পবিত্র ঈদুল ফিতরের আগে গুম হওয়া সন্তানদের মায়ের কোলে ফিরিয়ে দেয়ার দাবিতে গতকাল শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে স্বজনদের উদ্যোগে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয় -সংগ্রাম
৪ জুন ২০১৭, রবিবার, ১০:৩৩

গুম হওয়া মানুষগুলোকে ঈদের আগে ফিরিয়ে দেওয়ার আকুতি স্বজনদের

“আর কত দিন অপেক্ষায় থাকব। চোখে এখন আর পানি নেই। রক্ত অশ্রু হয়ে ঝরছে। দরজায় কড়া নাড়লে মনে হয় আমার মাসুম এসেছে। যেন আমাকে মা বলে ডাকছে। আর বলছে মা কী রান্না করছো, তাড়াতাড়ি ভাত দাও। আমাকে এখন আর কেউ জিজ্ঞেস করে না, মা ওষুধ খেয়েছো? আমি রোজ বারান্দা দিয়ে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে আমার মাসুমকে খুঁজি। ঘরে সাজিয়ে রাখা তার পরার জামা থেকে আমি তার ঘ্রাণ নিই।” এসব কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন গুম হওয়া মাসুমের মা আয়েশা আলী।

গতকাল শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে গুম হওয়া পরিবারের উদ্যোগে আয়োজিত এক মানববন্ধনে আয়েশা আলী প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলেন, সন্তানের মা হিসেবে আমাদের ক্ষত বিক্ষত হৃদয়ের কষ্টটা অনুভব করুন। আপনার সন্তান জয় গুম হলে আপনার কেমন লাগত। দয়া করে আমাদের সন্তানদের ফিরিয়ে দিন। মানববন্ধনে বিভিন্ন সময় গুম হওয়া ২০ পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন । এ সময় তারা পবিত্র ঈদুল ফিতরের আগে গুম হওয়া সন্তানদের মায়ের কোলে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানান প্রধানমন্ত্রীর কাছে।
মানববন্ধনে একাত্মতা পোষণ করেন নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সম্পাদক ডা. ফায়জুল হাকিম লায়লা এবং ব্যারিস্টার সাদিয়া আরমানসহ আরও অনেকে।
পরিবারের সদস্যেদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মাসুমের মা আয়েশা আলী, ফারভেজ হোসেনের মেয়ে ফারজানা আক্তার, তারার স্ত্রী বেবী আক্তার, চঞ্চলের স্ত্রী রেশমা আক্তার, কাউছারের স্ত্রী মিনু বেগম, সেলিম রেজার বড় ভাই ইসলাম রেজা এবং সম্রাটের বড় বোন কানিজ ফাতেমাসহ আরও অনেকে..........
মানববন্ধনে দেখা যায়, শিশুরা তার বাবার ছবি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, হারিয়ে যাওয়া সন্তানের খোঁজে মায়ের চোখে পানি, স্বামীর অপেক্ষায় মুখে কাপড় চেপে দাঁড়িয়ে আছে স্ত্রী।
তিন বছর আগে গুম হয়ে যাওয়া পারভেজ হোসেনের ছোট্ট মেয়ে হৃদি তার মা ফারজানা আক্তারের সাথে প্রেসক্লাবের সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে বার বার বলতে ছিলো, আমার পাপাকে ফিরিয়ে দাও। পাপাকে ছাড়া ভালো লাগে না। আমরা পাপার সাথে মার্কেটে যেতে চাই, তার সাথে ঈদ করবো।
গুম হওয়া সাজেদুল ইসলাম সুমনের বড় বোন আফরোজা ইসলাম বলেন, আমার ভাইকে ফিরিয়ে দিন, আমাদের বাঁচতে দিন। আমরা ভাইয়ের অপেক্ষায় রয়েছি। ভাইকে ফিরে পেলে প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবো। এ সময় ঈদের আগে গুম হওয়া ব্যক্তিদের ফিরিয়ে না দিলে ঈদের দিনেও রাজপথে অবস্থানের ঘোষণা দেন স্বজনরা।
‘মায়ের ডাক- গুম-খুন আর নয়’। ঈদুল ফিতরের আগে গুম হওয়া সন্তানদের মায়ের কোলে ফিরিয়ে দাও, এমন ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা স্বজনদের সারিতে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহামুদুর রহমান মান্না বলেন, আমিও হারিয়ে গিয়েছিলাম। ২১ ঘণ্টা আমার কোন খোঁজ ছিলো না। এরপর ফিরে এসে পরিবারের লোকদের চোখে দেখেছি কি আর্তনাদ।
নিজের গুম হয়ে যাওয়ার কথা থামিয়ে মাহামুদুর রহমান মান্না বলেন, মা কাঁদেন, সন্তান ছবি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে এসব স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দেখেন না। গুম হওয়া সন্তানের মায়ের কান্না প্রধানমন্ত্রীর কানে পৌঁছায় না। প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বজন হাড়ানোর ব্যথা আমি বুঝি। কিন্তু অন্যদের স্বজন হাড়ানোর ব্যথা তিনি বুঝেন না'।
তিনি আরো বলেন, গুম হওয়া লোকদের খুঁজে আনার দায়িত্ব প্রশাসনের। কিন্তু তারা সেই দায়িত্ব পালন করে না। পুলিশ সরকারের হুকুমের বাইরে কোন কাজ করে না। এমনটা কি কোন রাষ্ট্রের ভূমিকা হতে পারে?
মান্না বলেন, ‘বর্তমানে হাড়িয়ে যাওয়া স্বজনরা পুলিশের কাছে অভিযোগ করতে ভয় পাচ্ছেন। কারণ হাড়িয়ে যাওয়া ব্যক্তি প্রশাসন বলছে তিনি জঙ্গিবাদে জড়িয়ে গেছেন কি-না। জঙ্গি এমন এক শব্দ যা শুনলে সবাই চুপ হয়ে যায়।
এ সময় জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক ফায়জুল হাকিম লালা বলেন, দেশে আইনের শাসন নেই। বেআইনিভাবে রাষ্ট্রের নাগরিকদের আজ হত্যা করা হচ্ছে। কান্না নয়, চিৎকার করতে হবে, গুম হয়ে যাওয়া স্বজদের দাবি তুলতে হবে।
মানববন্ধনে আরো বক্তব্য রাখেন গুম হওয়া চঞ্চলের স্ত্রী রেশমা আক্তার, ছোট ছেলে আহাদ, তারার স্ত্রী বেবি আক্তার, সেলিম রেজার পিন্টুর বড় ভাই ইসলাম রেজা, ব্যারিস্টার সাদিয়া আরমান, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, আইন ও সালিস কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন, ফেরদৌসী রহমান, অধিকারের পরিচালক নাসির উদ্দিন এলান প্রমুখ।

http://www.dailysangram.com/post/286604-