৪ জুন ২০১৭, রবিবার, ১০:১০

আজ বিশ্ব শিশু দিবস

বাড়ছে শিশু নির্যাতন বাড়ছে পৈশাচিকতা

ঢাকা মেডিকেল কলেজের ইমার্জেন্সি বিভাগের পাশ দিয়ে দোতলায় উঠতেই কানে ভেসে আসে এক শিশু ও তার মায়ের আর্তনাদ। সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখা মিলল ১২ থেকে ১৩ বছর বয়সী মেয়েকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ষাটোর্ধ্ব এক মহিলা। কি হয়েছে জিজ্ঞাসা করতেই পাশ থেকে তার স্বামী জানালেন, ‘কিছুদিন ধরে জ্বরে ভুগছে মেয়েটি। জ্বরের প্রভাবে মাঝে মাঝে জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে। এজন্য ডাক্তারের কাছে এসেছি।’ সন্দেহ হওয়ায় কৌশলে মহিলার কাছে জানতে চাইলে বেরিয়ে আসে আসল ঘটনা। বৃহস্পতিবার ঢাকা মেডিকেল কলেজের ২০৩নং ওয়ার্ডের সামনে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা হয় তাদের সঙ্গে। ওই মহিলা যুগান্তরকে জানান, অসুস্থ মেয়েটি আমার স্বামীর বোন। দু’দিন আগে রাতের আঁধারে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। একদিন পর আবার তারা মেয়েটিকে বাড়ির পাশে ফেলে রেখে যায়। এরপর থেকে সে কিছু সময় পরপর জ্ঞান হারিয়ে ফেলছে। মেয়েটির মুখ এবং শরীরের বিভিন্ন স্থানে নির্যাতনের চিহ্ন দেখা গেছে। তিনি বলেন, কার বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নেব? তাছাড়া মেয়েকে তো বিয়ে দিতে হবে।


বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম (বিএসএএফ) শিশু অধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০১৬ সালে ৩ হাজার ৫৮৯টি শিশু সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। যাদের মধ্যে ১ হাজার ৪৪১টি শিশু অপমৃত্যুর শিকার। যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৬৮৬ শিশু। সংস্থাটি ৬টি ক্যাটাগরিতে শিশুর প্রতি নির্যাতন ও সহিংসতার চিত্র তুলে ধরে। প্রতিবেদনে ৬৪ শিশু বাবা-মায়ের হাতে খুন হয়েছে। সে হিসেবে গড়ে প্রতি মাসে ৫টি শিশু এ নির্মমতার শিকার হচ্ছে।

বিগত বছরগুলোতে নির্যাতনের চিত্র : নারী ও শিশু মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে ২০১৬ সালে এক হাজারেরও বেশি নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। সংগঠনটি নারীদের ওপর নির্যাতনের এমন নির্মম ও নিষ্ঠুর ধরনকে উদ্বেগজনক বলে বর্ণনা করেছে। সংস্থাটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৬৬ জন, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৪৪ জনকে। এছাড়া ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ১৬৫ জনকে। গৃহপরিচারিকা নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৬৩ জন, তার মধ্যে হত্যা করা হয়েছে ২৫ জনকে এবং নির্যাতনের কারণে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছে ৭ জন। মানবাধিকার ও আইন সহায়তাকারী বেসরকারি সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে ৭২৪টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৬ বছরের কম বয়সী শিশু ৬২ জন, ৭ থেকে ১২ বছর বয়সী ১৭৮ জন এবং ১৩ থেকে আঠারো বছর বয়সীর সংখ্যা ২৫১ জন। অর্থাৎ ধর্ষণের শিকার হওয়া প্রায় সবাই অপ্রাপ্তবয়স্ক। আসকের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ১৬ মার্চ পযন্ত মোট ২৭ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। যাদের ২০ জনই অপ্রাপ্তবয়স্ক।

উল্লেখযোগ্য শিশু নির্যাতনের চিত্র : মোবাইল চুরির অভিযোগ এনে সিলেটে শিশু শেখ সামিউল আলম রাজন (১৪) হত্যা এবং খুলনায় শিশু রাকিব হত্যা দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে। রাজন হত্যা মামলার রায়ে ২ জনকে ফাঁসির আদেশ দেয় আদালত। রায়ে প্রধান আসামি কামরুলসহ চারজনকে ফাঁসি ও সাতজনকে সাত বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়। শিশু রাকিবকে হত্যার পরের দিন রাকিবের বাবা নুরুল আলম বাদী হয়ে শরীফ, শরীফের সহযোগী মিন্টু খান ও মা বিউটি বেগমের বিরুদ্ধে মামলা করেন। গত বছরের ৮ নভেম্বর প্রধান আসামি শরীফ ও তার সহযোগী মিন্টুকে ফাঁসির আদেশ দেন আদালত। এছাড়া একই বছরের ৬ সেপ্টেম্বর ক্রিকেটার শাহাদাতের স্ত্রীর বিরুদ্ধে ১১ বছর বয়সী গৃহকর্মী নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে। ওই গৃহকর্মীকে উদ্ধারের সময় তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে নির্যাতনের চিহ্ন ছিল। ২০১৫ সালের ১৯ আগস্ট সাতক্ষীরা সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের বাসা থেকে নির্যাতিত শিশুকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ। বংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম যুগান্তরকে বলেন, প্রথমত শিশুর প্রতি তার বাবা-মাকে বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে। সমাজে শিশুদের যে অধিকার রয়েছে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমানে শিশু নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, পাঁচ-ছয় বছরের শিশুকে ষাটোর্ধ্ব পুরুষ নির্যাতন করছে। যেটা চরম অমানবিক এবং অস্বাভাবিক।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, আইনের শাসন না থাকায় নৈতিক মূল্যবোধ দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। যার কারণে শিশু নির্যাতনের হার বেড়ে যাচ্ছে। নানামুখী চাপের কারণে শিশুরা তাদের বাবা-মা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। শিশু নির্যাতন কিভাবে বন্ধ করা যায় এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এজন্য দরকার প্রাথমিক শিক্ষায় পরিবর্তন আনা। এটা করতে পারলে শিশু নির্যাতন অনেকাংশে কমে যাবে।

http://www.jugantor.com/news/2017/06/04/129754/