গতকাল শুক্রবার রাজধানীর স্থানীয় একটি হোটেলে সিপিডি আয়োজিত বাজেটোত্তর সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য -সংগ্রাম
৩ জুন ২০১৭, শনিবার, ১০:৪৭

বাজেট বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বান্ধব নয় গুরুত্বপূর্ণ পরিসংখ্যানে ‘বিভ্রান্তি’

** কর-ভ্যাটের বোঝায় বাড়বে উৎপাদন ব্যয় ও মূল্যস্ফীতি
** বেশি চাপে পড়বেন মধ্য ও নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ
** এডিপি বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট দিক নির্দেশনা নেই

আগামী ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটি মনে করছে, এ বাজেট বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বান্ধব নয়, বরং রাজস্ব আয়সহ গুরুত্বপূর্ণ পরিসংখ্যানে ‘বিভ্রান্তি’ রয়েছে। এছাড়া কর ও ভ্যাটের বোঝায় উৎপাদন ব্যয় ও মূল্যস্ফীতি বাড়বে।
গতকাল শুক্রবার সকালে রাজধানীর গুলশানে লেকশোর হোটেলে আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক বাজেট প্রতিক্রিয়ায় সংস্থাটির পক্ষ থেকে এ সংশয় ও শংকা প্রকাশ করা হয়। এ সাংবাদিক সম্মেলনে প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে সিপিডির পর্যালোচনা উপস্থাপন করেন সংস্থাটির বিশেষ ফেলো অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। এ সময় সিপিডির সম্মানিত ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান, নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন, গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমসহ সংস্থার অন্য গবেষকরা উপস্থিত ছিলেন।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে আমরা একমত। কিন্তু এর আয় ও ব্যয়ের কাঠামোর মধ্যে দুর্বলতা রয়েছে। তিনি বলেন, শুধু প্রশাসনিক কাঠামো দিয়ে বাজেটে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। বাজেট বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সহায়তা দরকার। জনপ্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ প্রয়োজন। কিন্তু আমরা তা দেখছি না। এছাড়াও বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে সুর্নিদিষ্টি কোনো দিক নির্দেশনা নেই। তিনি বলেন, বাজেট বাস্তবায়নের জন্য একটি বাস্তবায়ন কর্মপরিকল্পনা খুব দ্রুততার সাথে অর্থ মন্ত্রণালয় ও পরিকল্পনা কমিশনের কাছ থেকে আসতে হবে।
দেবপ্রিয় বলেন, বাজেটে ঘাটতি মেটাতে ৭৬ হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক ঋণের সহায়তার ‘অবাস্তব লক্ষ্যমাত্রা’ আমাদের আশ্চর্য করেছে। কারণ গত চার বছর মিলে এ পরিমাণ বৈদেশিক সাহায্য নেয়া যায়নি। আমাদের ২০১৬ সালে ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক ঋণের সহায়তা আসে যার পরিমান মাত্র ২৭ হাজার কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী আসলে কোনো রকমে একটা অংক দিয়ে হিসেব মিলিয়ে দিয়েছেন। এগুলো বাস্তব সম্মত নয়। এছাড়াও বৈদেশিক ঋণ ব্যয় করতে পারছে না। তারপরও সরকার কিভাবে প্রায় তিনগুণ বাড়ালো তা জানি না। তাই ঘাটতি পূরণে বৈদেশিক উৎস হতে অর্থায়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়েও সংশয় প্রকাশ করে সিপিডি।
সিপিডি’র সাবেক এই নির্বাহী পরিচালক বলেন, এবারের বাজেট যেসব কাঠামোর উপর নির্ভর করে তৈরি করা হয়েছে তা অত্যন্ত দুর্বল। এই বাজেট বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বান্ধব নয়। তিনি বলেন, রাজস্ব আদায়, বার্ষিক উন্নয়ন বরাদ্দ ও বৈদেশিক সহায়তা এসবের কোনোটাই বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে পাওয়া যাবে না। ফলে এই বাজেট একটি আর্থিক ভ্রম। এতে রাজস্ব আয়সহ গুরুত্বপূর্ণ পরিসংখ্যানে বিভ্রান্তি রয়েছে। এক বছরে রাজস্ব আদায় ৪০ শতাংশ বাড়ার কোনো সুযোগ নেই। বিদেশি সাহায্য ও রাষ্ট্রীয় খরচ দ্বিগুণের বেশি করাও অসম্ভব।
জাতীয় নির্বাচনের দেড় বছর আগে বড় আকারের এই বাজেটের খরচ মেটাতে প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা জনগণের কাছ থেকে কর ও শুল্ক হিসেবে আদায়ের পরিকল্পনা করেছেন অর্থমন্ত্রী। এর মধ্যে ৯১ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা আসবে মূল্য সংযোজন কর থেকে। অর্থমন্ত্রীর এই পরিকল্পনার সমালোচনা করে দেবপ্রিয় বলেন, দ্রুত অর্থ আসে- এরকম ক্ষেত্রে বেছে বেছে কর বাড়ানো হয়েছে।
বাজেটের সামগ্রিক কাঠামো ভোগ, বিনিয়োগ ও মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব পড়বে জানিয়ে তিনি আরো বলেন, যে কর ও ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে তাতে উৎপাদন ব্যয় বাড়বে, বাড়বে ভোগ ব্যয়। ফলে মূল্যস্ফীতি বাড়বে। এতে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ সবচেয়ে বেশি চাপে পড়বেন।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের সরকারি বিনিয়োগ বড় ভূমিকা পালন করে। পাশাপাশি বেসরকারি বিনিয়োগ উন্নীত করতে হবে। অর্থনীতির সঙ্গে বাজেটের আকারও বাড়াতে হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু বাজেটের আকার বাড়ানো জন্য যে সক্ষমতার প্রয়োজন তাতে ঘাটতি আছে বলে আমরা মনে করি।
নতুন ভ্যাট আইন প্রসঙ্গে সিপিডি’র বিশেষ ফেলো বলেন, বাজেটে আগের ভ্যাট আইন ও নতুন আইনের মিশ্রণ ঘোষণা করা হয়েছে। আগের আইনে যা কিছু রাখা হয়েছে কোনটা কেন রাখা হলো তা অর্থমন্ত্রী পরিষ্কার করেননি। প্রকৃতপক্ষে করের আপাতন কোথায় বাড়ল কিংবা কোথায় কমল তা এখনও পরিষ্কার নয়। তবে আমাদের প্রাথমিক ধারণা অভ্যন্তরীণ বাজারে উৎপাদনমুখী তৎপরতার উপর চাপটা বেশি পড়ল।
অন্য বছরের মত এবারও বাজেট প্রস্তাবে তিনভাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়েছে। এগুলো হল- রিয়েল এস্টেটে বিনিয়োগ, বাংলাদেশ অবকাঠামো উন্নয়ন তহবিলে বিনিয়োগ এবং স্বেচ্ছায় ঘোষণা দিয়ে নির্দিষ্ট জরিমানার মাধ্যমে অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করা। বছরের পর বছর এভাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকলে সৎ করদাতারা কেন উৎসাহিত হবেন- সেই প্রশ্ন রাখেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। সরকারকে এ বিষয়ে একটি স্থায়ী সমাধান খোঁজার পরামর্শ দেন তিনি।
দেবপ্রিয় বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা নয়, যেতে হবে সামাজিক সুরক্ষায় এবং এ খাতে বরাদ্দ আরো বাড়াতে হবে। তিনি মনে করছেন, শিক্ষায় বরাদ্দ কিছু বাড়লেও স্বাস্থ্যখাত বঞ্চিত দশায় আছে। প্রতিরক্ষায় বরাদ্দ আগের মত থাকলেও কৃষিতে কমে গেছে। বাজেটে কর্মসংস্থান বাড়ানোর কোনো নির্দিষ্ট পরিকল্পনা না রাখা এবং ব্যাংক খাতে পুনঃঅর্থায়নের জন্য বাজেটে দুই হাজার কোটি টাকা রাখার সমালোচনা করেন তিনি।
অগ্রাধিকার ও বড় প্রকল্পগুলোর অর্থ খরচ করতে না পারায় সরকারের সমালোচনা করে তিনি বলেন, চলতি অর্থবছরে বাজেটের ২২ শতাংশ বরাদ্দ খরচ করা যায়নি। এবারও ২০ শতাংশ বরাদ্দ ওইসব প্রকল্পেই রাখা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ‘উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ : সময় এখন আমাদের’ শ্লোগানে আগামী অর্থবছরের (২০১৭-১৮) জন্য চার লাখ ২৬৬ কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেট গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে পেশ করছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। প্রস্তাবিত বাজেট চলতি অর্থবছরের মূল বাজেট ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা থেকে ২৬ শতাংশ বেশি। আর চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট ৩ লাখ ১৭ হাজার ১৭৪ কোটি টাকা থেকে ৮৪ হাজার কোটি টাকা বেশি।
অর্থমন্ত্রী আগামী অর্থবছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার ধরেছেন ২২ লাখ কোটি টাকারও বেশি। আর জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ধরেছেন ৭ দশমিক ৪ শতাংশ। আর মূল্যস্ফীতির হার ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ।

http://www.dailysangram.com/post/286421-