হোসেন জিল্লুর রহমান
৪ জুন ২০১৭, রবিবার, ১০:২৩

বাজেট প্রতিক্রিয়া

প্রবৃদ্ধির আত্মতুষ্টি অর্থনীতিকে ঝুঁকিতে ফেলছে

মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধির কাগুজে অর্জনের আত্মতুষ্টি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বড় ধরনের ঝুঁকিতে ফেলছে। এরই মধ্যে তিন ধরনের বড় ঝুঁকি তৈরি হয়েছে অর্থনীতির জন্য। ঘোষিত বাজেট দেখে আমার কাছে মনে হয়েছে, প্রবৃদ্ধির একধরনের কাগুজে অর্জনের আত্মতুষ্টিতে ভুগছে দেশের বর্তমান নীতিনির্ধারক মহল। এ বাজেটে তারই প্রতিফলন ঘটেছে।

ঘোষিত বাজেটে প্রবৃদ্ধির জন্য যেসব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, সেগুলো অর্থনীতির বাস্তবতার সঙ্গে মেলানো যাচ্ছে না। কর্মসংস্থান, রপ্তানি, প্রবাসী আয়, ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ—সব কটির প্রবৃদ্ধির ধারা স্থবির অথবা নেতিবাচক। সেখানে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন দেখে মনে হচ্ছে, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা থেকে তুলে এনে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রাক্কলিত প্রবৃদ্ধি অর্জনের মতো কোনো নীতি-কৌশল এবারের বাজেটে নেই। তৈরি পোশাকসহ রপ্তানি খাত ও প্রবাসী আয় ছিল প্রবৃদ্ধির বড় চলক। কিন্তু এগুলো এখন স্থবির। প্রবৃদ্ধির স্থবির চলক দিয়ে কীভাবে উচ্চ প্রবৃদ্ধি সম্ভব, তার বাস্তবভিত্তিক কোনো কৌশল নেই।
অর্থনীতির জন্য এরই মধ্যে যে তিনটি বড় ঝুঁকি তৈরি হয়েছে সেগুলো হলো বিনিয়োগ স্থবিরতা, বাস্তবায়ন অদক্ষতা ও কর্মসংস্থানের খরা। দুর্নীতি ও ব্যবসার বৈরী পরিবেশের কারণে অর্থনীতিতে বিনিয়োগ স্থবিরতা তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন মেগা প্রকল্প ও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাস্তবায়ন অগ্রগতি থেকে বাস্তবায়নের অদক্ষতার চিত্র পাওয়া যায়। সবশেষে সরকারি হিসাবেই আমরা দেখছি কর্মসংস্থানের হার কমছে। এ সরকারের ২০১০-১৩ ও ২০১৪-১৬ সময়কালের কর্মসংস্থানের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাই, কর্মসংস্থানের হার আগের চেয়ে কমেছে।
ঘোষিত বাজেটকে উন্নয়ন মহাসড়কের সঙ্গে তুলনা করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। আমি মনে করি, এ মহাসড়কের তিনটি বিপজ্জনক ও ভয়াবহ খন্দক হচ্ছে বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও অদক্ষতা। সব সময়ই বাংলাদেশের অর্থনীতির একধরনের টেকসই গতিশীলতা আমরা দেখতে পাই। যেখানে সহজে প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক হয়ে যায় না। আমাদের অর্থনীতির জন্য এখন উত্তরণের সময়। যেখানে সত্যিকারের প্রবৃদ্ধি ঘটবে। বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান বাড়বে। কিন্তু সেই উত্তরণটি আসলে হচ্ছে না। এর বড় কারণ, প্রবৃদ্ধির কাগুজে অর্জনের আত্মতুষ্টির অহমিকা পেয়ে বসেছে শাসক গোষ্ঠীকে। এ অহমিকার কারণে প্রতিবছর অবাস্তবভাবে বাজেটের আকার বাড়ানো হচ্ছে। যার ফলে গত ২০১৩ সাল থেকে প্রাক্কলিত বাজেট ও প্রকৃত বাস্তবায়নের মধ্যে বড় ধরনের ফারাক দেখতে পাচ্ছি। প্রবৃদ্ধির আত্মতুষ্টির বড় কুফল হচ্ছে, বাজেটে একধরনের বাহাদুরির আকার দেখানো হচ্ছে। কিন্তু যেখানে হাত দেওয়া দরকার, সেটি করা হচ্ছে না।
বিনিয়োগ, বাস্তবায়ন অদক্ষতা ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সরকার বিশ্বাসযোগ্য ও দক্ষ কোনো নীতি-কৌশল দেখাতে পারছেন না। একধরনের দুষ্ট চক্র আমরা দেখতে পাচ্ছি। অবাস্তব প্রবৃদ্ধির কাগুজে আত্মতুষ্টির জন্য বড় বাজেট, বড় প্রকল্পমুখী হয়ে গেছে শাসক দল। যার কারণে অর্থের প্রয়োজন মেটাতে গিয়ে জনগণের ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করা হচ্ছে প্রতিবছর। যার জন্য ব্যাংকের আমানতের ওপর আবগারি শুল্কের অনৈতিক প্রস্তাব এবং ১৫ শতাংশ ভ্যাটের হার চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে সাধারণের ওপর।
আমি মনে করি, প্রবৃদ্ধির কাগুজে অর্জনের অহমিকা সার্বিকভাবে আমাদের অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারণকে ভুল পথে নিয়ে যাচ্ছে। যার কারণে যেখানে হাত দেওয়া খুব জরুরি, সেখানে হাত দেওয়া হচ্ছে না। ব্যাংক খাতের সংস্কারে কোনো উদ্যোগই দেখা যাচ্ছে না। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ব্যাংক খাতে সব সময়ই সব দেশেই কিছু চুরি হয়। অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্যও চরম অনৈতিক এক বক্তব্য। ব্যাংক খাতে শুধু চুরি না, সাগরচুরি হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি দুই ধরনের ব্যাংক থেকেই এ সাগরচুরির ঘটনা ঘটছে। সরকার এ চুরির ক্ষেত্রে একধরনের সহায়ক পরিবেশ তৈরি করেছে। আইন সংশোধন করে বেসরকারি ব্যাংকের ক্ষেত্রে পরিবারতন্ত্র নিশ্চিত করা হচ্ছে। সেটা চুরির পথকে আরও সুগম করবে। আর সরকারি ব্যাংকের লুটেরাদের আইনের আওতায় না এনে আবারও করের টাকায় মূলধন জোগানের জন্য ২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে এবারের বাজেটেও।
মেগা প্রকল্পের নামে মেগা খরচের পথ তৈরি করা হয়েছে। প্রকল্প খরচকে অযৌক্তিকভাবে বাড়ানো হয়েছে। এসবের ওপর কোনো নজরদারি নেই। অবকাঠামো নিয়ে শাসকগোষ্ঠী রীতিমতো বড়াই করছে। অথচ বড় অবকাঠামোর সুফল নিশ্চিত করতে যে ধরনের সুশাসন দরকার, তার ছিটেফোঁটাও নেই। এর জ্বলন্ত উদাহরণ হানিফ ফ্লাইওভার। বিপুল অর্থ খরচ করে ওপরে একটা বড় অবকাঠামো তৈরি করা হলেও অথচ ফ্লাইওভারটির নিচের রাস্তাটি ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। সার্বিকভাবে বললে অর্থনৈতিক সুশাসনের বড় ঘাটতি রয়েছে।
প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক আত্মতুষ্টির কারণে প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি, দারিদ্র্যের হার—এসব পরিসংখ্যানের মধ্যে রাজনীতি ঢুকে যাবে। এরই মধ্যে প্রবৃদ্ধির হারের মধ্যে একধরনের রাজনীতি ঢুকে গেছে। বাধ্য হয়ে উচ্চ প্রবৃদ্ধি, নিম্ন দারিদ্র্য ও নিম্ন মূল্যস্ফীতির পরিসংখ্যান দেখাবেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বেশ কিছু ভালো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বেশ কিছু ভাতা বাড়ানো হয়েছে। খাদ্য সহায়তার পাশাপাশি কিছু ক্ষেত্রে নগদ সহায়তাও দেওয়া হচ্ছে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে। তবে আমি মনে করি, প্রাথমিক বৃত্তির টাকার অঙ্কের পরিমাণটি বাড়ানো দরকার। ২০০৪ সালে এ বৃত্তির পরিমাণ ১০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল, এখনো তা-ই রয়ে গেছে।

http://www.prothom-alo.com/economy/article/1204506/