৪ জুন ২০১৭, রবিবার, ১০:৩২

মুনাফার ১৯ হাজার ১৭৪ কোটি টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেয়নি বিপিসি

আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমে যাওয়ার সুফল পায়নি মানুষ। উপরন্ত আমদানি মূল্যের চেয়ে বেশি দামে তেল বিক্রি করে যে মানুফা পেয়েছে তার এক ভাগও জমা হয়নি রাষ্ট্রীয় কোষাগারে। 

পরিসংখ্যান বলছে, গত ৩ বছরে জ্বালানি তেল বিক্রি করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) ২১ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকার বেশি মুনাফা করেছে। অথচ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিয়েছে মাত্র ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা। বাকী ১৯ হাজার ১৭৪ কোটি টাকা জমা হয়নি রাষ্ট্রীয় কোষাগারে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম নিম্নমুখী হওয়ার পর থেকে ক্রমাগত মুনাফা করে যাচ্ছে বিপিসি। চলতি বছর ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত বিপিসির মুনাফা দাঁড়ায় সাত হাজার ৩৩৪ কোটি ১৩ লাখ টাকা। জুন শেষে তা আট হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া গত অর্থবছর বিপিসি মুনাফা করে ৯ হাজার ৭০ কোটি সাত টাকা। আর ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সংস্থাটির মুনাফার পরিমাণ ছিল চার হাজার ১২৬ কোটি ১০ লাখ টাকা।
সূত্র জানায়, বিপুল পরিমাণ মুনাফা হলেও ২০১৪-১৫ অর্থবছরে সরকারি কোষাগারে কোনো অর্থই জমা দেয়নি বিপিসি। এর পর ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ১ হাজার কোটি টাকা এবং ২০১৬-১৭ অর্থবছরে (৪ মে ২০১৭ পর্যন্ত) ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে লভ্যাংশ হিসেবে জমা দিয়েছে সংস্থাটি।
বিপিসির পরিচালক (পরিচালন ও উন্নয়ন) সৈয়দ মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক বলেন, গত কয়েক বছর মুনাফা করলেও সরকারি কোষাগারে সে তুলনায় অর্থ জমা দেয়া হয়নি। তবে মুনাফার অর্থ ঋণ পরিশোধসহ বিভিন্ন খাতে ব্যয় করা হচ্ছে। তিনি দাবী করেন, জ্বালানি তেল পরিশোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারির দ্বিতীয় ইউনিট (ইআরএল-২) নিজস্ব অর্থায়নেই বাস্তবায়ন করছে বিপিসি। পাইপলাইন স্থাপনসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজও বিপিসির নিজস্ব অর্থায়নেই করা হচ্ছে। অনেক সময় সরকারের কাছ থেকে জরুরি প্রয়োজনে অর্থ পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। যদি প্রতিষ্ঠানের হাতে অর্থ থাকে তাহলে দ্রুত প্রয়োজন মেটানো যায়।
১৯৭৭ সালের ১ জানুয়ারি পেট্রোবাংলা থেকে আলাদা হওয়ার পর ১৯৭৭-৭৮ অর্থবছরে লভ্যাংশ থেকে ২৫ লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেয় বিপিসি। এর তিন বছর পর ১৯৮০-৮১ অর্থবছরে জমা দেয় ৩ কোটি টাকা। এরশাদের শাসনামলে টানা ছয় অর্থবছর বিপিসি থেকে মুনাফার অর্থ পায় সরকার। এর পর ১৯৯৮-৯৯ অর্থবছরে সরকারি কোষাগারে ৮০ কোটি টাকা মুনাফা দেয় বিপিসি। পরের টানা ১৬টি অর্থবছরে সরকার বিপিসি থেকে কোনো লভ্যাংশ পায়নি, উল্টো লোকসান ও ব্যাংকঋণে জর্জরিত বিপিসিকে ভর্তুকি দিয়েই টিকিয়ে রাখতে হয়েছে।
বিবিএসের তথ্য বলছে, লোকসানে থাকা বিপিসিকে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৬০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছিল সরকার। এর আগে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ২ হাজার ৪৭৮ কোটি, ২০১১-১২ অর্থবছরে ১৩ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা এবং ২০১০-১১ অর্থবছরে ৮ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা সরকারি ভর্তুকি পেয়েছিল সংস্থাটি।
এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, জ্বালানি তেলের দাম কিছুটা কমানোর পরও যেহেতু বিপিসি প্রচুর মুনাফা করছে, তাই এটা আরও কমানো উচিত। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এ মূল্য নির্ধারণ করা দরকার। পাশাপাশি স্বচ্ছ নিরীক্ষার মাধ্যমে বিপিসির মুনাফার প্রকৃত হিসাব বের করা উচিত। আর সে অর্থ বিপিসির কাছে না রেখে ব্যয় করতে হবে সরকারের উন্নয়ন খাতে।
বিপিসির পরিচালক (অর্থ) শঙ্কর প্রসাদ দেব গনমাধ্যমকে বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঋণ পরিশোধ করা হয়নি। এ ঋণ মওকুফে আবেদন করা হয়েছে। আর মুনাফার অর্থ বিভিন্ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করা হচ্ছে। তবে মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশ দেওয়া হলে সরকারের ঋণ পরিশোধ করা হবে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল আলম বলেন, বিপিসির যখন লোকসান হয়েছে, জনগণের অর্থে তাদের ভর্তুকি দেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম কমায় বিপিসি এখন মুনাফা করছে। এর অংশীদার জনগণ। কিন্তু তারা এর সুবিধা পাচ্ছে না। আবার পিডিবির লোকসানের অজুহাতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে। তাই বিপিসির মুনাফার অর্থে জ্বালানি উন্নয়ন তহবিল করে সেখানে জমা রাখা উচিত। পরে জ্বালানি খাতের উন্নয়নে সেটা ব্যয় করা যাবে।
প্রসঙ্গত, বিপিসি দেশের একমাত্র রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, যারা বিভিন্ন ধরনের অপরিশোধিত এবং পরিশোধিত তেল আমদানির মাধ্যমে নিজস্ব পরিশোধনাগারে পরিশোধন করে। পরিশোধিত জ্বালানি তেল রাষ্ট্রীয় বিতরণ কোম্পানির মাধ্যমে সারা দেশে বিপণন করে থাকে বিপিসি। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দামে ঊর্ধ্বগতির কারণে ২০১৩ সাল পর্যন্ত লোকসানে থাকলেও গত কয়েক বছর ধরে মুনাফায় সংস্থাটি।

http://www.dailysangram.com/post/286605-