৩ জুন ২০১৭, শনিবার, ১০:৫৭

ভ্যাট অব্যাহতি অচেনা পণ্যে

মানুষকে বোকা বানানোর প্যাঁচ ভালোই দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। অপ্রয়োজনীয় পণ্যের লম্বা তালিকা যোগ করে ভ্যাট অব্যাহতির পণ্যসংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে বাহবা কুড়ানোর চেষ্টা করেছেন তিনি। কিন্তু অব্যাহতির তালিকায় এমন অনেক পণ্যের নাম ঢোকানো হয়েছে যেগুলো এ দেশের অনেক মানুষেরই জীবদ্দশায় একবারও দরকার পড়ে না। ঘোড়া, গাধা, খচ্চর বা ঘোটকের মাংসে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। আমদানি ও সরবরাহ পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে শূকরের মেদবিহীন মাংসে। বাদাম, চিনাবাদামের ক্ষেত্রেও অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে ভ্যাট। দেশের সাধারণ মানুষের জীবনে এসব পণ্যের প্রয়োজনীয়তা কতটা সে প্রশ্ন এখন প্রায় সবার মুখে মুখে। অন্যদিকে ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বসানো সাবান, শ্যাম্পু, শেভিং আইটেম, মশার কয়েল, অ্যারোসলের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় অনেক পণ্য অব্যাহতির তালিকায় রাখা হয়নি। ফলে সাধারণ মানুষকে ভ্যাট থেকে বাঁচানোর যে চেষ্টার কথা প্রস্তাবিত বাজেটে বলা হয়েছে, বাস্তবে তাতে শুভংকরের ফাঁকি রয়েছে। 

কেবল ভ্যাটেই নয়, নির্বাচনের আগের বছরে অর্থমন্ত্রী জনগণের ওপর ঘন করজাল ফেলেছেন, যেখান থেকে চুনোপুঁটিদের রক্ষা পাওয়ার উপায় নেই। নিম্ন-মধ্যম আয়ের মানুষও ছাড় পাবে না করের জাল থেকে। তবে সমাজের উচ্চবিত্তসহ রাঘব বোয়ালদের আটকানোর কোনো চেষ্টা লক্ষ করা যায় না প্রস্তাবিত বাজেটে। অর্থমন্ত্রী বাড়তি টাকা আদায় করতে চাইছেন অন্য পেশাজীবীদের কাছ থেকে। ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেসব ছেলে-মেয়েরা পড়ে, তাদের প্রতি কোনো বিদ্বেষ না থাকলেও নানাভাবে ওই সব শিশুর অভিভাবকের কাছ থেকে বাড়তি টাকা নেওয়ার জোরালো চেষ্টা আছে। নিম্ন মধ্যবিত্ত ও উঠতি মধ্যবিত্তদের আটকানোর সব চেষ্টার কথা দেড় শ পৃষ্ঠার বাজেট বক্তৃতায় আড়াল করেছেন অর্থমন্ত্রী। গত বৃহস্পতিবার সংসদ সদস্যদের (এমপি) মধ্যে ‘অর্থ আইন ২০১৭’-এর যে কপি বিতরণ করা হয়েছে, তাতে সুকৌশলে তুলে ধরা হয়েছে করজাল ফেলার কৌশল।
ভ্যাট অব্যাহতির ঘোষণায় শুভংকরের ফাঁকি : ভ্যাট অব্যাহতির ঘোষণা দিতে গিয়ে বাজেট বক্তব্যে অনেক বেশি মানবিক হওয়ার চেষ্টা করেছেন অর্থমন্ত্রী। তিনি বলেছেন, বিদ্যমান ১৯৯১ সালের আইনে মাত্র ৫৩৬টি পণ্যে ভ্যাট অব্যাহতি ছিল। নতুন আইন কার্যকর করতে গিয়ে ওই সংখ্যা বাড়িয়ে এক হাজার ৪৩ করা হয়েছে। চাল, ডাল, মুড়ি, চিঁড়া, চিনি ও আঁখের গুড়, মাছ, মাংস, শাক-সবজি, তরল দুধ, প্রাকৃতিক মধু, বার্লি, ভুট্টা, গম ও ভুট্টার তৈরি সুজি, লবণসহ ৫৪৯টি পণ্যে ভ্যাট অব্যাহতির প্রস্তাব করেছেন তিনি। তবে প্রতিটি সবজিকে এখানে একেকটি পণ্য হিসেবে ধরা হয়েছে। ৯৩ ধরনের জীবনরক্ষাকারী ওষুধ, গণপরিবহন সেবা, জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবা, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ওপর ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। কৃষি, গবাদি পশু ও মৎস্য চাষ খাতের প্রায় ৪০৪টি ক্ষেত্রে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। একেকটি কীটনাশক, আগাছানাশক ও ছত্রাকনাশককে একেকটি পণ্য হিসেবে ধরে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া পণ্যের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু ভ্যাট অব্যাহতির তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এতে প্রয়োজনীয় পণ্যের সংখ্যা খুবই কম।
অর্থমন্ত্রী যেসব পণ্যকে মৌলিক খাদ্য তালিকায় ফেলে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা দেওয়ার কথা বলেছেন সেসবের মধ্যে রয়েছে জীবন্ত ঘোড়া, গাধা, খচ্চর ও ঘোটক, জীবন্ত গবাদিপশু, জীবন্ত ছাগল, ভেড়া, পাতি হাঁস, হংসী, টার্কিসহ বিভিন্ন জীবন্ত পক্ষি, হাঁস-মুরগির মাংস বা নাড়ি-ভুঁড়ি। অব্যাহতির তালিকায় শূকরের মাংসকেই একাধিক পণ্য হিসেবে দেখানো হয়েছে। যেমন—একস্থানে বলা হয়েছে ‘শূকরের মাংস, তাজা, ঠাণ্ডা অথবা হিমায়িত (২.৫ কেজি পর্যন্ত মোড়ক বা টিনজাত ব্যতিত)’, আরেক স্থানে বলা হয়েছে ‘শূকরের মেদবিহীন মাংস অথবা গৃহপালিত পক্ষিগুলোর মেদ (গলানো নহে) তাজা, ঠাণ্ডা, হিমায়িত, লবণাক্ত, শুকনা বা ধূমায়িত (২.৫ কেজি পর্যন্ত মোড়ক বা টিনজাত ব্যতিত)’। আমদানি ও সরবরাহ উভয় পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতির তালিকায় রাখা হয়েছে ২.৫ কেজি পর্যন্ত মোড়ক বা টিনজাত ব্যতিত কাঁটা ছাড়ানো মাছ এবং মাছের অন্যান্য মাংস (কিমাকৃত হোক বা না হোক) তাজা, ঠাণ্ডা বা হিমায়িত।
ভ্যাট অব্যাহতির তালিকায় রাখা হয়েছে মাছের গুঁড়া, যা সাধারণের কাছে অপরিচিত একটি পণ্য। শামুক ও কাকড়া বাদে জলজ অমেরুদণ্ডী প্রাণী আমদানি-সরবরাহ পর্যায়েও এ সুবিধা রাখা হয়েছে। বাঁধাকপি, ফুলকপি, টমেটো, আলুর মতো সবজি খোলা বিক্রি হয় অলিতে-গলিতে। এসব পণ্যে ভ্যাট বসানো সম্ভব নয় বলে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এইচএস কোড অনুযায়ী একেকটি সবজিকে একেকটি পণ্য হিসেবে গণনা করে অব্যাহতিপ্রাপ্ত পণ্যের তালিকা লম্বা করা হয়েছে মাত্র। তবে সবজির তালিকায় আজগুবি পণ্যও রাখা হয়েছে। এসবের মধ্যে রয়েছে শুকনা শাক-সবজি, জেরুজালেম ডাঁটাগাছ, সাগু তরুমজ্জা, ডুমুর ও গাব। মসলায় আড়াই কেজি পর্যন্ত ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হলেও সম্পূরক শুল্ক বসানো হয়েছে। ফলে দাম বাড়িয়ে ভ্যাট অব্যাহতি দিয়ে ক্রেতাদের বোকা বানানোর চেষ্টা রয়েছে ভ্যাট আইনে। তবুও এমন সব মসলা রয়েছে অব্যাহতির তালিকায়, যার নাম সাধারণের কাছে অপরিচিত। এসবের মধ্যে রয়েছে ফেনেল, জুনিপার, থাইম, জই, বাজরা, ক্যানারাই বীজ, চীনাবাদাম। আরো কিছু পণ্য রয়েছে অব্যাহতির তালিকায়, যা এ দেশে কেউ কেনে কি না সে নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে; যেমন—সামুদ্রিক আগাছা, লেকোস্ট সিম ইত্যাদি।
আমদানি ও সরবরাহ পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতির তালিকায় রাখা হয়েছে কন্দ, কন্দযুক্ত মূল, করসম, ক্রাউন্স, জীবন্ত উদ্ভিদ, প্রাকৃতিক গাম, রজন ও সুগন্ধ বৃক্ষ নির্যাস, শাকসবজির রস, জালি কাঠ, গুঁড়ি, গাছের ডাল, কাঠের গুঁড়ি ও কাঠের বর্জ্য, অমসৃণ কাঠ, গাছের ছাল, চেরাই কাঠ। প্রস্তাবিত বাজেটে সব ধরনের শস্য ও সবজি বীজ, ফলের বীজকে একেকটি পণ্য হিসেবে ধরে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এ তালিকায় রাখা রয়েছে খাদ্যশস্যের খড়কুটা ও খোসা, পশুখাদ্যের জন্য ব্যবহৃত গাছের মূল, চীনাবাদামের খৈল, তুলা বীজের খৈল, তিসির খৈল, সূর্যমুখীর খৈল, সরিষার খৈলসহ বিভিন্ন বীজের খৈলকে একেকটি পণ্য হিসেবে দেখানো হয়েছে। অব্যাহতির তালিকায় আছে উদ্ভিদের ভুসি, তুষ এবং পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত সবজির অবশিষ্টাংশও।
প্রয়োজনীয় পণ্যে সুবিধা না দিয়ে মানুষের জীবদ্দশায় একবারও দরকার হয় না—এমন পণ্যে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা দিয়ে তালিকা লম্বা করার কারণ কালের কণ্ঠ’র পক্ষ থেকে জানতে চাইলে গতকাল সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী কোনো উত্তর দেননি। সেখানে উপস্থিত এনবিআর চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমানও এ প্রসঙ্গে কিছু বলেননি।
ফি, চার্জ, কমিশন ও সম্মানীতে কর বেড়েছে : বিভিন্ন পেশার মানুষ নানা কাজ করে যে সেবা ফি, চার্জ বা কমিশন পায়, তার ওপর ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটে আরোপ করা উেস কর চলতি অর্থবছরে অপরিবর্তিত রাখা হয়। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার সংসদে এমপিদের মধ্যে বিতরণ করা অর্থ আইনে দেখা গেছে, ওই সব সেবা ফি, চার্জ ও কমিশনের ওপর কর বাড়ানো হয়েছে। নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বলা হয়েছে, ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিলের ওপর ১০ শতাংশ এবং ২৫ লাখের বেশি হলে ১২ শতাংশ হারে উেস কর দিতে হবে। অন্যান্য প্রফেশনাল সার্ভিস, টেকনিক্যাল সার্ভিস ফি বা টেকনিক্যাল অ্যাসিসট্যান্স ফির ওপরও একইভাবে ২৫ লাখ পর্যন্ত ১০ শতাংশ এবং ২৫ লাখের বেশি হলে ১২ শতাংশ হারে উেস কর আরোপ করা হয়েছে। ক্যাটারিং সার্ভিসের ওপর এখন ১০ শতাংশ উেস কর আরোপ আছে।
প্রশিক্ষণ, কর্মশালায় ক্লাস নিয়ে যে ফি বা সম্মানী মিলবে আগামী অর্থবছরের বাজেটে সেগুলোকেও উেস করের আওতায় আনা হয়েছে। এ ধরনের ফি বা সম্মানী দেওয়ার সময়ই উেস কর কর্তন করে রাখবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। এ ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ, কর্মশালা, অর্গানাইজেশন ও ম্যানেজমেন্ট সার্ভিসের কমিশন বা ফি ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত হলে ১০ শতাংশ ও তার বেশি হলে ১২ শতাংশ হারে উেস কর দিতে হবে। এ ছাড়া মোট বিলের পরিমাণ ২৫ লাখ পর্যন্ত হলে দেড় শতাংশ ও তার বেশি হলে ২ শতাংশ হারে কর কর্তন করা হবে। চলতি অর্থবছরে মিটিং ফি, ট্রেনিং ফি ও সম্মানীর পরিমাণ যাই হোক না কেন, তার ওপর ১০ শতাংশ উেস কর রয়েছে। নতুন বাজেটে এ ক্ষেত্রেও ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ১০ শতাংশ এবং তার ওপরে হলে ১২ শতাংশ উেস কর আরোপ করা হয়েছে।
ব্যাংকে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত আমানত রাখা হলে তার মুনাফার ওপর ১০ শতাংশ এবং আমানতের পরিমাণ ২৫ লাখের বেশি হলে তার মুনাফার ওপর ১২ শতাংশ হারে উেস কর বহাল রাখা হয়েছে এবারও।
আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ইন্ডেন্টিং এজেন্টের কমিশনের ওপর এখন ৭.৫ শতাংশ উেস কর রয়েছে। এটি পরিবর্তন করে ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত কমিশনে ৬ শতাংশ এবং তার বেশি হলে ৮ শতাংশ ধরা হয়েছে উেস কর। মোবাইল নেটওয়ার্ক অপারেটর এবং মোবাইল ব্যাংকিং পরিচালনাকারীদের ওপর থাকা ১০ শতাংশ উেস কর বহাল রাখা হয়েছে সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত। তবে ২৫ লাখের বেশি হলে ১২ শতাংশ গুনতে হবে এবার থেকে। একই অবস্থা ক্রেডিং রেটিং সার্ভিসের ক্ষেত্রেও।
মালিকরা গাড়ি মেরামত করার জন্য গ্যারেজে যে বিল দেন, তার ওপর চলতি অর্থবছরে ৫ শতাংশ হারে উেস কর আছে। অর্থাৎ, ১০০ টাকা বিল হলে সেখান থেকে সরকার নিত ৫ টাকা। এখন ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিলের ক্ষেত্রে সরকার নেবে ৬ শতাংশ, বিল ২৫ লাখের বেশি হলে নেবে ৮ শতাংশ হারে। প্রাইভেট কনটেইনার পোর্টের ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ উেস কর আছে। নতুন অর্থবছরে তা বাড়িয়ে ২৫ লাখ পর্যন্ত ৬ শতাংশ এবং তার বেশি হলে ৮ শতাংশ আরোপ করা হয়েছে। একই চিত্র শিপিং এজেন্সি কমিশনেও।
চলতি অর্থবছর ট্রান্সপোর্ট সার্ভিসের ওপর ৩ শতাংশ হারে উেস কর আরোপ রয়েছে। নতুন বাজেটে ট্রান্সপোর্ট সার্ভিসের সঙ্গে ক্যারিং সার্ভিস ও গাড়িভাড়া যুক্ত করে বলা হয়েছে, এসব খাত থেকে আয় ২৫ লাখ টাকা পর্যন্ত হলে প্রতি ১০০ টাকায় তিন টাকা এবং তার বেশি হলে ৪ টাকা করে কাটা হবে।
ব্যাংকের টাকা কর্তনে দুরকম তথ্য : ব্যাংকে টাকা জমা বা তোলার ওপর আবগারি শুল্কের হার নিয়ে দুই রকম তথ্য পাওয়া গেছে। অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তব্যে যা বলেছেন, অর্থ আইনে বলা হয়েছে ভিন্ন কথা। ‘এক্সাইজ অ্যান্ড সল্ট অ্যাক্ট ১৯৪৪’-এর ই০৩২.০০-তে ব্যাংকে লেনদেনের ওপর আবগারি শুল্ক বসানোর কথা রয়েছে। অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তব্যে বলেছেন, এক লাখ টাকা পর্যন্ত শুল্কমুক্ত। এক লাখ এক টাকা থেকে ১০ লাখ পর্যন্ত আবগারি শুল্ক ৫০০ টাকার বদলে ৮০০ টাকা, ১০ লাখ টাকার ঊর্ধ্বে এক কোটি পর্যন্ত দেড় হাজার টাকার পরিবর্তে আড়াই হাজার টাকা, এক কোটির বেশি থেকে পাঁচ কোটি পর্যন্ত সাত হাজার ৫০০ টাকার পরিবর্তে ১২ হাজার টাকা এবং পাঁচ কোটির বেশি হলে ১৫ হাজারের বদলে ২৫ হাজার টাকা কাটা হবে।
কিন্তু অর্থ আইন, ২০১৭-এ শুধু পাঁচ কোটি টাকার ওপর জমা ও তোলার ক্ষেত্রে ১৫ হাজার টাকার বদলে ৩০ হাজার টাকা কর্তনের কথা বলা আছে। এ ক্ষেত্রে আর কোনো ধরনের পরিবর্তনের তথ্য নেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তব্যের আইনি কোনো ভিত্তি নেই। অর্থ আইনই এ ক্ষেত্রে চূড়ান্ত। তবে বাজেট বক্তব্যের প্রতিফলন ঘটাতে হলে অর্থ আইন সংশোধন করা হতে পারে।
ব্যাংকে লেনদেনের ওপর আবগারি শুল্ক নিয়ে অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তব্য ও অর্থ আইনে ভিন্নরকম তথ্য থাকা নিয়ে কালের কণ্ঠ’র এক প্রশ্নের জবাবে গতকাল এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, অর্থ আইন আগে ছাপানোর জন্য বিজি প্রেসে পাঠানো হয়েছিল। অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তব্য পরে প্রস্তুত করা হয়েছে। আর এই সময়ে অর্থ আইনে যে পরিমাণ আবগারি শুল্ক আরোপের কথা বলা হয়েছে, বিনিয়োগ পরিবেশের কথা বিবেচনা করে বক্তব্য প্রস্তুতের সময় অর্থমন্ত্রী তার চেয়ে কমিয়েছেন। আগামী ৫ জুন সংসদে অর্থ আইন সংশোধনের প্রস্তাব দেওয়া হবে। তিনি আরো বলেন, বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী যেটি বলেছেন, অর্থ আইন সংশোধন করে সেটিই কার্যকর করা হবে।
১২ অঙ্কের টিআইএন লাগবেই : আগামী অর্থবছর থেকে ৩১ ধরনের কাজ করতে গেলে ১২ অঙ্কের টিআইএন থাকতেই হবে। ব্যাংক থেকে ক্রেডিট কার্ড নেওয়া কিংবা ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে পাঁচ লাখ টাকার বেশি ঋণ নিতে গেলে এই টিআইএন লাগবে। এ ছাড়া আমদানির উদ্দেশ্যে ঋণপত্র খোলা যাবে না এটি ছাড়া। এক্সপোর্ট রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট পেতে হলেও টিআইএন থাকতে হবে। আমদানি-রপ্তানির বিল অব এন্ট্রির ক্ষেত্রেও এটি লাগবে। সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার ভেতরে ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন করা যাবে না ১২ অঙ্কের টিআইএন ছাড়া।
অর্থ আইনে বলা আছে, ১২ অঙ্কের টিআইএন ছাড়া কোনো দরপত্রে কেউ অংশ নিতে পারবে না। কম্পানি আইনে নিবন্ধিত কোনো ক্লাবের সদস্য হতে গেলেও এটি লাগবে। সাধারণ বীমার জরিপকর্তাকেও এই টিআইএন থাকতে হবে। সিটি করপোরেশন ও জেলা সদর পৌরসভায় জমি-বিল্ডিং বিক্রি, পাওয়ার অব অ্যাটর্নি, হস্তান্তর, দলিলসহ এক লাখ টাকার বেশি মূল্যের কোনো চুক্তিনামা করতে গেলেই টিআইএন থাকা বাধ্যতামূলক। বাস, প্রাইম মোভার, লরির মালিকানা পরিবর্তন কিংবা ফিটনেস নবায়ন করতেও এই টিআইএন লাগবে। ডাক্তার, ডেন্টিস্ট, আইনজীবী, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট, ইঞ্জিনিয়ার, আর্কিটেকচার, সার্ভেয়ারসহ বিভিন্ন পেশাজীবী বডিতে সদস্য হতে গেলেও ১২ অঙ্কের টিআইএন লাগবে। কোনো কম্পানির পরিচালক ও স্পন্সর পরিচালক, মুসলিম বিবাহ ও ডিভোর্স আইনে নিকাহ রেজিস্ট্রার ও যেকোনো ট্রেড বডির সদস্য হতেও এই টিআইএন লাগবে।
অর্থ আইন, ২০১৭-এ বলা হয়েছে, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ), খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কেডিএ) ও রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (আরডিএ) এলাকার মধ্যে কোনো ভবন নির্মাণের উদ্দেশ্যে অনুমোদন নিতে হলে ১২ অঙ্কের টিআইএন থাকতে হবে। এ ছাড়া ড্রাগ লাইসেন্স নেওয়া, গ্যাসের বাণিজ্যিক সংযোগ নেওয়া, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা এলাকায় বিদ্যুতের বাণিজ্যিক সংযোগ নেওয়া, মোটর গাড়ির মালিকানা পরিবর্তন বা ফিটনেস নবায়নেও এটি অবশ্যই থাকতে হবে।
এ ছাড়া লঞ্চ, স্টিমার, ফিশিং ট্রলার, কার্গো কোস্টারসহ বিভিন্ন জলযানের জরিপ সনদ নেওয়া, ইনস্যুরেন্স কম্পানির নিবন্ধন ও নবায়ন, জেলা পরিবেশ কার্যালয় থেকে ইটভাটার অনুমোদন নেওয়ার সময়ও এটি অবশ্যই থাকতে হবে। এ ছাড়া উপজেলা, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে হলে ১২ অঙ্কের টিআইএন থাকা বাধ্যতামূলক। সিটি করপোরেশন, জেলা শহর ও পৌরসভায় কোনো শিক্ষার্থীকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল বা বিদেশি কারিকুলামে ভর্তি করতে হলেও এটি থাকতে হবে। সরকারের যেসব কর্মচারীর বেতন মাসে ১৬ হাজার টাকার বেশি, তাদের ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য। একইভাবে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের মধ্যে যাঁরা মাসে ১৬ হাজার টাকার বেশি বেতন পান, তাঁরাও এর মধ্যে পড়বেন। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপনা, প্রশাসনিক কার্যক্রম, সুপারভাইজারি অবস্থান ও উৎপাদন পর্যায়ে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের সবারই ১২ অঙ্কের টিআইএন থাকতে হবে। কোনো কম্পানির ডিস্ট্রিবিউটরশিপ নেওয়ার ক্ষেত্রেও টিআইএন থাকা বাধ্যতামূলক। মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবসায়ীদেরও এটি থাকতে হবে। কোনো কম্পানি থেকে অ্যাডভাইজারি, কনসালট্যান্সি সার্ভিস, ক্যাটারিং সার্ভিস, ম্যানেজমেন্ট সার্ভিস, জনশক্তি সরবরাহ ও নিরাপত্তা সার্ভিসসহ বিভিন্ন সার্ভিস দিতে গেলেও ১২ অঙ্কের টিআইএন থাকতে হবে।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/06/03/504448