তাঁর ফোন টানা বন্ধ পাওয়া যায়।

 

http://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2017/06/06/505549