২ জুন ২০১৭, শুক্রবার, ১১:৪৯

ভ্যাটের মহাসড়কে দেশ

বছরে আদায় করা হবে লাখ কোটি টাকার ভ্যাট

ব্যবসায়ীদের দাবি পুরোপুরি উপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত ভ্যাটের নতুন হার ১৫ শতাংশই রাখা হলো। আগামী ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া নতুন অর্থবছরে ব্যবসায়ীরা এই হারেই ভোক্তাদের কাছ থেকে ভ্যাট আদায় করবেন। এর ফলে শুধু এক বছরে ভ্যাটের মাধ্যমে জনগণের পকেট থেকে নেয়া হবে প্রায় লাখ কোটি টাকা। বর্ধিত এই ভ্যাটের হার নিশ্চিতভাবে বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেবে। আর এতে বেশ চাপে পড়বে নির্দিষ্ট আয়ের মানুষেরা। যারা কি না ইতোমধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বেসামাল দামের চাপে ন্যুব্জ হয়ে পড়েছেন। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সাফ জানিয়ে দিলেন, আগামী তিন বছর ১৫ শতাংশ হারেই ভ্যাট আদায় করা হবে।
এই ঘোষণার মধ্যে দিয়েই তিনি গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জন্য চার লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব পেশ করেন। বাজেট প্রস্তাব পেশ করার আগে তা মন্ত্রিসভার বিশেষ এক বৈঠকে অনুমোদন করিয়ে নেয়া হয়। বাজেটটি অনুমোদন করেন রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
৮৩ বছর বয়সী অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতার নামকরণ করেছেন, ‘উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশ : সময় এখন আমাদের’। তবে বাজেটে ভ্যাটের জন্য যেভাবে পীড়াপীড়ি করা হয়েছে, তাতে ব্যবসায়ীরা এই বাজেটকে ভ্যাটের মহাসড়ক মনে করতে পারেন। বাজেট বক্তৃতার দেড় শ’ পাতাজুড়ে তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক খাতের বিভিন্ন সাফল্য ও উন্নয়নের ফিরিস্তি তুলে ধরেছেন। আগামী কয়েক বছর কী করা হবে তাও বলেছেন। কিন্তু কিভাবে তা উল্লেখ করেননি, দেশের আর্থিক বা ব্যাংকিং খাত বর্তমানে কী পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আছে। খেলাপি ঋণ কেন বেড়ে চলেছে, তা কমানো যাবে কিভাবে, সরকারি ব্যাংকের অধঃপতনের নেপথ্য কারণ কী তা বাজেটের কোথাও উল্লেখ নেই, দেশ থেকে প্রতি বছর যে বিপুল অর্থ পাচার হয়ে যাচ্ছে, তা কিভাবে ঠেকানো যাবে। দেশ থেকে দুর্নীতি স্বজনপ্রীতিই বা কিভাবে কমানো যাবে। এসব বিষয় নির্দ্বিধায় এড়িয়ে গেছেন আমাদের বর্ষীয়ান অর্থমন্ত্রী। বরাবরই যা তিনি করে থাকেন!
তাই অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতাটি এক কথায় গতানুগতিক হিসেবে অভিহিত করা যায়। এখানে নতুনত্বের তেমন কোনো ছোঁয়া ছিল না। অতীতের ধারাবাহিক বাজেট বক্তৃতার প্রতিচ্ছবি। অর্থমন্ত্রী নিজেই বাজেটকে উচ্চাভিলাষী অভিহিত করেছেন। কারণ অর্থমন্ত্রী অনেকটা নিশ্চিতভাবেই জানেন, এত বড় বাজেট এক বছরে বাস্তবায়ন করার সক্ষমতা সরকারের নেই। তাতে কী, তাও জনগণকে দেখানো হলোÑ দেখ আমরা চার লাখ কোটি টাকার বাজেট দিলাম! সরকার মেয়াদ শেষ করার আগে পাঁচ লাখ কোটি টাকা অতিক্রম করবে। চলতি অর্থবছরের বাজেটও অর্থমন্ত্রী পুরোটা বাস্তবায়ন করতে পারেননি। সংশোধন করে তা কমিয়ে আনা হয়েছে। এটিও বছর শেষে বাস্তবায়ন করা যাবে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। অর্থনীতিবিদেরা ইতোমধ্যে প্রস্তাবিত বাজেটকে অবাস্তব, উচ্চাভিলাষী ও জনগণের পকেট কাটার বাজেট বলে মন্তব্য করেছেন।
এক নজরে বাজেট
আগামী অর্থবছরের বাজেটের মূল আকার চার লাখ ২৬৬ কোটি টাকাÑ যা চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের চেয়ে ১৭ শতাংশ এবং সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ২৬ শতাংশ বেশি। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার তিন লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা নির্ধারিত করা হলেও বাস্তবায়ন ব্যর্থতার কারণে আকার কমিয়ে তিন লাখ ১৭ হাজার ১৭৪ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়।
মোট রাজস্ব প্রাপ্তি
বাজেটে মোট রাজস্ব প্রাপ্তির প্রাক্কলন করা হয়েছে দুই লাখ ৮৭ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে এটি ছিল দুই লাখ ৪২ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে করা হয়েছে দুই লাখ ১৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
আগামী অর্থবছরে মোট রাজস্ব প্রাপ্তির মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) মাধ্যমে আদায় করা হবে দুই লাখ ৪৮ হাজার ১৯০ কোটি টাকা। এর মধ্যে মূল্য সংযোজন করÑ মূসক বা ভ্যাট থেকেই আদায় করা হবে ৯১ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে ভ্যাট থেকে আয় ৭১ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা ধরা থাকলেও আদায় ব্যর্থতার কারণে তা কমিয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে ৬২ হাজার ৭৫৪ কোটি টাকা।
লাখ কোটি টাকারও বেশি ঘাটতি
আগামী বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ গিয়ে ঠেকেছে এক লাখ ১২ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। জিডিপির অংশ হিসেবে যা ৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরে এই ঘাটতির পরিমাণ ৯২ হাজার ৩৩৭ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে এই ঘাটতির পরিমাণ আরো খানিকটা বেড়ে হয়েছে ৯৩ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা।
ঘাটতি পূরণ কিভাবে
ঘাটতি পূরণের জন্য বাজেটে বৈদেশিক ঋণের প্রাপ্তি ধরা হয়েছে ৫৫ হাজার ৩১৩ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে যা ছিল ৩০ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা। কিন্তু কাক্সিক্ষত মাত্রায় বিদেশী সহায়তা না পাওয়ার কারণে সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে করা হয়েছে ২৪ হাজার ৭৭ কোটি টাকা। কিন্তু এরপরও সরকার আশা করছে আগামী অর্থবছরে অর্ধশত কোটি টাকারও বেশি বিদেশী সাহায্য থেকে পাওয়া যাবে।
আগামী অর্থবছরে ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছেÑ ২৮ হাজার ২০৩ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে যা ছিল ৩৮ হাজার ৯৩৮ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে করা হয় ২৩ হাজার ৯০৩ কোটি টাকা।
জাতীয় সঞ্চয়পত্র থেকে আগামী অর্থবছরে সরকার ঋণ নেবে ৩০ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে এ খাত থেকে ঋণ নেয়ার পরিকল্পনা ১৯ হাজার ৬১০ কোটি টাকা থাকলেও সংশোধিত বাজেটে তা দ্বিগুণেরও বেশি বাড়িয়ে করা হয় ৪৫ হাজার টাকা।

http://www.dailynayadiganta.com/detail/news/224923