২ জুন ২০১৭, শুক্রবার, ১১:৩৪

নড়লেন না অর্থমন্ত্রী ভ্যাটের হার ১৫%

ব্যবসায়ীদের জোরালো আপত্তি সত্ত্বেও আগামী অর্থবছরে বহুল আলোচিত ভ্যাট আইন-২০১২ সম্পূর্ণ বাস্তবায়নের ঘোষণা দিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। ব্যবসায়ীদের মন জোগাতে এ আইনে কিছু ছাড় দিলেও শেষ পর্যন্ত নিজের পথেই হাঁটলেন তিনি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ছকের বাইরে যেতে পারেননি। আইএমএফের সূত্রে বাতিল করলেন প্যাকেজ ভ্যাট, ভ্যাটের হার রাখলেন ১৫ শতাংশই। এতে নতুন অর্থবছরে ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধার বাইরে থাকা সীমিত কিছু পণ্য বাদে অধিকাংশ পণ্য কিনতে গেলেই ক্রেতাদের গুনতে হবে বাড়তি অর্থ। ক্রেতারা অজান্তেই তা পরিশোধে বাধ্য হবে। বাজেটে এক হাজার ৪৩টি পণ্য ও সেবায় ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

আগামী অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) লক্ষ্যমাত্রা দুই লাখ ৪৮ হাজার ১৯০ কোটি টাকার মধ্যে ৯১ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা ভ্যাট হিসেবে আদায় করা হবে, যা এনবিআরের মোট লক্ষ্যমাত্রার ৩৬.৮ শতাংশ। এ অর্থ জোগাড়ে অর্থমন্ত্রী বেছে নিলেন সবচেয়ে সহজ উপায় ‘ভ্যাট’ নামের পরোক্ষ কর ব্যবস্থা। নব্বই-পরবর্তী সব সরকারের আমলেই নিরাপদ রাজস্ব আদায়ে ভ্যাট ছিল প্রধান হাতিয়ার। ধনী-দরিদ্র সবাকেই বাধ্য হয়েই একই হারে ভ্যাট দিতে হয়। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও পুরনোদের দলেই থাকলেন।
চলতি অর্থবছরে ৭৩ হাজার ৫৫৩ কোটি টাকা ভ্যাট আদায়ের হিসাব করেছিলেন অর্থমন্ত্রী। গত মার্চ পর্যন্ত এ খাত থেকে আদায় হয় ৪৭ হাজার ৭৫০ কোটি ১৬ লাখ টাকা। মোট রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রায় ১১ হাজার ৩০২ কোটি ৫২ লাখ টাকা ঘাটতিতে অর্থমন্ত্রী বাধ্য হয়েই পরে চলতি অর্থবছরের ভ্যাট আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করে ৬৮ হাজার ৭৬৮ কোটি টাকা নির্ধারণ করেন অর্থমন্ত্রী। আগামী অর্থবছরে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২২ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা বাড়িয়ে ভ্যাট আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন।
অর্থমন্ত্রী গতকাল বাজেট বক্তৃতায় পণ্যের দাম বাড়ার বিষয়টি খানিটা এড়িয়ে গেলেন। তবে ভ্যাট অবহ্যাতিপ্রাপ্ত খাত ও পণ্য ছাড়া সোনা, রুপা, রডসহ সব পণ্য ও খাতেই দাম বাড়বে শুধু ভ্যাটের কারণে। আগামী বাজেটে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ভ্যাট আদায়ের পাশাপাশি সম্পদশালীদের কাছ থেকেও ভ্যাট আদায়ে নজর দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। ভ্যাট আইন-২০১২ সম্পূর্ণ বাস্তবায়নের স্বার্থে ব্যাংকে টাকা রাখলেও গুনতে হবে বাড়তি অর্থ। আবার বিমান ভ্রমণেও থাকছে ভ্যাটের থাবা। ভ্যাটের আওতায় আবগারি শুল্ক আরোপ করা হচ্ছে ব্যাংক হিসাব ও উড়োজাহাজ ভ্রমণে। তবে বিমান ভাড়ায় বাড়তি অর্থ গুনতে বিপাকে পড়বে মূলত কম আয়ের মানুষ; যারা জীবিকার সন্ধানে বিদেশে যাবে, দেশের বাইরে পড়তে যাবে কিংবা ভিটামাটি বিক্রি করে বিদেশে চিকিৎসার জন্য যাবে।
চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট ও কানেকটিং ফ্লাইটের ক্ষেত্রে তিন ধরনের আবগারি শুল্ক বহাল আছে। এর মধ্যে ৫০০ টাকার আবগারি শুল্ক অপরিবর্তিত রেখে ১০০০ টাকা ও ১৫০০ টাকার শুল্ক নতুন অর্থবছরে দ্বিগুণ হয়ে যথাক্রমে ২০০০ টাকা ও ৩০০০ টাকা আরোপ করা হয়েছে।
আগামী অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবে সার্কের বাইরে এশিয়ার যেকোনো দেশে বিমান ভ্রমণের জন্য এক হাজার টাকার পরিবর্তে দুই হাজার টাকা আবগারি শুল্ক আরোপ করার কথা বলা হয়েছে। আবার ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে বিমান ভ্রমণের জন্য এক হাজার ৫০০ টাকার পরিবর্তে তিন হাজার টাকা আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে।
অন্যদিকে বছরের যেকোনো সময় যেকোনো ব্যাংক হিসাবে এক লাখ এক টাকা থেকে ১০ লাখ পর্যন্ত যেকোনো অঙ্কের টাকা জমা বা তোলা হলে বছর শেষে ওই হিসাব থেকে আবগারি শুল্ক বাবদ ৮০০ টাকা কেটে নেবে সরকার। প্রতিবছর ৩১ ডিসেম্বর এ শুল্ক কেটে নিয়ে সরকারের কোষাগারে জমা করে ব্যাংকগুলো। সারা বছরে কোনো ব্যাংক হিসাবধারী যদি একবারও এমন লেনদেন না করে, ৩০ ডিসেম্বরে এসে একবারের জন্য এমন অঙ্কের লেনদেন করে, তাহলেও বছরে নির্ধারিত হারে আবগারি শুল্ক দিতে হবে। আগামী ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ২০১৭-১৮ অর্থবছর থেকে নতুন এই হার কার্যকর করার প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী।
ব্যক্তিগতভাবে ১১ বার বাজেট প্রণয়নের অভিজ্ঞতা এবারে কাজে লাগিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। উচ্চহারে ভ্যাট আরোপ করলেও ব্যবসায়ীদের খুশি রাখারও চেষ্টা করলেন, ভ্যাট আইন ২০১২তে কিছু সংশোধনী আনলেন। বকেয়া ভ্যাট আদায়ে ভ্যাট খেলাপি ব্যক্তির আত্মীয়ের কাছ থেকে বকেয়া আদায়ে বিধি থাকলেও গতকাল অর্থমন্ত্রী তা বাতিল করলেন।
সীমা বাড়ালেন : ভ্যাট অব্যাহতির সীমা ৩০ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩৬ লাখ টাকা করলেন অর্থমন্ত্রী। অর্থাৎ মাসে গড়ে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত টার্নওভারধারী প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট খাতে কোনো অর্থ পরিশোধ করতে হবে না। ভ্যাট নিবন্ধনসীমা ৮০ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে এক কোটি ৫০ লাখ টাকা করলেন। এ সীমায় লেনদেনে ৪ শতাংশ হারে টার্নওভার কর দিতে হবে। এক কোটি ৫০ লাখ টাকার বেশি বিক্রি হলে ভ্যাট নিবন্ধন নিতে হবে এবং ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হবে।
রেয়াত : নতুন বিধান অনুয়ায়ী সরবরাহ গ্রহণ করলে এবং তার অনুকূলে ভ্যাট চালান থাকলেই রেয়াত গ্রহণ করতে পারবে। উপকরণ কর পরিশোধের প্রয়োজন হবে না। আমদানি ক্ষেত্রে বিল অব এন্ট্রি থাকলেই আমদানিতে পরিশোধিত ভ্যাট রেয়াত ও আগাম কর হ্রাসকারী সমন্বয় হিসেবে ফেরত পাওয়া যাবে।
আমদানি পর্যায়ে সম্পূরক শুল্ক : বাণিজ্য সুরক্ষার জন্য আমদানি পর্যায়ে এক হাজার ৬৬৬টি এইচএস লাইনের আওতায় বিদ্যমান সব পণ্যে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
অব্যাহতি : হাঁস-মুরগি, গবাদি পশু, পশুর মাংস, মাছ, ফলমূল, শাক-সবজি, ভোজ্য তেল, চিনি, গুড়, লবণ, তুলা, পাট, পাটজাত পণ্য, রেশম সুতাসহ সব ধরনের কৃষিজ পণ্য ভ্যাটের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে। উঁচু বা মাঝারি হোটেলে ১৫ শতাংশ ভ্যাট থাকলেও সব অস্থায়ী হোটেল ও রেস্তোরাঁয় খাদ্যদ্রব্য সরবরাহকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
ওষুধ প্রশাসনের তালিকা অনুযায়ী জীবন রক্ষাকারী প্রায় সব ওষুধ ও কিছু ইক্যুইপমেন্টকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল ব্যতীত সব শিক্ষাব্যবস্থাকে ভ্যাটের ব্যবস্থার বাইরে রাখা হয়েছে। সমাজকল্যাণমূলক কার্যক্রমকে ভ্যাটের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে। জনস্বাস্থ্য এবং চিকিৎসাসেবা, সব প্রশিক্ষণ, শিশু পালন কার্যক্রম এবং বয়স্ক, অক্ষম, দরিদ্র, এমন অক্ষম লোকদের জন্য আবাসিক যত্নের সেবা, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যক্রমের জন্য পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ কার্যক্রম, কৃষিকাজে ব্যবহৃত সব উপকরণে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। ডেইরি, ফাউন্ড্রি, পাটশিল্পের কাজে ব্যবহৃত সব যন্ত্রপাতিও ভ্যাট অব্যাহতির আওতায় থাকবে।
সরকারের ফার্স্ট ট্র্যাক তালিকাভুক্ত সব প্রকল্পের বেশির ভাগ সরবরাহ, নির্মাণ, ইন্টারনেট ইত্যাদি সেবাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। পিপিপির আওতাভুক্ত সব প্রকল্পে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
সব ধরনের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে ভ্যাটের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে। রেডিও ও টেলিভিশন সম্প্রচার, শিল্পকর্ম, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, অপেশাদারি খেলাধুলা, অপেশাদারি ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, লাইব্রেরি, সব ধরনের জাদুঘর, আর্ট গ্যালারি, চিড়িয়াখানা, বোটানিক্যাল গার্ডেনের প্রবেশ মূল্য, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজনকারী প্রতিষ্ঠান, শ্যুটিং ক্লাব, সব ধরনের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও খেলাধুলা বিষয়ক, কৃষিপণ্য বা উদ্যান বা খামার, পশুপাখি, মৎস্য, জলজ প্রাণী ও জলজ সম্পদ, বনজ প্রাণী ও বনজ সম্পদ, শিল্প, সাহিত্য, প্রযুক্তি, প্রকৌশল ইত্যাদি বিষয়ক মেলা ও প্রদর্শনীর প্রবেশ ফি ভ্যাট অবাহতি দেওয়া হয়েছে। জীবন বীমা সম্পূর্ণ, কম্পিউটার ও কম্পিউটার যন্ত্রাংশও ভ্যাট অব্যাহতি পাবে। আইসিটি খাত, দেশীয় সফটওয়্যারের খরচ কমাতে, তাদের উৎসাহ প্রদান করতে দেশীয় সব সফটওয়্যার উৎপাদন ও সরবরাহকে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। আমদানীকৃত সফটওয়্যারে আমদানি পর্যায়ে শুল্ককর আছে। সফটওয়্যারের পাশাপাশি কম্পিউটার ও তার যন্ত্রাংশও ভ্যাট থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্ত। বাংলাদেশে উৎপাদিত ফ্রিজ, টিভি, এসি ও মোটরসাইকেলে বিদ্যমান অব্যাহতি বহাল রাখা হয়েছে।

http://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2017/06/02/504107