৫ জুন ২০১৭, সোমবার, ৩:৫৭

করচক্রে গ্রাহক

কেমন হলো বাজেট

আবুল হোসেন একজন নিম্ন আয়ের মানুষ। রূপালী ব্যাংকের যশোর খাজুরা শাখায় তার একটি সঞ্চয়ী হিসাবে জমা আছে এক লাখ টাকা। সঞ্চয়ী হিসাবে রূপালী ব্যাংক এখন মাত্র সাড়ে তিন শতাংশ হারে সুদ দিচ্ছে। জুন ও ডিসেম্বরে দুই দফায় তাকে তিন হাজার ৫০০ টাকা সুদ দেবে ব্যাংক। আবুল হোসেনের করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর বা টিআইএন নেই। ফলে অর্জিত সুদের ওপর উৎসে কর বাবদ ১৫ শতাংশ হারে ৫২৫ টাকা কাটা হবে। করের বাইরে অ্যাকাউন্ট রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ২০০ টাকা করে বছরে দু'বার ৪০০ টাকা সার্ভিস চার্জ নেবে ব্যাংক। আইন অনুযায়ী, ব্যাংকের সব ধরনের সার্ভিস চার্জের ওপর ১৫ শতাংশ হারে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট কেটে রাখা হয়।

ফলে ব্যাংক হিসাব রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আবুল হোসেনকে একই হারে আরও ৬০ টাকা দিতে হবে। এর বাইরে আবগারি শুল্ক বাবদ সরকারকে দিতে হবে ৮০০ টাকা। শেষ পর্যন্ত তার মুনাফার প্রায় পুরোটাই চলে যাবে কর, আবগারি শুল্ক, ভ্যাট এবং ব্যাংকের সার্ভিস চার্জে।


এমনিতেই মূল্যস্ফীতির তুলনায় অনেক কম সুদ পাচ্ছেন ক্ষুদ্র সঞ্চয়কারীরা। ফলে প্রকৃত বিচারে কোনো লাভই পাচ্ছেন না তারা । মূল্যস্ফীতি তার মুনাফা খেয়ে ফেলছে; এর ওপর ব্যাংক সেবার বিভিন্ন স্তরে একাধিক হারে কর কেটে রাখায় আগে থেকেই তারা উদ্বিগ্ন ছিলেন। এখন বাজেটে ব্যাংকে রাখা টাকার ওপর আবগারি শুল্ক বৃদ্ধি তাদের অনেক বেশি দুশ্চিান্তাগ্রস্ত করে তুলেছে। বাজেট ঘোষণার পর সামাজিক মাধ্যমে এ বিষয়টি নিয়েই সমালোচনা হচ্ছে বেশি। অর্থনীতিবিদরাও এই সিদ্ধান্তের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তারা মনে করেন, এ সিদ্ধান্ত মানুষকে ব্যাংকে টাকা রাখতে নিরুৎসাহিত করবে।

জানা গেছে, বিশ্বের অধিকাংশ দেশে নির্দিষ্ট পরিমাণের সুদ আয়ের ওপর কর কাটা হয়। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে কোনো ব্যক্তি ব্যাংকে জমানো টাকার ওপর ১০ হাজার রুপির বেশি সুদ আয় করলেই কেবল সরকার কর কর্তন করে। এর আগ পর্যন্ত তার সুদ আয় করমুক্ত। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কোনো ভেদাভেদ নেই। ব্যাংক সেবার প্রত্যেক স্তরেই কর আদায় করা হচ্ছে।

ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স, বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও বেসরকারি মেঘনা ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ নূরুল আমিন সমকালকে বলেন, ব্যাংকে জমানো অর্থের ওপর সরকারের কর বা শুল্ক কাটা সহজ। যে কারণে আয় বাড়ানোর প্রশ্ন এলেই এখানে হাত দেওয়া হয়। এমনিতেই ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার অনেক কমিয়ে এনেছে। আবার ব্যাংকগুলোর বিভিন্ন চার্জ রয়েছে। এসব চার্জের ওপর বিদ্যমান ১৫ শতাংশ ভ্যাটের পাশাপাশি আবগারি শুল্ক বাড়ানো হলে আমানতকারীরা চাপে পড়বেন।

এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে ব্যাংক হচ্ছে কর আদায়ের অন্যতম বড় খাত। ব্যাংক সেবায় ভ্যাট বাবদ বছরে মোট আদায় হয় দেড় হাজার কোটি টাকা। উৎসে কর বাবদ মুনাফার ওপর আদায়ের পরিমাণ সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকা। এর বাইরে ব্যাংকগুলো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে উচ্চ হারে করপোরেট কর দিয়ে থাকে। এর পরিমাণ প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা।

একটি সূত্র বলেছে, এবারের বাজেটে ব্যাংক আমানতের ওপর আবগারি শুল্ক বাড়ানোর প্রস্তাবে সমালোচনার ঝড় বইছে সারাদেশে। এই পরিপ্রেক্ষিতে আবগারি শুল্ক কমিয়ে আগের মতো নির্ধারণ করা হতে পারে। জানা গেছে, বর্তমানে ব্যাংক সেবা ও বিমানের টিকিট- এই দুটি সেবা খাতে শুধু আবগারি শুল্ক আদায় করা হয়। ১৯৯১ সালে যখন দেশে ভ্যাট প্রথা প্রবর্তন করা হয়েছিল, তখন সব পণ্য ও সেবায় আবগারি শুল্ক বিলুপ্ত করে তার পরিবর্তে ভ্যাট বসানো হয়।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই ব্যাংক খাতের ওপর থেকে সম্পূর্ণরূপে আবগারি শুল্ক প্রত্যাহার দাবি করেছে। এফবিসিসিআই বলেছে, মূলধন গঠন, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান তথা ব্যবসায়িক কার্যক্রমের জন্য ব্যাংক লেনদেন করা হয়। এখন আবগারি শুল্ক বাড়ানো হলে আমানতকারীরা নিরুৎসাহিত হবেন। ব্যাংকে টাকা না রেখে অন্য জায়গায় রাখবেন। আমানত ও ঋণ উভয় হিসাব থেকে বছরে একবার আবগারি শুল্ক বা এক্সাইজ ডিউটি কাটা হয়। বছরের যে কোনো সময়ে একবার সর্বোচ্চ স্থিতির ওপর বছর শেষে এ ধরনের শুল্ক আরোপিত হয়। এর মধ্যে এক লাখ টাকার বেশি রয়েছে এ ধরনের হিসাবের সংখ্যা এক কোটি ৫ হাজারের মতো।

দেশে এখন ঋণ ও আমানত অ্যাকাউন্ট রয়েছে ৯ কোটি ১৬ হাজার। এর মধ্যে এক লাখের ওপরে ও কোটি টাকার নিচে হিসাব সংখ্যা এক কোটি তিন লাখ। অর্থমন্ত্রী আবগারি শুল্ক বাড়িয়ে আয় বৃদ্ধির যে পরিকল্পনা করছেন তার ৮০ শতাংশই আসবে লাখ টাকা থেকে কোটি টাকার নিচের হিসাবধারীদের থেকে। বাজেটে আবগারি শুল্ক বাড়ানোর ঘোষণার পর থেকে এ নিয়ে নানা সমালোচনার মধ্যে গত শুক্রবার বাজেট-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী লাখ টাকার বেশি রয়েছে- এমন ব্যক্তিদের সম্পদশালী হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এর পর থেকে এ নিয়ে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুরু হয়েছে নতুন সমালোচনা।

আমানত ও ঋণ উভয় হিসাব থেকে বছরে একবার আবগারি শুল্ক বা এক্সাইজ ডিউটি কাটা হয়। বছরের যে কোনো সময়ে সর্বোচ্চ স্থিতির ওপর এ ধরনের শুল্ক আরোপিত হবে। এক লাখ টাকার ঊর্ধ্ব থেকে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত আবগারি শুল্ক ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮০০ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। দশ লাখ টাকা থেকে এক কোটি টাকার ওপর দেড় হাজার টাকার পরিবর্তে আড়াই হাজার টাকা আবগারি শুল্ক নেওয়া হবে। এক কোটি টাকার ঊর্ধ্ব থেকে পাঁচ কোটি টাকা পর্যন্ত ক্ষেত্রে আগে সাড়ে ৭ হাজার টাকা নেওয়া হতো। এখন থেকে নেওয়া হবে ১২ হাজার টাকা। পাঁচ কোটি টাকার বেশি ব্যাংক স্থিতি থাকলে ১৫ হাজার টাকার পরিবর্তে ২৫ হাজার টাকা আবগারি শুল্ক প্রস্তাব করা হয়েছে।

বাজেটে ব্যাগেজ রুলে পরিবর্তন : প্রস্তাবিত বাজেটে আকাশপথে যাত্রী পরিবহনে পণ্য আনার ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন করা হয়েছে। আবদুর রহিম একজন প্রবাসী বাংলাদেশি। তিনি সৌদি আরবে চাকরি করেন। সৌদি আরব থেকে দেশে ছুটিতে বিমানপথে দেশে আসার সময় ২২ থেকে ২৯ ইঞ্চি একটি রঙিন টিভি বিনা শুল্কে আনতে পারবেন। এর চেয়ে বড় টিভি আনতে হলে তাকে নির্ধারিত শুল্ক দিতে হবে। ৩০ থেকে ৩৬ ইঞ্চি টিভির জন্য শুল্ক দিতে হবে ১০ হাজার টাকা। ৬৫ ইঞ্চি পর্যন্ত রঙিন টিভির জন্য ৭০ হাজার টাকা এবং ৬৬ থেকে তদূর্ধ্ব রঙিন টিভি আনতে চাইলে ৯০ হাজার টাকা শুল্ক দিতে হবে। এ বাজেটে যাত্রীদের কার্পেট আনার নিয়ম পরিবর্তন করা হয়েছে। আগে প্রতি বর্গমিটারে ১৫০ টাকা শুল্ক দিয়ে একাধিক কার্পেট আনতে পারতেন। এখন থেকে ১৫ বর্গমিটার পর্যন্ত কার্পেট আনতে কোনো শুল্ক দিতে হবে না। এর বেশি পরিমাণ দৈর্ঘ্যের কার্পেট আনতে গেলে প্রযোজ্য হারে শুল্ক দিতে হবে। আগে একজন বাংলাদেশি যাত্রী স্থলবন্দর দিয়ে আসার সময় প্রতিবেশী দেশ ভারত, নেপাল ভুটান থেকে সর্বোচ্চ ৪০০ ডলার মূল্যের সমপরিমাণ প্রায় ৩৩ হাজার টাকার পণ্য আনতে পারতেন বিনা শুল্কে। যতবার খুশি ততবার যাওয়া-আসা করতে পারতেন। নতুন নিয়মে ভ্রমণের নামে বছরে তিনবারের বেশি যাওয়া-আসার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।

বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এসএমই শিল্প : নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর হলে সবচেয়ে বেশি চাপে পড়বে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) খাত। এসব খাতে বেশির ভাগই হিসাব ঠিকমতো রাখা হয় না। লেনদেনের ক্ষেত্রে চালান রাখা হয় না। ফলে তারা উপকরণের জন্য কর রেয়াত বা ক্রেডিট নিতে পারবেন না । নতুন আইন যেহেতু প্রযুক্তি ও রেয়াতনির্ভর। তাই, এসএমই খাতের খরচ বাড়বে। নতুন ভ্যাট আইনের ফলে দেশীয় সিরামিক খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কারণ, আমদানি করা টাইলসের সম্পূরক শুল্ক বিদ্যমানের চেয়ে ১০ ভাগ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে স্থানীয় টাইলস ফ্যাক্টরির খরচ বাড়বে এবং তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

বেসরকারি চাকরিজীবীদের রিটার্ন বাধ্যতামূলক :গত বাজেটে বেসরকারি খাতের ব্যবস্থাপনা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। এবারের বাজেটে ব্যবসা বা পেশার নির্বাহীদের রিটার্ন দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হলো। গতবার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী টিআইএন বাধ্যতামূলক করায় টিআইএনধারীর সংখ্যা ব্যাপক হারে বেড়েছিল। এনবিআর আশা করছে, বেসরকারি নির্বাহীদের কর দেওয়ার সামর্থ্য আছে। ফলে সবাইকে করের আওতায় আনার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

১৫ শতাংশের বেশি আয় দেখালে অডিট হবে না : কোনো করদাতা তার আগের বছরের চেয়ে ১৫ শতাংশ বেশি আয় দেখালে তার আয়কর ফাইল অডিট করবে না এনবিআর। এছাড়া রিটার্ন জমার পদ্ধতিতে কিছু ছাড় দেওয়া হয়েছে এবারের বাজেটে। আয়কর অধ্যাদেশে নির্দিষ্ট ধারা সংশোধন করে করদাতাদের স্বস্তি দেওয়া হয়েছে। সংশোধনীটি হলো : বার্ষিক রিটার্নে কোনো করদাতা ১৫ শতাংশ বেশি আয় দেখালে অডিট ফেলবে না এনবিআর। রিটার্নে ভুল ধরা পড়লে কর কর্মকর্তা অবশ্যই ওই করদাতাকে জানাতে হবে। ওই করদাতা ভুল সংশোধন করে পুনরায় রিটার্ন জমার সুযোগ পাবেন।

http://bangla.samakal.net/2017/06/05/298442#sthash.bwARKNAj.dpuf