৬ জুন ২০১৭, মঙ্গলবার, ৭:৪৫

তিনবার সময় বাড়লেও এ মাসে শেষ হচ্ছে না কাজ

উন্নয়ন-দুর্ভোগের নাম মগবাজার ফ্লাইওভার

চীনা ঠিকাদারের দেশি সহযোগী অভিজ্ঞতাহীন

২০১৪ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা ছিল মগবাজার ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ। ২০১৩-এর জানুয়ারিতে কাজ শুরু করে দু'বছর মেয়াদি প্রকল্পের সময় তিন দফা বাড়িয়ে নির্ধারিত সর্বশেষ আগামী ৩০ জুনের মধ্যে সমাপ্তির কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে নির্মাতারা ঈদ-পরবর্তী এক-দুই মাসের মধ্যে শেষ করার আশা রাখেন।


ভুল নকশা, তার খেসারত হিসেবে একাধিকবার পরিবর্তন ও সময় বৃদ্ধির ফলে নির্মাণ ব্যয় বাড়ানো হয়েছে মূল অঙ্কের চেয়ে সাড়ে চারশ' কোটি টাকা বেশি। বিশেষজ্ঞদের মতে, 'বিশ্বের বিস্ময়' হিসেবে দুনিয়ায় এ একটিমাত্র ফ্লাইওভার যাতে মোড় বা ইন্টারসেকশন এবং ট্রাফিক সিগন্যাল থাকবে। সেটা মৌচাকের কাছে এবং তাতে ফ্লাইওভারের ওপরেই যানজট লেগে কী অবস্থা হবে কেউ বলতে পারছেন না, কারণ সে বিষয়ে কোনো জরিপ নেই। সব মিলিয়ে এই ফ্লাইওভার নির্মাণের দীর্ঘ বিলম্বিত কাজে চার বছর ধরে 'উন্নয়ন-দুর্ভোগ' পোহাচ্ছেন প্রকল্প এলাকার বাসিন্দা ও চলাচলকারী লাখো মানুষ। নির্মাণকাজের নিয়ম মেনে যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা না নেওয়ায় এবং জনগণের চলাচলের প্রতি অবহেলায় সারা বছর খানাখন্দে বিশেষত মৌচাক এলাকাটুকু পুকুরের মতো থেকেছে। এখন সে রাস্তার একদিক মেরামত করা হয়েছে।

অভিজ্ঞতাহীন ঠিকাদার তমা :এই প্রকল্পের ঠিকাদারি কাজ পাওয়া তমা গ্রুপের ফ্লাইওভার নির্মাণের অভিজ্ঞতা ছিল না দরপত্র আহ্বানের সময়। ফ্লাইওভারের কাজে অভিজ্ঞ মেটালারজিক্যাল করপোরেশন অব চায়নার (এমসিসি) সঙ্গে কনসোর্টিয়াম গঠন করে দরপত্রে অংশ নেয় তমা গ্রুপ। এমসিসির অভিজ্ঞতার জোরে কাজ পায় তমা। এমসিসি মূল ঠিকাদার হলেও নির্মাণকাজে প্রতিষ্ঠানটির কেউ যুক্ত নেই।

জানতে চাইলে তমা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান সমকালকে বলেন, 'যখন প্রয়োজন তখন চীনারা আসে। বাকি সময়ে আমরাই কাজ করি।' মূল ঠিকাদার হয়েও এমসিসির কর্মীদের না থাকা সম্পর্কে তিনি বলেন, 'তাদের সব সময় দরকার পড়ে না। তাই আসে না।'

আতাউর রহমান নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। ফ্লাইওভার নির্মাণে অনভিজ্ঞ তমা গ্রুপের ঢিমেতালে কাজ করার অভিযোগ রয়েছে শুরু থেকেই। পাইলিং শেষ করতে তিন বছর সময় লাগে। নির্মাণস্থলে দুই ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। গত ১৩ মার্চ মালিবাগ রেলগেটের কাছে গার্ডার পড়ে নিহত হন একজন কর্মী। পা হারান আরেক কর্মী।

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) মগবাজার ফ্লাইওভারের বাস্তবায়নকারী সংস্থা। ২০০২ সালে ফ্লাইওভার নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। কাগজে কলমে ২০১১ সালে কাজ শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালের ১৫ জানুয়ারি ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন। কাজে দীর্ঘ বিলম্বের কারণে বিরক্ত হয়ে প্রকল্পের মূল পরামর্শক অস্ট্রেলিয়ার স্ম্যাক ইন্টারন্যাশ কাজ ছেড়ে চলে গেছে। ৮ দশমিক ৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এ ফ্লাইওভারের ব্যয় ৭৭২ কোটি ৭০ লাখ থেকে বেড়ে হয়েছে এক হাজার ২১৮ কোটি ৮৯ লাখ টাকা।

স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী মসিউর রহমান রাঙ্গা সমকালকে বলেন, 'সবারই জবাবদিহিতা থাকা দরকার। কোনো প্রতিষ্ঠান যদি কাজে বিলম্ব করে সময় বাড়াতেই থাকে, তবে তাদের শাস্তির আওতায় আনা উচিত। প্রতিষ্ঠান কার তা দেখলে জবাবদিহিতা থাকবে না।'

মসিউর রহমানের নিজ মন্ত্রণালয়ই যখন ফ্লাইওভার বাস্তবায়ন করছে তখন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না কেন প্রশ্ন করলে প্রতিমন্ত্রী জবাব দিতে চান না।

কাজ কবে শেষ হবে :মগবাজার ফ্লাইওভার তিন অংশে বিভক্ত। বাংলামটর থেকে মৌচাক অংশ (প্যাকেজ-৬) এবং রামপুরা থেকে মালিবাগ হয়ে শান্তিনগর অংশের (প্যাকেজ-৬) ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এমসিসি ও তমা গ্রুপ। সাতরাস্তা থেকে রমনা অংশের (প্যাকেজ-৪) অংশের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ভারতীয় প্রতিষ্ঠান সিমপ্লেক্স ও দেশীয় প্রতিষ্ঠান নাভানা জেভি। এ প্যাকেজের কাজ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। গত বছরের ৩০ মার্চ শেষ হয় সাতরাস্তা থেকে রমনা অংশের কাজ। গত মাসে শেষ হয়েছে এ প্যাকেজের বর্ধিতাংশ এফডিসি মোড় থেকে সোনারগাঁও হোটেল পর্যন্ত র্যাম্পের কাজ।

প্যাকেজ-৪ এর কাজ প্রায় ১৫ মাস আগে শেষ হলেও প্যাকেজ-৫ এবং প্যাকেজ-৬ পুনর্নির্ধারিত সময়েও শেষ হবে না, তা নিশ্চিত। গত বছরের অক্টোবরে প্যাকেজ-৬ এর একাংশ বাংলামটর থেকে ওয়ারল্যাস গেট পর্যন্ত যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। এই প্যাকেজের মৌচাক থেকে বাংলামটর অংশের কাজও শেষ। কিন্তু প্যাকেজ-৫-এর কাজ শেষ না হওয়ায় তা যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে না।

প্রকল্প পরিকল্পনা অনুযায়ী, চলতি মাসের মধ্যে কাজ শেষ করতে হবে। কিন্তু রামপুরা থেকে মালিবাগ হয়ে শান্তিনগর এবং রাজারবাগ থেকে মালিবাগ মোড় পর্যন্ত ফ্লাইওভার নির্মাণকাজ বহুলাংশে বাকি। পাইলিংয়ের কাজ শেষে এখন সুপারস্ট্রাকচারের (উপরিভাগের) কাজ চলছে। রামপুরা, রাজারবাগ, শান্তিনগর প্রান্তে র্যাম্প নির্মাণের কাজও বাকি।

তমা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, 'এ মাসের মধ্যে কাজ শেষ করার চেষ্টা করছি।'

তমা গ্রুপের প্রকল্প সমন্বয়ক মো. শরিফুল ইসলাম সমকালকে বলেন, প্যাকেজ-৫ এর ৯০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। ঈদের কারণে এ মাসে কাজ শেষ করা যাবে না। জুলাইয়ের মধ্যে মূল শেষ করা সম্ভব হবে। ঈদের কারণে কিছু দিন কাজ বন্ধ থাকবে। নইলে এ মাসেই কাজ শেষ হতো বলে দাবি করেন তিনি।

নানা প্রতিবন্ধকতা :প্রকল্প পরিচালক সুশান্ত কুমার পাল আড়াই বছর বিলম্বিত হওয়া প্রসঙ্গে বলেন, এ ফ্লাইওভার নির্মাণে অনেক রকম প্রতিবন্ধকতা ছিল। কয়েক দফায় নকশা পরিবর্তন করতে হয়েছে। ভূ-গর্ভস্থ পরিষেবার লাইন স্থানান্তরে অনেক সময় লেগেছে।

একই প্রতিবন্ধকতা প্যাকেজ-৪-এর ঠিকাদারদেরও মোকাবেলা করতে হয়েছে। তারা কীভাবে ১৫ মাস আগে কাজ শেষ করেছে- এ প্রশ্নের জবাব নেই তমা গ্রুপের কাছে। ফ্লাইওভার নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত সাবেক একজন কর্মকর্তা জানান, অর্থায়ন সমস্যা ছিল শুরুর দিকে। তাছাড়া তমা গ্রুপ সারাদেশে অনেক প্রকল্পের কাজ একসঙ্গে করছে। মহাসড়ক প্রকল্পকে অগ্রাধিকার দিতে হয়। এ কারণেও মগবাজার ফ্লাইওভারের কাজ যতটা দ্রুতগতিতে করার কথা ছিল, তা করতে পারেনি।

নকশায় ত্রুটি :গত বছরের ৩০ মার্চ ফ্লাইওভারের সাতরাস্তা-রমনা অংশ যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়ার পর তীব্র যানজট সৃষ্টি হয় তেজগাঁওয়ে। ফ্লাইওভারের নকশায় ত্রুটি রয়েছে কি-না খতিয়ে দেখতে পরের দিন তাজুল ইসলাম এমপিকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। তদন্ত কমিটি ১৫ মাসেও প্রতিবেদন জমা দেয়নি।

মৌচাকে ফ্লাইওভারের ওপরে তিন দিকের গাড়ির কারণে একটি ইন্টারসেকশন সৃষ্টি হয়েছে। গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শামছুল হক বলেন, পৃথিবীর কোথাও ফ্লাইওভারের ওপর ইন্টারসেকশন থাকে না, যেখানে গাড়ি সিগন্যালে আটকে রাখতে হয়। নকশা অনুমোদনের সময় এ ভুল নজরে আসেনি, ভুল রয়েই গেছে।

শান্তিনগর ও রাজারবাগ থেকে রামপুরামুখী যানবাহন মৌচাক মোড় থেকে ডান দিকে ঘোরার সময় সিগন্যালে পড়বে অর্থাৎ মগবাজার থেকে মালিবাগমুখী যানবাহনের মুখোমুখি হবে।

ফ্লাইওভারের ওপরে সিগন্যাল কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে, এর জবাব নেই কারও কাছে। প্রকল্প পরিচালকের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জায়গার অভাবে ফ্লাইওভারে একটি ইন্টারসেকশন সৃষ্টি হয়েছে।

প্রকৌশলীরা বলছেন, নকশায় আরও ত্রুটি রয়েছে। ২০১৪ সালে নকশা সংশোধনে কাজ করে বুয়েটের বিশেষজ্ঞ কমিটি। কমিটির সদস্য ড. শামছুল হক সমকালকে জানান, যখন নকশা করা হয়েছিল তখন তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে চৌরাস্তা ছিল না। ২০০৮ সালে বিজয় সরণি ফ্লাইওভার নির্মাণের কারণে এই চৌরাস্তার সৃষ্টি হয়। হাতিরঝিল নির্মাণের পর ফ্লাইওভার প্রকল্প এলাকার চরিত্রই বদলে যায়। কিন্তু কাজ শুরুর আগে যাচাই না করে পুরনো নকশাতেই ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়। বুয়েট যখন কাজ শুরু করে, তখন আর কিছুই করার ছিল না।

যানজট নিরসনের মহাপরিকল্পনা তথা কৌশলগত পরিববহন পরিকল্পনায় (এসটিপি) মগবাজারে ফ্লাইওভার নির্মাণের কথা ছিল না। মহাপরিকল্পনা ভেঙে প্রকল্পটি নেওয়া হয়। ফ্লাইওভারটি মহাপরিকল্পনাভুক্ত প্রকল্প বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) ও মেট্রো রেলের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলেও বিশেষজ্ঞরা জানান।

কাজ শুরুর সাড়ে চার বছর পরও দুর্ভোগে ভুগছেন মগবাজার, মৌচাক, রামপুরা, মালিবাগ ও শান্তিনগরের পথে চলাচলকারী। অতি সম্প্রতি ওয়ারল্যাস গেট থেকে মালিবাগ পর্যন্ত সিমেন্ট ঢালাই পথ নির্মাণ করায় জলাবদ্ধতার ভোগান্তি কমেছে। মৌচাক থেকে রামপুরামুখী সড়কের একপাশে মাটি ভরাট হয়েছে, অপর পাশে নয়।

তমা গ্রুপের প্রকল্প সমন্বয়ক শরিফুল ইসলাম বলেন, 'দুর্ভোগ নিরসনে আমরা রাস্তা নির্মাণ করে দিয়েছি। চুক্তি অনুযায়ী এটা আমাদের করার কথা ছিল না। রাস্তার দুই পাশে ড্রেনের কাজ করছে সিটি করপোরেশন। এ কারণেই এখন দুর্ভোগ হচ্ছে।'

দীর্ঘ বিলম্বিত এই প্রকল্পের কারণে মালিবাগ-মৌচাকের ব্যবসায়ীদের অনেক ক্ষতি হচ্ছে। এ রমজানেও মার্কেটগুলোতে ক্রেতা নেই। মৌচাকের ফরচুন শপিং মলের ব্যবসায়ী নেতা রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া সমকালকে জানান, ফ্লাইওভার নির্মাণে মালিবাগ, মৌচাক, রামপুরার রাস্তার অবস্থা কয়েক বছর ধরে খুবই খারাপ। ক্রেতারা এ এলাকায় আসতে চান না। বিক্রি-বাট্টা নেই। অনেক ব্যবসায়ী দোকান বিক্রি করে দিয়েছেন।

http://bangla.samakal.net/2017/06/06/298691#sthash.VdglZeQc.dpuf