৪ জুন ২০১৭, রবিবার, ১০:১৬

বাজেটে শিক্ষায় শুভঙ্করের ফাঁকি

শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে এবার বাজেটে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ রাখা হলেও শিক্ষা খাতে শুভঙ্করের ফাঁকি দেয়া হয়েছে। গত বছর শিক্ষা খাতে মোট বাজেটের ১১ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হলেও এ বছর তা কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে। বাজেটের আকার বড় হওয়ায় অর্থ বৃদ্ধি পেলেও শতাংশে তা কমেছে। দেশে দক্ষ মানব সম্পদ গড়ে তুলতে হলে শিক্ষার বাজেট আরও বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন শিক্ষাবিদরা। তারা বলেন, শিক্ষাক্ষেত্রে এখন চ্যালেঞ্জ হলো মান বৃদ্ধি করা। বিশেষ করে মাধ্যমিক শিক্ষায় এ চ্যালেঞ্জ আরও বেশি। মান বৃদ্ধি করতে হলে শিক্ষার বাজেট অবশ্যই বাড়াতে হবে। না হয়, এসডিজি থেকে মুথ থুবড়ে পড়বে বাংলাদেশ। বাজেটে সামগ্রিক ব্যয় কাঠামো (উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন) বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগে বরাদ্দ কিছু বাড়লেও শতাংশে তা কমেছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতেও (এডিপি) কোনো কোনো ক্ষেত্রে বরাদ্দ কমেছে বা একই আছে। নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৫০ হাজার ৪৩২ কোটি টাকা; যা মোট বাজেটের প্রায় ১৪ শতাংশ।

শিক্ষাবিদ এবং গবেষকরা বলছেন, এ অর্থ শিক্ষা খাত এগিয়ে নেয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। বিদায়ী অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ছিল ৫৩ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা, সংশোধিত বাজেটে পরে তা কমে দাঁড়ায় ৪৪ হাজার ২৬০ কোটি টাকায়। আসন্ন অর্থবছরে বাজেটের আকার বাড়লেও তুলনামূলকভাবে কমেছে শিক্ষায় বরাদ্দ। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, তাদের পক্ষ থেকে এবার বরাদ্দের চাহিদা ছিল ৪৬ হাজার কোটি টাকা। সে হিসেবে প্রস্তাবিত বাজেটে চার হাজার কোটি টাকা বেশি বরাদ্দের প্রস্তাব ছিল। বিদায়ী অর্থবছরেও চাহিদার চেয়ে বেশি বরাদ্দ পেয়েছে এসব মন্ত্রণালয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চাহিদা ছিল ২৩০০০ কোটি এবং বাজেট প্রস্তাব ২৮৪১০ কোটি। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা চাহিদা ২৩০০০ কোটি এবং বাজেট প্রস্তাব ২২০২২ কোটি।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক সিদ্দিকুর রহমান বলেন, শিক্ষার বাজেট বেড়েছে এটা সত্য, তবে শতাংশের হিসাবে তা কমেছে। এটাকে আমি শুভঙ্করের ফাঁকি বলব। তিনি বলেন, এবারের বাজেটে স্লোগান দেয়া হয়েছে, ‘উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ’। এ স্লোগানকে সত্যিকার অর্থে রূপান্তিত করতে হলে দক্ষ মানব সম্পদের বিকল্প নেই। এটা করতে হলে শিক্ষায় বাজেট বাড়াতে হবে। কারণ বাজেট ছাড়া দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলা সম্ভব না। তিনি বলেন, গত কয়েক দশকে শিক্ষার বিস্তৃতি বাড়লেও বাজেটে বিস্তৃতি বাড়েনি।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, দেশের শিক্ষাখাতে প্রকৃত চাহিদা কত সে বিষয়ে সরকারি পর্যায়ে কোনো গবেষণা নেই। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোও নির্ভর করছে ইউনেস্কো ঘোষিত মানদণ্ডের ওপর যাতে জিডিপির ৪ থেকে ৬ শতাংশ শিক্ষায় ব্যয়ের কথা বলা হয়েছে। এ বিষয়ে সিপিডি ফেলো ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ইউনেস্কোর এডিবির ৪ থেকে ৬ শতাংশ ব্যবহারের কথা বলা হলেও আমরা ব্যবহার করছে মাত্র আড়াই শতাংশ। এটা কীভাবে ৪ ভাগে নেয়ার যায় সেই চেষ্টা করতে হবে। সেজন্য শিক্ষায় অর্থায়ন বাড়াতে হবে রাষ্ট্রের প্রয়োজনে।
বুয়েটের অধ্যাপক ও শিক্ষাবিদ ড. কায়কোবাদ বলেন, বিশাল জনগোষ্ঠীকে যদি শিক্ষা ও প্রযুক্তি দিয়ে দক্ষ মানব সম্পদে রূপান্তর করা যায়, তবেই আমাদের যে আশা-আকাঙ্ক্ষা মধ্য ও উন্নত দেশ হওয়া সেটা সফল হবে। ধীরে ধীরে অন্যান্য খাত থেকে কেটে এনে বাজেটে শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়াতে হবে। না হয় মাঝখান থেকে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাবে। কারণ, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় মানসম্মত শিক্ষার কথা বলা হয়েছে। শিক্ষার মান রক্ষা করতে হলে অবশ্যই অর্থ বাড়াতে হবে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক শিক্ষা উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, শিক্ষাক্ষেত্রে এখন চ্যালেঞ্জ হলো মান বৃদ্ধি করা। বিশেষ করে মাধ্যমিক শিক্ষায় এ চ্যালেঞ্জ আরো বেশি। এজন্য জোরালো পদক্ষেপ না থাকলে যা ছিল তা-ই হতে থাকবে। মানের জন্য বড় উদ্যোগ দরকার ছিল। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে সেই উদ্যোগ অনুপস্থিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বলেন, প্রতি বছর বাজেটে আকার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার বরাদ্দ বাড়ে। এটা কিন্তু আসলে প্রকৃত চিত্র হওয়ার কথা নয়। তিনি বলেন, মোট বাজেটের কত শতাংশ শিক্ষার জন্য রাখা হয়েছে বা ব্যয় করা হচ্ছে সেই হিসেবে আমাদের করতে হবে। শিক্ষার বাজেট বাড়ানো ছাড়া মধ্যম আর উন্নত দেশ হওয়ার যে স্বপ্ন, তা পূরণ হবে না। একই সঙ্গে শিক্ষা বাজেটের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এদিকে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ নিজেও শিক্ষার বাজেট নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে বলেন, প্রয়োজন মোতাবেক বরাদ্দ পাওয়া যাচ্ছে না। গতকাল রাজধানীর একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, গত বছর শিক্ষাখাতে মোট বাজেটের ১১ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। এ বছর তা কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, মাধ্যমিক শিক্ষাই এখন সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছে। এ স্তরে শিক্ষকের যেমন সংকট, তেমনি ঝরে পড়ার হার বেশি। এ স্তরের মানও বেশি প্রশ্নবিদ্ধ। অবশ্য বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেছেন, মাধ্যমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে পাঁচ বছর মেয়াদি ‘মাধ্যমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি’ হাতে নেয়া হচ্ছে। এতে সম্ভাব্য বিনিয়োগ হবে প্রায় ১৮ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

http://www.mzamin.com/article.php?mzamin=68244&cat=6/