৪ জুন ২০১৭, রবিবার, ১০:১৮

পানির জন্য হাহাকার

পানির জন্য হাহাকার তেজগাঁও মধ্য কুনিপাড়া এলাকায়। সারাদিন পানি নেই। গভীর রাতে পানি আসে। রোজার দিনে এমন অবস্থাকে কারবালার ময়দানের সঙ্গে তুলনা করেছেন এলাকার গৃহবধূ রুবি বেগম। তিনি বলেন, দেড় মাস ধরে মধ্য কুনিপাড়া এলাকায় পানি নাই। পানির অভাবে রান্না করা যাচ্ছে না। বাইরে থেকে কিনে ইফতার এবং রাতের খাবার খেতে হয়। গভীর রাতে যখন পানি আসে তখন সেহরির রান্না করে রাখতে হয়। তিনি বলেন, ঘরে ছোট বাচ্চারা সারাদিন পানির জন্য ছটপট করে। তাদের দোকান থেকে পানি কিনে এনে দেই। কয়েকদিন ধরে তীব্র গরমও পড়েছে। পানি না থাকার কারণে বাচ্চাদের গোসল, কাপড় ধোয়াসহ অন্যান্য কাজ করা যায় না। একই এলাকার বাসিন্দা সাদির হোসেন জানান, ইফতারের আগে ওয়াসার ছোট একটি গাড়ি এসে পানি দিয়ে যায়। কিন্তু এই এলাকার সবার চাহিদা মেটাতে অন্তত ৩০ গাড়ি পানির প্রয়োজন। তিনি বলেন, কিছুদিন ধরেই লক্ষ্য করছি এলাকার মহিলারা কলসি নিয়ে আশেপাশের বাড়িতে দৌড়াদৌড়ি করে। যে বাসায় পানি থাকে সেই বাসা থেকে পানি এনে অন্যরা কাজ সারে।

মিনারেল ওয়াটার দিয়ে রান্নার কাজ সারছেন নাখালপাড়ার বাসিন্দা আফরিন সুলতানা। পাঁচ তলার এই বাসার অন্যান্য ইউনিটের সদস্যরাও মিনারেল ওয়াটার দিয়ে কাজ সারেন। কিন্তু শুধু রান্নার কাজ সারলেও পানির অভাবে সংসারের অন্যান্য কাজ সারতে পারছেন না। আফরিন সুলতানা জানান, রমজানে সংসারের অনেক কাজ থাকে। গোসল, কাপড় ধোঁয়াসহ অন্যান্য কাজ দিনের বেলা করা যায় না। ওয়াসার পানি নিয়মিত দেয়া হয় না। যখন তারা পানি নিয়ে আসে তখন অনেক মানুষের ভিড় লেগে যায়। তাই পৃষ্ঠা ২০ কলাম ৪
আর পানি পাওয়া যায় না। তিনি বলেন, আগে যেমন তেমন, কিন্তু রমজানে পানির অভাবে বেশি কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এলাকার বাসিন্দারা ওয়াসার কাছে অভিযোগ করেছে। কোনো লাভ হচ্ছে না। নাখালপাড়ার আরেক গৃহিণী ফাতেমা বেগম বলেন, বাচ্চাদের জন্য বেশি সমস্যা হয়ে যাচ্ছে। পানি না থাকলে খাবারের পানি নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়। কারণ এই পানি ফুটিয়ে খাবারের পানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সারাদিন রোজা রেখে পানির জন্য দৌড়াদৌড়ি একদম সহ্য হয় না।
শুধু রুবি বেগম, সাদির হোসেন, আফরিন সুলতানা আর ফাতেমা বেগম নন। রাজধানীতে এখন পানি সংকটে ভুক্তভোগী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৩০ লাখের কাছাকাছি। গত কয়েকদিন নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ভুক্তভোগী এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে এ চিত্র পাওয়া যায়। নগরীর কমলাপুর, পূর্ব জুরাইন, জুরাইনের পূর্ব মুরাদনগর, মোহাম্মদপুর, শেখেরটেক, মিরপুর-১, মিরপুর-২, মিরপুর-১০, মিরপুর-১১ নাখালপাড়া বনফুল মোড়, শেওড়াপাড়া, সেনপাড়া, বালুঘাট, দক্ষিণখান, মধ্যবাড্ডা, নামাপাড়া, মধুবাগ, শান্তিবাগ, মতিঝিল, ফকিরাপুল, কুনিপাড়া, বেগুনবাড়ি, জিগাতলার হাজী আফসার উদ্দিন লেন, আজিমপুরের ছাপড়া মসজিদের গলি, লালবাগ, মাদারটেক, নন্দীপাড়া, শনির আখড়া, উত্তর কমলাপুর, মানিকনগর, শাহজাহানপুর, হাজারীবাগ, চামেলীবাগ, মগবাজার, নারিন্দা লাল মোহন সাহা সড়ক, গেণ্ডারিয়ার রজনী চৌধুরী সড়ক, আশকোনা, দক্ষিণখান, কালশি বাজার, উত্তর যাত্রাবাড়ী, শ্যামলী, আদাবর হাউজিং, দনিয়ার একে স্কুল এলাকা, রামপুরা, বনশ্রী, মেরুল আনন্দনগর, আফতাব নগর এলাকার বাসিন্দারা পানির জন্য হাহাকার করছেন। অনেক এলাকার বাসিন্দারা দোকানের কেনা পানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে গেছেন। এতে করে ভোগান্তির সঙ্গে ব্যয়ের পরিমাণ বেড়ে গেছে। বিভিন্ন এলাকার ভুক্তভোগী বাসিন্দারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন শুষ্ক মৌসুমে পানির সমস্যা থাকলে মেনে নেয়া যায়। শুষ্ক মৌসুম শেষ হয়ে বর্ষা শুরু হয়েছে কিন্তু এখনো পানির সমস্যা শেষ হচ্ছে না। উত্তরা তিন নম্বর সেক্টরের বাসিন্দা নুরুল হাসান জানান, গত দশ দিন ধরে এই এলাকায় পানি নেই। পানির জন্য সংসারের কাজকর্ম করা যাচ্ছে না। দোকানের পানির ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। আজিমপুরের ছাপড়া মসজিদ এলাকার সালেহা আক্তার জানান, সেই রাতের বেলা পানি আসে। কিন্তু বেশি সময় স্থায়ী হয় না। যারা পানি সংরক্ষণ করে রাখতে পারেন তাদের দিনের বেলা তেমন সমস্যা হয় না। মিরপুরের কালসী থেকে পুরবী এলাকায় ৯ দিন ধরে পানি না থাকার কারণে এ এলাকার মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই। মোহাম্মদপুর শেখেরটেক এলাকায় ১০ দিন ধরে পানির অভাব। এলাকার বাসিন্দা আলম জানান, গরমকালে যদি পানির স্বল্পতা থাকে তবে কোনো কাজই শান্তিতে করা যায় না। কর্র্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করে কোনো কাজ হয় না। মেরুল আনন্দনগর ও আফতাবনগর এলাকায় সাতদিন ধরে পানি আসে না। মধ্য বাড্ডার নামাপাড়ায় এক সপ্তাহ ধরে পানির দেখা নেই। মিরপুর-১ এলাকায় ১৫ দিন, কালশি বাজারে ১৪ দিন ধরে পানির সংকট চলছে।
যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা আলেয়া জানান, দুই সপ্তাহ ধরে পানি না থাকায় দুর্ভোগের সীমা নেই। দিনে যে পরিমাণ পানি দরকার তার চার ভাগের এক ভাগ পানি পাওয়া যায় না। সংসারের এতো কাজ সারা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। কয়েকদিনের প্রচণ্ড গরম। তার ওপর যদি আবার পানি না থাকে তবে অনেক সমস্যা হয়। মোহাম্মদপুরের সোহেল জানান, ১২ দিন ধরে পানি নেই। রাতেরবেলা যে পানি আসে তা দিয়েই পরিবারের সদস্যরা কোনোভাবে কাজ চালায়। আর খাবারের পানি দোকান থেকে কিনে আনা হয়। কমলাপুরের সুফিয়া জানান, লাইনে পানি আসে না। টানা পানি দিয়েই চলতে হয়। ভাড়াটিয়ারা পানির জন্য ঝামেলা বাধায়। কিন্তু তারা বুঝে না। লাইনে যদি পানি না আসে তবে কিভাবে বাড়ির মালিকরা পানি দেবে। মধুবাগের স্বপন জানান, মাসখানেক ধরেই পানির সমস্যা চলছে। আশেপাশের কিছু বাড়িতে পানি পাওয়া যায়। সেখান থেকেই অল্প অল্প পানি এনে ঘরের মহিলারা কাজ সারছেন। অনেক দিন হয়ে যাওয়ায় এখন অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। মধ্য বাড্ডার আকাশ আব্দুলাহ জানান, তিনি চার দিন ধরে সেহরিতে নুডুলস খাচ্ছেন। কারণ ১৩ দিন ধরে এই এলাকায় পানি নেই। পানির অভাবে রান্না করা সম্ভব হচ্ছে না। মগবাজারের বাসিন্দা হালিমা বেগম জানান, পানি সময় সময় আসে। আর যখন পানি আসে সে পানিতে গন্ধ থাকে। ওয়াসা বলছে, ঢাকায় পানির চাহিদা ২৩৫ লিটার। কিন্তু তাদের উৎপাদন ক্ষমতা আছে ২৪৫ লিটার। তবে লোডশোডিং আর কিছু জায়গায় লাইনে কাজের কারণে পানির সমস্যা হচ্ছে।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=68255&cat=6/