৪ জুন ২০১৭, রবিবার, ১০:২০

গ্যাস-বিদ্যুতে নাভিশ্বাস

‘অল্প সময়ের ব্যবধানে দুই দফায় গ্যাসের দাম বেড়েছে। শুনেছি বিদ্যুতের দামও বাড়াবে। এ অবস্থায় আমাদের মতো মধ্যবিত্তপরিবার ঢাকায় থাকাই কঠিন হয়ে পড়েছে। সব মিলে নাভিশ্বাস ওঠার অবস্থা। কথাগুলো বলছিলেন লিজা বেগম। পরিবার নিয়ে থাকেন পুরান ঢাকার গণকটুলি এলাকায়। তার স্বামী একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। শুধু লিজার পরিবারই নন, গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানোয় জীবনযাত্রা নিয়ে নানা ধরনের আশঙ্কা করছেন মধ্য ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষরা। তারা মনে করছেন, সরকারি এই সিদ্ধান্ত জীবনযাত্রার সব স্তরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এছাড়া প্রস্তাবিত বাজেটে বিদ্যুতে ১৫ শতাংশ ভ্যাটের প্রস্তাবে খুচরা পর্যায়ে ১০ শতাংশ বিল বাড়বে। শুধু গ্যাস আর বিদ্যুৎ খাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বাড়িভাড়া ও নিত্য খাদ্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে জীবনযাত্রা দুর্বিষহ করে তুলবে। গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই বেড়ে যায় শিল্পকারখানার উৎপাদন খরচ। ফলে বেড়ে যাবে উৎপাদিত পণ্যের দামও। এতে যেমন চাপ বাড়বে ব্যবসায়ীদের ওপর, তেমনি তা প্রভাব বিস্তার করবে ক্রেতা ও বাজারের ওপর। বাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিত্যপণ্যের দাম এমনিতেই ঊর্ধ্বমুখী। গ্যাসের দাম বাড়ায় রাজধানীতে চলাচল করতে যাতায়াত খরচও বাড়বে। এর ফলে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে বিরূপ প্রভাব পড়বে বলেও আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এদিকে, গ্যাসের দাম বৃদ্ধি করে গত ২৩শে ফেব্রুয়ারি গণবিজ্ঞপ্তি দেয় বিইআরসি (বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন)। গৃহস্থালি গ্যাসের দাম ১৯ মাসের ব্যবধানে বাড়ানো হয়। এ মূল্যহার গড়ে ২২ দশমিক ৭ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়। গ্যাসের মূল্য পুনঃনির্ধারণের ক্ষেত্রে গৃহস্থালিতে ব্যবহৃত গ্যাসে এক চুলায় সবচেয়ে বেশি মূল্য বাড়ানো হয়। যা দাম বৃদ্ধির আগের মূল্যের চেয়ে ৫০ শতাংশ বেশি। আর দুই চুলায় বৃদ্ধি পেয়েছে ৪৬ দশমিক ১৫ শতাংশ। আবাসিক গ্রাহকদের ১লা মার্চ থেকে এক চুলার জন্য মাসিক ৭৫০ টাকা এবং দুই চুলার জন্য ৮০০ টাকা দিতে হবে। আর দ্বিতীয় ধাপে ১লা জুন থেকে এক চুলার জন্য মাসিক ৯০০ টাকা এবং দুই চুলার জন্য ৯৫০ টাকা বিল দিতে হবে বলে জানানো হয়। আর যেসব আবাসিক গ্রাহকের মিটার আছে তাদের জুন মাস থেকে প্রতি ঘনমিটার গ্যাস ১১ টাকা ২০ পয়সা ধার্য করা হয়। পরে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) এই গণবিজ্ঞপ্তির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট আবেদন করে। শুনানি শেষে গত ২৮শে ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় ধাপে গ্যাসের দামবৃদ্ধির সিদ্ধান্তের কার্যকারিতা স্থগিত করেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে ‘আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে’ জারি করা ওই গণবিজ্ঞপ্তি কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না- তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন আদালত। এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান ও সচিবকে চার সপ্তাহের মধ্যে এই রুলের জবাব দিতে বলা হয়। গত ৩০শে মে গৃহস্থালি ও গাড়ির জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত গ্যাসের মূল্য দ্বিতীয় ধাপে বাড়ানোর সিদ্ধান্তের কার্যকারিতা স্থগিত করে হাইকোর্টের দেয়া আদেশের ওপর ৫ই জুন পর্যন্ত স্থগিতাদেশ দিয়েছেন চেম্বার আদালত। হাইকোর্টের ওই আদেশের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) করা লিভ টু আপিলের (আপিলের অনুমতির আবেদন) প্রাথমিক শুনানি শেষে চেম্বার বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন এই স্থগিতাদেশ দিয়ে বিষয়টি শুনানির জন্য আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে পাঠিয়ে দেন। চেম্বার আদালতের এই আদেশের ফলে ১লা জুন থেকে দ্বিতীয় দফায় গ্যাসের দামবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত কার্যকরে বাধা নেই বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা। 

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জাতীয় সংসদে বাজেট বক্তব্যে বলেছেন, গ্যাসের দাম নিয়ে নানা কথা উঠছে। ২০১৮ সালে গ্যাস আমদানি শুরু হলে গ্যাসের আন্তর্জাতিক দামে আমাদের তা কিনতে হবে। এজন্য গ্যাসের ওপর ধার্য বর্তমান করাদি যৌক্তিকীকরণ করা হবে। এর ফলে ইউনিটপ্রতি গ্যাসের দাম যে বাড়বে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে বিদ্যুৎ ব্যবহারে ভর্তুকি প্রদানের অনুরূপ নীতি অনুসরণ করে গ্যাসের দামও সমন্বয় করা হবে।
এদিকে গত ২৩শে ফেব্রুয়ারি নতুন করে গ্যাসের দাম বাড়ানোর একদিন পর রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছিলেন, গ?্যাসের দামটা একটু বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা বিদ্যুতের দামও সমন্বয় করতে চাই। তিনি বলেন, ভবিষ?্যতে সারা দেশে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ বিতরণ করার লক্ষে?্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। সুতরাং আমাদের অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করার মানসিকতাও থাকতে হবে।
সূত্র জানায়, বিইআরসি পাইকারি ও খুচরা গ্রাহক উভয়ক্ষেত্রেই বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছে। কোম্পানিগুলোর দেয়া প্রস্তাবের ভিত্তিতে এই প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। বিইআরসির কর্মকর্তারা প্রস্তাবগুলো যাচাই-বাছাই শেষ করেছেন। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) বিতরণ কোম্পানিগুলোর কাছে পাইকারি বিক্রির ক্ষেত্রে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম প্রায় ১৫ শতাংশ (৭২ পয়সা) বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। আর বিভিন্ন বিতরণ কোম্পানি খুচরা গ্রাহক পর্যায়ে ৮ থেকে ১২ শতাংশ হারে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। এর আগে ২০১০ সালের ১লা মার্চ থেকে ২০১৫ সালের ১লা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছয় বছরে পাইকারি পর্যায়ে ছয়বার এবং খুচরা গ্রাহক পর্যায়ে সাতবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। এখন দেশে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের গড় উৎপাদনমূল্য ৫ টাকা ৫৯ পয়সা। এর সঙ্গে সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যয় যুক্ত করে গ্রাহক পর্যায়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে গড় দাম পড়ে ৬ টাকা ৭৩ পয়সা। কোম্পানিগুলোর দেয়া প্রস্তাব অনুযায়ী দাম বাড়ানো হলে প্রতি ইউনিটের গড় দাম হবে ৭ টাকা ৭১ পয়সা। বিদ্যুতের দাম ছাড়াও দু-একটি বিতরণ কোম্পানি গ্রাহক পর্যায়ে ডিমান্ড চার্জ ও সার্ভিস চার্জ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে বলে বিইআরসি সূত্র জানায়। বর্তমানে প্রতিটি মিটারে প্রতি মাসে ৩০ টাকা করে ডিমান্ড চার্জ ও ১০ টাকা করে সার্ভিস চার্জ ধার্য আছে। এটা বাড়িয়ে যথাক্রমে ৪০ টাকা ও ২০ টাকা করার প্রস্তাব করেছে কোনো কোনো বিতরণ কোম্পানি। এখন আবার প্রস্তাবিত বাজেটে বিদ্যুতে ১৫ শতাংশ ভ্যাটের প্রস্তাবে খুচরা পর্যায়ে ১০ শতাংশ বিল বাড়বে। বর্তমানে ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিচ্ছে গ্রাহকরা। এতে বিইআরসিতে দেয়া বিদ্যুতে দাম বাড়ানোর প্রস্তাবে কিছুটা সমস্যা তৈরি হতে পারে। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা ড. এম শামসুল আলম বলেন, এখন বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কোনো যুক্তি তো নেই-ই, বরং দাম কমানোর সুযোগ আছে। বেশি দামের অর্থাৎ তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনই বাড়ানো হচ্ছে অপেক্ষাকৃতভাবে বেশি। আর সব বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ফার্নেস তেলের দাম বাজারদর অনুযায়ী করে দিলে উৎপাদন ব্যয় অনেকটা কমে আসত। তা-ও করা হয়নি বা হচ্ছে না। এম শামসুল আলমের মতে, পিডিবি বিদ্যুৎ উৎপাদন করলে অনেক রকম কর ও শুল্ক রেয়াতের বিধান রয়েছে। কিন্তু পিডিবিকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে না দিয়ে অন্য কোম্পানিকে দিয়ে করানো হচ্ছে। এতে বিভিন্ন শুল্ক ও কর হিসেবে ১৮ শতাংশ বেশি অর্থ ব্যয় হচ্ছে, যা শেষ পর্যন্ত গ্রাহকদের ঘাড়ে চাপানো হয়।
এ প্রসঙ্গে পিডিবি’র চেয়ারম্যান প্রকৌশলী খালেদ মাহমুদ বলেন, আমরা প্রস্তাবিত ভ্যাট নিয়ে উদ্বিগ্ন। যদি এটি বাস্তবায়িত হয় তাহলে আমরা সমস্যায় পড়বো। এ বিষয় নিয়ে বৈঠক করে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করবো। পিডিবি কর্মকর্তারা বলছেন, যদি ভ্যাট আরোপ করা হয়, এই টাকা সরাসরি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাবে চলে যাবে। সূত্র জানায়, ভ্যাটের মাধ্যমে সরকার বিদ্যুতের গ্রাহকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ৩ হাজার ১০০ কোটি পাবে। গ্রাহকদের এজন্য ইউনিটপ্রতি অতিরিক্ত দশমিক ৬৭ টাকা বেশি গুনতে হবে।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=68344&cat=2/-