৩ জুন ২০১৭, শনিবার, ১০:৫১

কালীগঞ্জে বাফার গুদামের ২৮০ টন সার গায়েব

আগেও কোটি কোটি টাকার সার গায়েব হয়; দায়ীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে * জমাট বাঁধা সার ক্রাশিং করে বাজারে, ক্ষতিগ্রস্ত হবেন কৃষক

ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলায় বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনের (বিসিআইসি) বাফার গুদামের ২৮০ মেট্রিক টন ইউরিয়া সারের ঘাটতি ধরা পড়েছে, যার বাজারমূল্য প্রায় কোটি টাকা। এর আগেও কয়েক দফায় কোটি কোটি টাকার সার আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু দায়ীদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। নতুন করে ঘাটতি ধরা পড়া সারের বিষয়ে গুদাম কর্তৃপক্ষ বলছে, আগে যারা গুদামের দায়িত্বে ছিলেন তাদের সময়ই সার গায়েব করা হয়েছে। গুদামের সারের বাস্তব গণনা করলেই বিষয়টি বেরিয়ে আসবে। এদিকে বাফার গুদামে চলছে বহু দিনের জমাট বাঁধা মানহীন সারের ক্রাশিং। এগুলো ফের বাজারে ছাড়া হচ্ছে। মৃত্তিকা বিজ্ঞানীরা বলছেন, এ সার মানসম্মত না হওয়ায় ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এ সার জমিতে ব্যবহার করে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন কৃষকরা।
কালীগঞ্জ বাফার গুদামের নতুন করে ২৮০ টন সার গায়েব হওয়ার বিষয়ে গুদামের ইনচার্জ মাসুদ রানা জানান, তিনি ২০১৬ সালের ২৪ এপ্রিল গুদামের দায়িত্ব বুঝে নেন। ওই সময় খাতাপত্রে গুদামটিতে দুই হাজার ২৭৮ টন (৪৫ হাজার ৫৬১ বস্তা) জমাট বাঁধা সারের মজুদ ছিল বলে তাকে জানানো হয়। কিন্তু বাস্তবে সার ছিল তার চেয়ে অনেক কম। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে এসব সার ক্রাশিংয়ের কাজ শুরু করা হয়। ৩০ মে পর্যন্ত ৩৯ হাজার ৫৬১ বস্তা সার ক্রাশিং করা হয়েছে। এখনও ছয় হাজার বস্তা ক্রাশিং করা বাকি রয়েছে। ক্রাশিং চলবে আরও সপ্তাহ খানেক। এখন পর্যন্ত গুদামে আনুমানিক ২৮০ টন সারের ঘাটতি ধরা পড়েছে। এ কর্মকর্তা জানান, যে সময় এ সারগুলো ক্রয় করা হয় তখন ইউরিয়ার আন্তর্জাতিক বাজার দর ছিল প্রতি টন ৩৪ হাজার টাকা। সেই হিসাবে ৯৫ লাখ ২০ হাজার টাকার সারের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এ সার গেল কোথায়, আর দায়-ই বা কে নেবে- এ প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নের সরাসরি কোনো জবাব দিতে পারেননি গুদাম ইনচার্জ।

নিবিড় অনুসন্ধানে জানা গেছে, কালীগঞ্জ বাফার গুদামের আওতায় আট হাজার টন ধারণক্ষমতার তিনটি সার গুদাম (গোডাউন) রয়েছে। একটি উপজেলা শহরের রেলগেটের কাছে এবং অপর দুটি স্থানীয় বাসস্ট্যান্ডের পাশে অবস্থিত। ২০১০ সাল থেকে ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত তিনটি গুদাম থেকে ৫৪৭ দশমিক ৪৯ টন ইউরিয়া সার আত্মসাৎ করা হয়। বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের পর তোলপাড় শুরু হলে বিসিআইসির অতিরিক্ত প্রধান ব্যবস্থাপক (বিপণন) মঞ্জুর রেজার নেতৃত্বে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত দল গুদামে মজুদ সার বাস্তব গণনা ও ওজন করেন। ২০১৬ সালের ১৮ মে তদন্ত প্রতিবেদনে ৫৪৭ দশমিক ৪৯ মেট্রিক টন সার ঘাটতির বিষয়টি লিখিতভাবে জানানো হয়। সূত্রমতে, এ ঘটনায় জড়িত ছিলেন তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত গুদাম কর্মকর্তা জালাল উদ্দিন, আবু সাইদ, আবদুল লতিফ, হিসাব সহকারী (বর্তমান) জামির হোসেন, সহকারী সিকিউরিটি অফিসার বোরহান উদ্দিন। অভিযোগ রয়েছে, ওই সিন্ডিকেট পরিবহন ঠিকাদার ও স্থানীয় চিহ্নিত কয়েকজন সার ডিলারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় জোটবদ্ধ হয়ে নওয়াপাড়া ও খুলনা থেকে ট্রাকে করে আনা সার গুদামে আনলোড না করে পথেই বিক্রি করে দেয়। বিষয়টি জানাজানি হলে সার আত্মসাতে জড়িতদের চিহ্নিত করতে বিসিআইসি থেকে আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির তদন্ত প্রতিবেদন আজও আলোর মুখ দেখেনি। সার আত্মসাতে জড়িতদের বিরুদ্ধে বিসিআইসি এখনও শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিসিআইসির একজন পদস্থ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। ওই ঘটনায় তখন তোলপাড় সৃষ্টি হলে জামির হোসেন ছাড়া বাকি সবাইকে বদলি করা হয়। ওই ঘটনায় অন্যতম অভিযুক্ত তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত গুদাম কর্মকর্তা জালাল উদ্দিনকে বদলি করা হয় যমুনা ফার্টিলাইজার কারখানায়। তিনি অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমি এক বস্তা সারও আত্মসাত করিনি। তদন্ত কমিটির কাছে দুই দফায় বক্তব্য দিয়ে বিষয়টি পরিস্কার করেছি।

বর্তমান গুদাম ইনচার্জ মাসুদ রানা ২০১৬ সালের ২৪ এপ্রিল দায়িত্ব নিয়ে পূর্বসূরিদের সার আত্মসাতের বিষয়টি টের পান। তিনি গুদামের সার বাস্তব গণনা ও ওজনের দাবি জানান। পরে একই বছরের ২২ নভেম্বর তাকে জয়পুরহাটে বদলি করা হয়। নতুন ইনচার্জ হিসেবে যশোর থেকে আখতার হোসেন যোগদান করেন। তিনি লুটপাটের বিষয়টি আঁচ পেয়ে সারের বাস্তব গণনার দাবি জানান। বাস্তব গণনা না করায় তিনি তিন মাস দায়িত্বভার বুঝে না নিয়ে টালবাহানা করেন। অবশেষে ২৫ এপ্রিল আখতার হোসেনকে বিসিআইসির সদর দফতরে পদায়ন করা হয় এবং মাসুদ রানার বদলির আদেশ বাতিল করা হয়। ফলে মাসুদ রানাকেই গুদামের দায়িত্ব বুঝে নিতে হয়। এদিকে বাফার গুদামের সারের বাস্তব গণনার জন্য ঝিনাইদহের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে (এডিএম) মো. আসাদুজ্জামানকে প্রধান করে চার সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্য সচিব করা হয় বিসিআইসির প্রধান অফিসের সহকারী বাণিজ্যিক কর্মকর্তা সাইফুল আলমকে। কমিটির সদস্য হিসেবে আরও রয়েছেন বিসিআইসির সহকারী প্রধান অডিটর শেখ মাজেদ। কমিটিকে ৩১ মের মধ্যে বাস্তব গণনার সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়। কিন্তু সময়সীমা পার হয়ে গেলেও কমিটি এখন পর্যন্ত বাস্তব গণনা শুরুই করতে পারেনি। এ বিষয়ে কমিটির প্রধান ঝিনাইদহের এডিএম মো. আসাদুজ্জামান বলেন, তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাস্তব গণনার সময় বাড়ানো হয়েছে। বুধবার সকাল সাড়ে ৯টায় বাস্তব গণনার কাজ শুরু হবে।

কাগজপত্র অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০৯ সালের দিকে অনুরূপভাবে গুদামের ২১৩ টন ইউরিয়া সার আত্মসাৎ করা হয়। এ ঘটনায় ফেঁসে যান সে সময়কার ভারপ্রাপ্ত গুদাম কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ। তিনি এখনও বিসিআইসিতে চাকরিতে বহালতবিয়তে আছেন। তিনি বর্তমানে পলাশ সার কারখানার স্টোরকিপারের দায়িত্বে রয়েছেন। তার সময়ে আত্মসাৎ করা সারের মূল্য ছিল প্রায় ৭২ লাখ ৪২ হাজার টাকা। তবে বিসিআইসির সূত্র জানায়, আবুল কালামের মাসিক বেতন থেকে ভর্তুকি মূল্য আদায় করা হচ্ছে। নতুন করে সার গায়েব হওয়ার বিষয়টি সামনে এলে গুদাম কর্তৃপক্ষ বলছে, আগে যারা গুদামের দায়িত্বে ছিলেন তাদের সময়েই এসব হয়েছে। দীর্ঘদিন গুদামে বাস্তব গণনা না হওয়ায় এবং ওজন না করায় বিষয়টি এতদিন ধরা পড়েনি। এখন সার ক্রাশিং করতে গিয়ে সারের ঘাটতি ধরা পড়েছে। বাস্তব গণনার পর বিষয়টি পরিষ্কার হবে। সার ব্যবসায়ীরাও কালীগঞ্জ বাফার গুদামে কী ঘটছে, তা খতিয়ে দেখতে সংশ্লিষ্ট দফতরের দৃষ্টি কামনা করেছেন।

মানহীন সার ক্রাশিং করে বাজারে : এদিকে গুদামে দীর্ঘদিন পড়ে থাকা জমাট বাঁধা ইউরিয়া সার ক্রাশিং করে বাজারে ছাড়া হচ্ছে। বিসিআইসির ডিলার সমিতির পরিচালক ও ঝিনাইদহ জেলা সভাপতি হাজী জাহাঙ্গীর হোসেন ও সহ-সভাপতি আনোয়ারুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, কালীগঞ্জ বাফার গুদামের পাথরের মতো শক্ত জমাট বাঁধা সার ক্রাশিং করা হচ্ছে। এ সার মানসন্মত নয়। ক্রাশিংয়ের ফলে সার পাউডারে পরিণত হচ্ছে এবং জোর করে ডিলারদের নিতে বাধ্য করা হচ্ছে। এতে কৃষক ও সার ব্যবসায়ীরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ঝিনাইদহে মৃত্তিকা সম্পদ ইন্সটিটিউটের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কমকর্তা মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘদিন ধরে পড়ে থাকায় সারের মান নষ্ট হয়ে যেতে পারে। জমাট সার ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা ছাড়া ক্রাশিং করে বাজারে ছাড়া ঠিক হবে না। গুণগত মান ঠিক না থাকলে এ সার জমিতে ব্যবহার করলে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

বিসিআইসির সারা দেশের ২৫টি বাফার গুদামের বিপণনের দায়িত্বে থাকা নরসিংদীর ঘোড়াশাল সার কারখানার জিএম (বিপণন) হাবিবুর রহমানের ভাষ্য, সার জমাট বাঁধলেও গুণগত মান ঠিক আছে। এগুলো ক্রাশিং করে নতুন বস্তায় ভরে বাজারে ছাড়া হচ্ছে। সার ঘাটতি ও আত্মসাতের অভিযোগের বিষয়ে এ কর্মকর্তা বলেন, অভিযোগ তদন্ত ও ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্ব আমার নয়। এটি বিসিআইসি কর্তৃপক্ষের ব্যাপার।

http://www.jugantor.com/last-page/2017/06/03/129491/